কর্মক্ষেত্রে বার্ন (শস্যাগার/আস্তাবল) জ্যাকেট, চোর (দৈনন্দিন কাজ) কোট এবং ডংকি জ্যাকেটের চল উঠে গেছে। এককালে শ্রমজীবীদের এসব পোশাক এখন দেখা যাচ্ছে ফ্যাশনপ্রেমীদের গায়ে। এতে করে কি যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের পোশাক কারখানার কর্মীদের খাটো করা হচ্ছে? না কি ওইসব শ্রমিকের প্রতিটি ঘামের ফোঁটার প্রতি সম্মান দেখানোর নতুন ধারা শুরু হয়েছে এভাবে?
যে পোশাক গায়ে দিত কায়িক শ্রমের কর্মীরা, সেই কোট এখনকার ফ্যাশনিয়েস্তাদের ওয়ার্ড্রোবে থাকবেই। এই তিন বিশেষ কোটের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস নিয়ে প্রতিবেদন করেছে বিবিসি।
বার্ন জ্যাকেটের উত্থান
শরতের মাঝামাঝি মনে হল হেইলি বিবার, ডুয়া লিপা এবং অ্যালেক্সা চাং এবার বার্ন জ্যাকেট পরার মৌসুমে গা ভাসাবেন। দ্য গার্ডিয়ানের কাছে ‘এমন মৌসুমে কাজের এই জ্যাকেটি আবার পরার পর যে কাউকেই দারুণ দেখায়’। ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল ম্যাগাজিন ম্যারি ক্লেয়ার দাবি করছে, ‘এখন পরার মতো এই একটি জ্যাকেটই আছে।’
চওড়া পকেট দেয়া এই জ্যাকেট পাওয়া যায় হাঁসের ডিমের নীলচে-সবুজ অথবা গাঢ় মেরুন কিংবা ফরাসি সরিষার রঙে। আস্তাবলের গোবর-ময়লা পরিস্কারের কাজে থাকা শ্রমিকরা এই জ্যাকেট গায়ে দিত।
ব্রিটিশ ব্র্যান্ড বারবেরি যেমন জ্যাকেট বানায়, এই বার্ন জ্যাকেট দেখতে খানিক সেরকমই। ২০২৪ সালে বসন্ত-গ্রীষ্মে ক্যাটওয়াক শো করেছিল প্রাডা ব্র্যান্ড। তখন থেকেই এই জ্যাকেটের জনপ্রিয়তা সবার মাঝে দেখা দেয়। রোজকার জীবনের পোশাকের সঙ্গে এই জ্যাকেট বেশ খাপ খেয়ে যায়।
অ্যালবার্ট মুজকুইজ বিবিসিকে বলেন, “এই পোশাকে এক ধরনের আরাম আছে বলে মনে হয় আমার।”
একজন ফ্যাশন ইতিহাসবিদ এবং সোশাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার মুজকুইজ ইনস্টাগ্রামে ‘এজিঅ্যালবার্ট’ নামে পরিচিত। চোর কোট নিয়ে তার টিকটক ভিডিও ৭৫ হাজারেরও বেশি বার দেখা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রের জন্য পোশাক নিয়ে কারহার্ট, ডিকিস এবং লেভি স্ট্রস এবং আরও অনেক বড় ব্র্যান্ডগুলোর দীর্ঘদিনের রাজনীতি নিয়ে ভালোই ধারণা রাখেন মুজকুইজ।
এসব ব্র্যান্ড নিজেদের বার্ন জ্যাকেট, চোর জ্যাকেট বার করেছে। জনপ্রিয় তারকা থেকে ফ্যাশন অনুরাগীরা এক জোড়া হাই হিল স্টিলেটোস জুতা অথবা জিনসের সঙ্গে এই জ্যাকেট পরে সকালের হাঁটা ও কফি পানে চলে যাচ্ছেন।
বার্ন জ্যাকেট কেন এত জনপ্রিয় হয়ে উঠল?
“আমরা সাধারণ টেকসই জিনিস ব্যবহার করতে চাই। এই জ্যাকেট পরার পর দেখতেও ভালো লাগে। তাছাড়া এগুলো নারী-পুরুষ উভয়েই পরতে পারে”, বিবিসিকে নিজের মতামত জানিয়ে এসব বলেন মুজকুইজ।
এই জ্যাকেট তাকে ইতিহাসের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।
“এই ইতিহাস অনেক সমৃদ্ধ। যা অনেকটা সময়ের কাছে পাঠানো প্রেমের চিঠির মতো। ওই সময় আর ফিরে আসবে না, যা আমাদের হাতে ছিল এক সময়।”
খানিক আক্ষেপ নিয়ে মুজকুইজ বলেন, “আগের মতো মান বজায় রেখে এখন এসব পণ্য পাওয়া যায় না। তারপরও খুব সাশ্রয়ী মূল্যে কেনা যাচ্ছে, এতো আমাদের সৌভাগ্য। ইতিহাস থেকে উঠে আসা এক টুকরো, যা প্রতিদিন গায়ে দেয়া যাচ্ছে এবং সবকিছুর সঙ্গে মানিয়েও যাচ্ছে।”
ধ্রুপদী চোর কোট
বার্ন জ্যাকেটের মতোই সবকিছুর সঙ্গে দারুণ মানিয়ে যায় নীল রঙের চোর কোট। কর্মজীবনের ময়লা ও নোংরা চট করে ঝেড়ে ফেলতে এই কোট এসেছিল।
বিবিসিকে ডিজাইনার এবং ডেনিম ইতিহাসবিদ মোহসিন সাজিদ বলেন, “আগেকার দিনে একটি ব্রাশ হাতে নিয়ে জামার গায়ে লাগা ময়লা ঝেড়ে নেয়া হতো। পোশাক মানে একটি বিনিয়োগ। আমরা আবার সেই মানসিকতায় ফিরে চলেছি।”
চোর কোট বা জ্যাকেটের মূল নকশায় বোতাম, চওড়া পকেট এবং কলার ছিল। পল নিউম্যান এমন কোট পরেছিলেন ১৯৬৭ সালের ‘কুল হ্যান্ড লিউক’ সিনেমায়।
১৯ শতকের ফ্রান্সে এই কোটের চল শুরু হয় বলে ধারণা করছেন অনেকে। ঢিলেঢালা এবং বড় আকারের পকেট থাকায় এই জ্যাকেটে যন্ত্রপাতি বহন করা যেত সহজেই।
ফ্রান্স থেকে সোজা যুক্তরাষ্ট্রে এসে পৌঁছায় চোর কোট। এখানে রেলের শ্রমিকরা অথবা কায়িক শ্রমের কর্মীরা এই কোট পরত। চোর কোটের নীল রঙ থেকেই যুক্তরাষ্ট্রে ‘ব্লু কলার ওয়ার্কার’ বিশেষণের উৎপত্তি হয়।
এখন যাদের শারীরিক পরিশ্রম ল্যাপটপ চালানোর মতো কাজে সীমাবদ্ধ, তারাও চোর কোট পরছে। তাহলে শ্রমজীবীদের পোশাকের সাংস্কৃতিক ইতিহাস কি মুছে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে?
মধ্যবিত্ত সংস্কৃতিতে পেশাজীবীরা কি এই ইতিহাস দখল করে নিচ্ছে?
“মূল প্রেক্ষাপট থেকে সরিয়ে আনা হলে পোশাক শুধু ফ্যাশন আইটেম হয়ে ওঠে,” এই অভিমত প্রকাশ করলেন ফ্যাশন ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির অধ্যাপক ডরিস ডোমোজ্লাই-ল্যান্টনার।
বার্ন জ্যাকেট এবং চোর কোটের নাম থেকেই বোঝা যায় কৃষি ও শ্রমিকদের কাজের সময় পরার জন্য এই পোশাক বানানো হয়েছি। হাতুড়ি রাখা যাবে এমন ভেবেই পকেট বসানো হয়েছিল। আধুনিক ফ্যাশনে জ্যাকেটের এই মূল বৈশিষ্ট্য রাখা হয়নি।
কর্মক্ষেত্রের ইউনিফর্ম থেকে ফ্যাশন সংগ্রহের পোশাক হয়ে ওঠার ইতিহাস অবশ্য এখানেই সীমিত নয়। ১৯৭০-৮০ -এর দশকে সঙ্গীত ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে জড়িত ‘পাঙ্ক’ গোষ্ঠীর পোশাকও ফ্যাশন জগতে জায়গা করে নিয়েছে।
ডংকি জ্যাকেট কেন আলাদা
২০২৪ সালের ‘স্মল থিংস লাইক দিস’ সিনেমায় কয়লা ব্যবসায়ী চরিত্রে অভিনয় করা কিলিয়ান মারফি ডংকি জ্যাকেট পরেছেন।
১৯৮৪-৮৫ সালে ইংল্যান্ড ওয়েলসে খনি শ্রমিকদের বেতন ও কাজের শর্ত নিয়ে ধর্মঘট হয়েছিল। সেই আন্দোলনের ৪০ বছর পূর্তিতে আলোচনায় এসেছে ডংকি জ্যাকেটও। আন্দোলন নিয়ে নির্মিত প্রামাণ্যচিত্রে দেখা গেছে, এতে যোগ দেয়া কর্মীরা ডংকি জ্যাকেট পরে এসেছে।
খুচরা বিক্রেতা এবং বুটিকের দোকানে এখনও এই পোশাক বিক্রি হয়। ড্রেক ব্র্যান্ডের এই জ্যাকেট কিনতে খরচ হবে ৯৯৫ পাউন্ড! ১৯৮৪ সালের একজন খনি শ্রমিকের মজুরি থেকে এই মূল্য অনেকখানি বেশি।
“আমি নিশ্চিত, ৮০-এর দশকের ওই ব্যক্তিরা এখন সম্ভবত তাদের কবরে বলছেন, “৪০০ পাউন্ড তো পাঁচ বছরের বেতনের সমান”, বললেন মোহসিন।
অত্যধিক দামে বিক্রির পেছনের ’মিথ’ নিয়ে মুজকুইজ বলেন, “যে কোনো ফ্যাশন স্টেটমেন্টে কিছু মানুষ সৌখিনতার জন্যই এমন পোশাক পরেন। দাম বলতে আমরা কম ভাবতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছি।
“এমনকি আগে কাজের জন্য যখন এসব পোশাক পরা হতো তখনও এসব ব্যয়বহুলই ছিল। ওই যুগে খনি শ্রমিকদের জন্য একটি লিভাইস জিনস কেনা মানে দুই মাসের বেতন খরচ করা।”
মূল নকশায় ডংকি জ্যাকেট হতো রঙ কালো অথবা গাঢ় নীল রঙের মেলটন উলের কাপড়ে। এতে শক্ত কলার বসানো হতো। সবমিলিয়ে এই পোশাক ঠান্ডা কিংবা খারাপ আবহাওয়াতে সুরক্ষা দিতো। চামড়ার সেলাই থাকায় কাঁধে করে ভারী বস্তুন বহন করার পরও পোশাক ঠিক থাকতো।
এই জ্যাকেটের চল শুরু হয়েছিল ইংল্যান্ডে। স্ট্যাফোর্ডশায়ারের ড্রেপার জর্জ কিকে বানিয়েছিলেন; যা ম্যানচেস্টার শিপ ক্যানালের নেভিদের পোশাক ছিল; যারা ডংকি ইঞ্জিনে কাজ করতো। আর এখান থেকে জ্যাকেটের নামের সূত্রপাত।
মাস্টার ডেবনএয়ারের প্রতিষ্ঠাতা সাইমন হুইটেকার বিবিসিকে বলেন, “ডংকি জ্যাকেট ব্রিটিশ শ্রমিক শ্রেণির ইতিহাসে বিশেষ জায়গা জুড়ে আছে।
“এই জ্যাকেট বানানো হয়েছিল যেন শ্রমিকরা সস্তার মধ্যে মোটা ও উষ্ণ পোশাক পরতে পারে।”
“… ব্রন্সকি বিট ও ডেক্সিস মিডনাইট রানার্স ব্র্যান্ডগুলোও এমন জ্যাকেট গায়ে দিয়েছিল শ্রমিক শ্রেণির প্রতি সম্মান জানাতে।”
“এখন ড্রেকস এবং আরও অনেক ব্র্যান্ড এই জ্যাকেট কয়েকশো থেকে হাজার হাজার পাউন্ডে বিক্রি করছে”, বললেন হুইটেকার।
“কেউ হয়তো এই চর্চাকে শ্রেণি অধিকারহরণ বলতে পারেন। প্রয়োজনের জন্য পরা থেকে বিলাসিতা হয়ে উঠেছে পোশাক। এরপরও আমি আসলে মনে করি, এই পোশাকের মূলধারার ফ্যাশনের অংশ হওয়ারও গুরুত্ব আছে। এভাবে অন্তত ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখা যাচ্ছে। ভেবে দেখা গেলে, অতীতের প্রতি শ্রদ্ধাও দেখানো যাচ্ছে এভাবে।”
রেডিট ব্যবহারকারী ক্রোকোডাইলজক বিবিসিকে বলেন, “মজার বিষয় হলো, এই পোশাক যে কোনো জায়গায় কেনা যেত না।
“এটি বিভিন্ন কাউন্সিল এবং সেবাদানকারী সংস্থাগুলো শ্রমিকদের জন্য এই পোশাক বরাদ্দ রাখতো। সেখান থেকে শ্রমিকরা একটি করে পেতো।”
ইন্টারনেটের যুগে ফ্যাশন অনেক গণতান্ত্রিক হয়ে উঠেছে। নতুন ধারা গড়ে তোলা এখন অনেক বেশি সহজ। যদিও নতুনত্বে ক্লান্তি দেখা যাচ্ছে ফ্যাশন জগতে। আর এ কারণেই অতীতের ঐতিহ্য থেকে পোশাক খুঁজে নিচ্ছে অনেকে। এভাবে এসব পোশাক চিরকালের হয়ে উঠছে।