Beta
মঙ্গলবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০২৪

সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর ঠিকুজি তালাশ

শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের পর সংসদ ভবনে উল্লসিত জনতা। সংসদেই ২০১১ সালে পাস হয়েছিল সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনের প্রস্তাব।
শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের পর সংসদ ভবনে উল্লসিত জনতা। সংসদেই ২০১১ সালে পাস হয়েছিল সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনের প্রস্তাব।
[publishpress_authors_box]

বাংলাদেশের সংবিধানে এই পর্যন্ত পরিবর্তন এসেছে মোট ১৭ বার। তারমধ্যে পঞ্চদশ সংশোধন সবচেয়ে আলোচিত একটি। নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা বাদ দেওয়ার এই সংশোধনের মধ্যে বর্তমান সংকটের বীজ নিহিত বলেও অনেকে মনে করেন।

আওয়ামী লীগ সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধন আনার পর যে তিনটি নির্বাচন হয়েছে, সবগুলো হয়েছে দলীয় সরকারকে ক্ষমতায় রেখে। আর এর সবগুলোই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিলুপ্ত তত্ত্বাধায়ক সরকারের আদলেই একটি সরকার গঠিত হয়েছে। তারপর একটি রিট আবেদনে সোমবার আবার আলোচনায় এল সংবিধানের সেই পঞ্চদশ সংশোধনী।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, রিট আবেদনে এই রুল এসেছে বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি শশাঙ্ক শেখর সরকারের হাইকোর্ট বেঞ্চ থেকে।

সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনের ঠিকুজি তালাশ করতে গেলে যেতে হবে ত্রয়োদশ সংশোধনের দিকে। ১৯৯৬ সালে রাজনৈতিক এক সংকটের দাওয়াই হিসাবে এসেছিল সেই সংশোধন।

সামরিক শাসন থেকে ১৯৯১ সালে গণতন্ত্রে ফেরা বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল ১৯৯৪ সালে মাগুরার উপনির্বাচনে ভোট কারচুপির পর।

আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলগুলোর প্রবল আন্দোলনের মুখে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন আয়োজন করলেও টিকতে পারেনি বিএনপি সরকার। বিরোধীদের দাবি মেনে সেই ষষ্ঠ সংসদে একদিনের এক অধিবেশনে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধন আনা হয়। তাতে সংবিধানের ২ (ক) পরিচ্ছদে যুক্ত হয় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা।

তারপর দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হলেও গোল বাধে ২০০৬ সালে। আইন অনুযায়ী, সেবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়ার কথা ছিল সদ্য সাবেক প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানের। কিন্তু আওয়ামী লীগ তাকে মানতে আপত্তি জানায়।

অভিযোগ ছিল, ২০০৪ সালে বিএনপি সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধন এনে বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা বাড়িয়েছিল, তাতে দলটির এক সময়ের নেতা বিচারপতি হাসানের কর্মকাল বেড়ে যায়, ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়ার সুযোগ হয় তার। বয়স না বাড়ালে তার পরে আরও একজন অবসরে যেতেন, তখন তিনিই হতেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা।

রাজনৈতিক সেই বিরোধ না মেটায় ২০০৬ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মো. ইয়াজউদ্দীন আহম্মেদ নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে সংকট আরও ঘনীভূত হওয়ায় ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি এসেছিল বহুল আলোচিত জরুরি অবস্থা। তারপর যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসেছিল সেনাবাহিনীর সমর্থনে, তারা দুই বছর ছিল।

এরপর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় যাওয়ার দুই বছর পর ২০১১ সালের ৩০ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধন এসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করে দেয়।

তবে তার আগেও একটি ঘটনা আছে, তা হচ্ছে আদালতের রায়। সংবিধান সংশোধনের এক মাস আগেই সর্বোচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক বলে রায় দিয়েছিল।

আদালতের সেই রায় মেনেই সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধন, এই যুক্তি তখন দেখিয়েছিল আওয়ামী লীগ নেতারা। তখন বিএনপির প্রতিক্রিয়া ছিল, আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্য ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখা।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হওয়ায় ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছিল বিএনপিসহ অধিকাংশ দল। ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিলেও তারা দাবি করে, ভোটে কারচুপি প্রমাণ করে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প নেই। এরপর এই বছর অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনও বর্জন করে তারা।

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। ফাইল ছবি

কী ছিল সেই রায়ে

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যুক্ত করে সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনী আনার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আইনজীবী এম সলিম উল্লাহসহ কয়েকজন আদালতে গিয়েছিলেন।

কিন্তু হাইকোর্ট ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বৈধ বলে রায় দেয়। তাতে বলা হয়, “ত্রয়োদশ সংশোধনী সংবিধানসম্মত ও বৈধ। এ সংশোধনী সংবিধানের কোনও মৌলিক কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত করেনি।”

সেই রায়ের বিরুদ্ধে রিট আবেদনকারীরা আপিল বিভাগে গিয়েছিল। এর মধ্যে সলিম উল্লাহ মারা যাওয়ায় পর আব্দুল মান্নান খান নামের আরেকজন আইনজীবী সেই আবেদনটিকে এগিয়ে নেন।

দীর্ঘদিন পর ২০১১ সালে মার্চ মাসে আপিল বিভাগে সেই আপিলের শুনানি শুরু হয়। গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার আগে আদালত শীর্ষস্থানীয় আটজন আইনজীবী মত নেয়।

এই অ্যামিচি কিউরিদের মধ্যে টি এইচ খান, কামাল হোসেন, আমীর-উল ইসলাম, মাহমুদুল ইসলাম ও রোকনউদ্দিন মাহমুদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখার পক্ষে মত দেন। রফিক-উল হক ও এম জহিরের মত ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংস্কারের। শুধু আজমালুল হোসেন কিউসি বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

ওই বছরের ১০ মে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ রায় দেয়। তাতে বলা হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অবৈধ ও অসাংবিধানিক।

সংক্ষিপ্ত রায়ে বলা হয়েছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আরও দুটি সংসদ নির্বাচন হতে পারে। তবে তাতে বিদায়ী বিচারপতিদের বাদ রাখাই শ্রেয়।

রায়ে বলা হয়েছিল, সংবিধান ত্রয়োদশ সংশোধন অসাংবিধানিক ও অবৈধ হলেও জাতীয় সংসদ তার বিবেচনা এবং সিদ্ধান্ত অনুসারে দশম ও একাদশ সাধারণ নির্বাচনকালীন সময়ে প্রয়োজনমতো নতুনভাবে ও আঙ্গিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে।

রায়ে আরও বলা হয়েছিল, সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগে সংসদ ভেঙে দেওয়াই বাঞ্ছনীয়। নির্বাচন পরবর্তী নতুন মন্ত্রিসভা দায়িত্ব না নেওয়া পর্যন্ত পূর্ববর্তী মন্ত্রিসভা স্বাভাবিক ও সাধারণ কার্যক্রম পরিচালনা করবে।

সেই রায়টি সাত বিচারকের আপিল বিভাগের সর্বসম্মত রায় ছিল না। সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে হয়েছিল সেই রায়। চারজন বিচারক তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পক্ষে মত দিয়েছিলেন, দুজন ছিলেন বহাল রাখার পক্ষে। বাকি একজন বিষয়টি সংসদের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছিলেন।

রায়ের পর তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছিলেন, “আদালত ত্রয়োদশ সংশোধনীকে সংবিধানের মূল চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক উল্লেখ করে তা বাতিল ঘোষণা করেন।”

পরবর্তী দুটি নির্বাচন নিয়ে রায়ের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, আগামী দুটি নির্বাচন করা যাবে, কিন্তু এই রায়ের পর তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় সংস্কার এনে সংবিধানে সংশোধনী এনে তা করতে হবে।

বিএনপির নেতা ও সাবেক আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদ তখন রায়টিকে ‘স্ববিরোধী’ বলে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “একদিকে আদালত ত্রয়োদশ সংশোধনীকে অবৈধ বলে ঘোষণা করেছে, অন্যদিকে বলেছে এখনও নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে।”

এর ১৬ মাস পর ২০১২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ৭৪৭ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করে আপিল বিভাগ।

তাতে দেখা যায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের সঙ্গে একমত পোষণ করেন বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (এস কে সিনহা) ও সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। বিচারপতি এস কে সিনহাও আলাদাভাবে অভিমত লেখেন। তিনি দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল রাখার পক্ষে মত দেন। তবে এই সরকারে বিচারপতিদের বাদ দিতে বলেন।

বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে মত দিয়েছিলেন। তার সঙ্গে একমত পোষণ করেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা। শুধু বিচারপতি ইমান আলী বিষয়টি সংসদের ওপর ছেড়ে দিতে মত দেন।

তবে পূর্ণাঙ্গ রায়ে পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার বিষয়টি আর ছিল না।

সংসদ অধিবেশন। ফাইল ছবি

রায়ের পরের মাসেই সংবিধান সংশোধন

এই রায়ের এক বছর আগেই সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। এলক্ষ্যে সংসদীয় বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়, তার চেয়ারম্যান ছিলেন তৎকালীন সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, কো-চেয়ারম্যান ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।

২০১১ সালের ১০ মে আপিল বিভাগের রায়ের প্রতিক্রিয়ায় সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছিলেন, তাদের কমিটি সর্বোচ্চ আদালতের এই রায়কে বিবেচনায় নেবে।

২০১০ সালের ২১ জুলাই গঠিত ১৫ সদস্যের এই কমিটি সাবেক রাষ্ট্রপতি, তিন সাবেক প্রধান বিচারপতি, রাজনৈতিক নেতা, সম্পাদক এবং নাগরিক সমাজের সদস্যসহ ১০৪ জন বিশিষ্ট নাগরিকের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করে।

এরপর ২০১১ সালের ২৯ মার্চ কমিটি সুপারিশ দেয়। তবে মে মাসে আদালতের আদেশের সেই সুপারিশে আরও কিছু পরিবর্তন আনা হয়। সেই সুপারিশের আলোকে ২০১১ সালের ২৫ জুন সংবিধান সংশোধনের সেই প্রস্তাব সংসদে উত্থাপন করেন তৎকালীন আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ।

বিলটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়েছিল সেদিন। ওই কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।

কমিটিকে দুই সপ্তাহ সময় দেওয়া হলেও কয়েকদিনেই কমিটি প্রতিবেদন দেয়। এরপর ২০১১ সালের ৩০ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বিল সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে পাস হয়।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের বিপক্ষে অবস্থা নেওয়া বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের ৩৯ জন ও এলডিপির ১ জন সংসদ সদস্য সেদিন সংসদে যাননি।

বিলের বিপক্ষে সংসদে লড়াই করে গিয়েছিলেন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ফজলুল আজিম, যিনি এক সময় বিএনপিতে ছিলেন।

তিনি সংসদে দাঁড়িয়ে ‘দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বলছি’ বলার সঙ্গে সঙ্গেই সরকারি দলের সংসদ সদস্যরা হেসে উঠেছিলেন।

ফজলুল আজিম সেদিন বলেছিলেন, “বিলটি নিয়ে মতদ্বৈততা আছে। সংবিধান নিয়ে জাতি আজ বিভক্ত। প্রয়োজন অনুযায়ী প্যারা-উপ প্যারাতে সংশোধনী আনা যেতে পারে। কিন্তু মৌলিক বিষয়ে পরিবর্তন কেন করা হলো? এত তড়িঘড়ির দরকার কী?”

তিনি আরও বলেছিলেন, “দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে এই সরকার যদি সংবিধান সংশোধন করে, তবে তা হবে ঐতিহাসিক ভুল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার রেখে দেওয়া হোক। বিরোধী দলকে ডেকে পরে এ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক।”

এক পর্যায়ে মাইক বন্ধ হয়ে গেলে তার প্রতিবাদে ওয়াকআউটও করেছিলেন ফজলুল আজিম। তবে পরে আবার ফিরে আসেন।

তার বক্তব্যের জবাবে তৎকালীন আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ বলেছিলেন, “অগণতান্ত্রিক কোনও সরকার সংবিধানে আপনি রাখতে পারবেন না। উচ্চ আদালত যেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে বাতিল করেছে, সেখানে এটা আমরা সংবিধানে রাখতে পারি না।”

এরপর তৎকালীন স্পিকার মো. আবদুল হামিদ সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাবটি বিভক্তি ভোটের মাধ্যমে বিলের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এতে পক্ষে ভোট পড়ে ২৮৯টি, বিপক্ষে ১টি। এরপর দ্বিতীয় দফায় বিভক্তি ভোটের সংবিধান সংশোধনী বিলটি পাস হয়। তাতে পক্ষে ভোট পড়ে ২৯১টি, বিপক্ষে ১টি। দুটি ক্ষেত্রেই শুধু ফজলুল আজিম ‘না’ ভোট দেন।

সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বিল সংসদে পাস হওয়ার পর তৎকালীন স্পিকার আবদুল হামিদ বলেছিলেন, “এর আগে সবসময় রাতেই সংবিধান সংশোধন হয়েছে। এবারই প্রথম দিনের আলোয় সংবিধান সংশোধন হলো।”

সংবিধানে এখন নেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা, যা বিলুপ্ত হয় পঞ্চদশ সংশোধনে।

কোন যুক্তিতে এখন রিট আবেদন

আন্দোলনে সরকার পতনের পর সাংবিধানিক সংকটে আবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ফেরার পর পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল চেয়ে রবিবার রিট আবেদন করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, ড. তোফায়েল আহমেদ, এম হাফিজ উদ্দিন খান, জবিরুল হক ভুইয়া ও জারাহ রহমান।

শুনানিতে চারটি যুক্তি তুলে ধরার কথা জানান তাদের আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া।

প্রথমত, যখন পঞ্চদশ সংশোধনী করা হয়, তখন সংবিধানে একটি অনুচ্ছেদে বলা ছিল, সংবিধানের অনেকগুলো অনুচ্ছেদের সংশোধনী করতে হলে গণভোটের দরকার হবে। কিন্তু সেই গণভোট না করে পঞ্চদশ সংশোধনী আনা হয়, যা অসাংবিধানিক।

দ্বিতীয়ত, পঞ্চদশ সংশোধনীতে সংবিধানের আইন প্রণয়নের ক্ষমতাকে খর্ব করা হয়েছে। তার কারণ হলো সংবিধান সংশোধন করতে হলে দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থন প্রয়োজন। কিন্তু আবার অনেকগুলো অনুচ্ছেদের ব্যাপারে বলা হয়েছে, কোনও সংসদ এই অনুচ্ছেদ সংশোধন করতে পারবে না। এটা করে জনগণের সাংবিধানিক অধিকারকে খর্ব করা হয়েছে।

তৃতীয়ত, পঞ্চদশ সংশোধনী সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী। মৌলিক কাঠামের মধ্যে একটা হলো গণতন্ত্র, আরেকটি হলো নিরপেক্ষ সুষ্ঠু নির্বাচন। দুটি একটি আরেকটির পরিপূরক। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এই দুটিকে খর্ব করা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে অবাধ, নিরপেক্ষ সুষ্ঠু নির্বাচন থেকে মানুষকে বঞ্চিত করা হয়েছে।

চতুর্থত, আপিল বিভাগ বলেছিল যে পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্ববধায়ক সরকারের অধীনে হতে হবে, কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনী করে সেই সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, যা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

রিট আবেদনকারী বদিউল আলম মজুমদার গত বছরই এক কলামে লেখেন, “এটি সুস্পষ্ট যে প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকদের প্রদত্ত সংক্ষিপ্ত আদেশটি নিয়ে সরকার, বিশিষ্টজন ও গবেষকদের অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। সরকার ও বিশিষ্টজনদের মতে, আপিল বিভাগের সংক্ষিপ্ত আদেশ বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল-সম্পর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী একতরফাভাবে পাস করা হয়। এর বিপরীতে, গবেষকদের মতে, আদালতের সংক্ষিপ্ত আদেশ অমান্য করেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়।

“এটি সুস্পষ্ট যে আপিল বিভাগের সংক্ষিপ্ত আদেশ অমান্য করেই পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করা হয়েছে, অর্থাৎ এটি হলো অসাংবিধানিক সংবিধান সংশোধন।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত