Beta
সোমবার, ৬ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
সোমবার, ৬ জানুয়ারি, ২০২৫

চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেইনার উঠানামা : নির্ভরতা বেড়েছে এনসিটি-সিসিটির

চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেইনার বোঝাই পণ্য।
চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেইনার বোঝাই পণ্য।
[publishpress_authors_box]

চট্টগ্রাম বন্দরের কন্টেইনার উঠানামায় আগে থেকেই নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) এবং চিটাগাং কন্টেইনার টার্মিনাল (সিসিটি)—এই দুটি টার্মিনালের ওপর নির্ভরতা বেশি ছিল। আধুনিক এই দুটি টার্মিনালের ওপর ২০২৪ সালে বন্দরটির নির্ভরতা আরও বেড়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, ২০২৪ সালে ৩২ লাখ ৭৫ হাজার একক (প্রতিটি ২০ ফুট দীর্ঘ হিসাবে) কন্টেইনার উঠানামা করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেশি। সেই কন্টেইনার উঠানামার ৬৬ শতাংশ করেছে এনসিটি ও সিসিটি। এছাড়া বন্দরে থাকা জেনারেল কার্গো বার্থের (জিসিবি) ছয়টি জেটিতে উঠানামা হয়েছে ৩১ শতাংশ।

আর জাহাজের মেইন লাইন অপারেটরদের হিসাবে, ২০২৪ সালে কন্টেইনার উঠানামা হয়েছে ২৮ লাখ ৩০ হাজার এককের মতো। এ হিসাবে ৬৪ শতাংশ কন্টেইনার উঠানামা করেছে এনসিটি ও সিসিটিতে।

আগের বছরগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে এই দুটি টার্মিনালে নির্ভরতা যে ক্রমাগত বাড়ছে, তার প্রমাণ মেলে।

মেইন লাইন অপারেটরদের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালে মোট কন্টেইনার উঠানামায় এনসিটি ও সিসিটির হিস্যা ছিল ৬২ শতাংশ। ২০২২ সালে ছিল ৬০ শতাংশ। ২০২১ সালে ছিল ৬০ শতাংশের মতো। ২০২০ সালে ছিল ৬০ শতাংশ। আর ২০২৪ সালে সেটি বেড়ে হয়েছে ৬৪ শতাংশ।

মূলত চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি ও সিসিটির যে সক্ষমতা, সেটি ইতোমধ্যেই পূর্ণ হয়ে গেছে। এনসিটিতে বছরে ১১ লাখ একক কন্টেইনার উঠানামার সক্ষমতা আছে। এখন হচ্ছে পৌনে ১৩ লাখ একক। এখন সর্বোচ্চ সক্ষমতার পণ্য উঠানামা চলছে এই দুটি টার্মিনালে।

এখন এনসিটির সেই টার্মিনালটিই সংযুক্ত আরব আমিরাতের আন্তর্জাতিক বন্দর পরিচালনাকারী ডিপি ওয়ার্ল্ডকে দিয়ে পরিচালনার তোড়জোড় চলছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমল থেকেই এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কিছুদিন কার্যক্রম থেমে ছিল। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার এখন সেই প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার পদক্ষেপ নিয়েছে।

এই প্রক্রিয়া ঠেকাতে বন্দরের শ্রমিকরা নিয়মিতই সমাবেশ করছে; দেখা দিচ্ছে শ্রম অসন্তোষ।

চট্টগ্রাম বন্দর সচিব ওমর ফারুক বলেন, “এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেইনার উঠানামায় যত প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, ততই এনসিটি-সিসিটির ওপর নির্ভরতা বাড়ছে। প্রতিবছর যে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, সে অনুযায়ী তো আমাদের জেটি-টার্মিনাল বাড়ছে না। ফলে সেই দুটি টার্মিনালে বাড়তি ‘কি গ্যান্ট্রি ক্রেন’ যোগ করেই আমরা প্রবৃদ্ধি সামাল দিচ্ছিলাম।

“আর এনসিটি বিদেশি অপারেটর দিয়ে চলবে কিনা—সেটি মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের বিষয়। মন্ত্রণালয় যেভাবে গাইডলাইন দেবে, সেভাবেই আমরা আগাব।” 

এনসিটি-সিসিটির ওপর নির্ভরতা বাড়ছে কেন

চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য বোঝাই কন্টেইনার উঠানামার জন্য আছে এনসিটি, সিসিটি ও জিসিবি। এছাড়া পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল (পিসিটি) সৌদি আরব ভিত্তিক ‘রেড সি গেইটওয়ে’ দিয়ে পরিচালনা করা হলেও যন্ত্রপাতি যোগ না হওয়ায় পুরোদমে কার্যক্রম শুরু হয়নি। ফলে ২০২৪ সালে কন্টেইনার উঠানামায় পিসিটির অবদান ছিল নগণ্য।


দেশের গতিশীল অর্থনীতিকে সাপোর্ট দিতে চট্টগ্রাম বন্দরকে প্রধানতই এনসিটির ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয়েছে। কারণ, দ্রুত পণ্য উঠানামার জন্য বন্দরের হাতে অন্য কোনও বিকল্প ছিল না। এখনও নেই। পিসিটি বিকল্প হয়ে উঠার কথা থাকলেও সেটি পূর্ণতা পেতে বেশ সময় লাগবে। আর সেটি বিদেশি অপারেটর দিয়েই পরিচালিত হচ্ছে। সিসিটিতে ‘কি গ্যান্ট্রি ক্রেন’ থাকলেও, সেগুলো বেশ পুরনো। প্রায় সময়ই বিকল থাকছে। সেখানে জেটি আছে মাত্র দুটি। ফলে সেটির বড় অবদান রাখার সুযোগ কম। ফলে এনসিটির চারটি জেটির ওপরই নির্ভরতা বেড়েছে।

আর জেনারেল কার্গো বার্থে (জিসিবি) আছে ছয়টি জেটি; সেখানে জেটিতে ক্রেন না থাকায় জাহাজের ক্রেন দিয়েই পণ্য উঠানামা হয়। ফলে জিসিবি পণ্য উঠানামায় পিছিয়ে থাকে। যেমন জাহাজ অপারেটরদের হিসাবে ২০২৪ সালে যে ২৮ লাখ ৩০ হাজার একক কন্টেইনার উঠানামা হয়েছে তারমধ্যে ১০ লাখ ১৬ হাজার একক করেছে জিসিবি ছয়টি জেটি। আর একই সময়ে এনসিটির চারটি জেটি করেছে ১২ লাখ ৬২ হাজার একক।

এনসিটি-সিসিটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠার প্রধান কারণই হচ্ছে এর গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান। এনসিটির পাশে কর্ণফুলী নদীর পানির গভীরতা বেশি থাকায় সবচে বড় জাহাজ এবং বেশি পরিমাণ পণ্য নিয়ে আসা জাহাজ কেবল সেখানেই ভিড়তে পারে। ফলে বড় জাহাজগুলো সেখানে ভিড়তে অগ্রাধিকার পায়। সেই তুলনায় জিসিবিতে ভেড়ে অপেক্ষাকৃত কমপণ্যবাহী বা ছোট জাহাজ। ফলে এনসিটি ও সিসিটির ওপর নির্ভরতা বেশি। আর এই দুটি টার্মিনালই পরিচালনা করে আসছে সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড। ২০০৯ সাল থেকে পরিচালনার কারণে টার্মিনাল পরিচালনায় তাদের দক্ষতা গড়ে উঠেছে।

মোট কন্টেইনার উঠানামায় এনসিটির নির্ভরতা নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরফদার রুহুল আমিন বলেন, “এনসিটি কীভাবে পরিচালিত হবে, সেটি সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের বিষয়। তবে আমি বলবো আজকে যে বন্দরে জাহাজ দিনে দিনে ভিড়তে পারছে, লয়েডস লিস্টে সামনের দিকে স্থান করে গৌরব অর্জন করছে, এক মুহূর্তের জন্য বন্দররে চাকা বন্ধ না থেকে দেশের অর্থনীতিকে সাপোর্ট দিচ্ছে, সেটি আমাদের এফিসিয়েন্সির কারণে। আমরা যাত্রা শুরুর পর বিদেশি টিম এনে দেশীয় টিমকে প্রশিক্ষিত করে টার্মিনাল পরিচালনার একটি স্ট্রকাচার দাঁড় করিয়েছিলাম। এর সুফল গত বেশ ক’বছর ধরেই মিলছে।”

বন্দর ব্যবহারকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০০৭ সালের আগে চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে ভেড়ার আগে একটি কন্টেইনার জাহাজ বহির্নোঙ্গরে অপেক্ষায় থাকত গড়ে ১২ থেকে ১৫ দিন। ধর্মঘটে প্রায় সময়ই অচলাবস্থা তৈরি হতো এই বন্দরে। এই ধর্মঘটকে পুঁজি করে সরকারকে অচল করে দেওয়ার নজিরও ছিল। বাড়তি সময় বহির্নোঙরে বসে থাকায় প্রতিটি জাহাজকে দিনে ১২ থেকে ২০ হাজার ডলার মাশুল গুনতে হতো; আর এই মাশুল যোগ হতো পণ্যের দামে।

ধীরে ধীরে আধুনিক যন্ত্র এবং দক্ষ ব্যবস্থাপনায় জাহাজের গড় অপেক্ষমাণ সময় ১২ দিন থেকে কমে নেমে এসেছে দুই থেকে আড়াই দিনে। এর ফলে বিপুল খরচ সাশ্রয় হয় পণ্য পরিবহনে। এর প্রভাব পড়ে দেশের অর্থনীতিতে।

জেটিতে জাহাজ এসে পণ্য নামিয়ে আবার রপ্তানি পণ্য তুলে ৪৮ ঘণ্টায় ছেড়ে যাওয়ার নজির গড়ার সুফল বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। কম সময়ে বেশি পণ্য ওঠানামার রেকর্ড গড়ায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যায়। এর ফলে বিশ্বের একশ শীর্ষ বন্দরের তালিকায় ৬১তম স্থানে পৌঁছে যায় এই বন্দর।

এক্ষেত্রে এনসিটির গতিশীল ব্যবস্থাপনা ‘গেম চেঞ্জার’ হিসাবে ভূমিকায় অবতীর্ণ বলে দাবি সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেডের।

এখন এনসিটিকে বিদেশি অপারেটর দিয়ে পরিচালনার বিরোধিতা করছে স্বার্থসংশ্লিষ্ট অনেকে। তাদের মতে, আন্তর্জাতিক স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান দিয়ে দেশের টার্মিনাল পরিচালনায় দ্বিমত নেই। কিন্তু একটি রেডিমেড টার্মিনাল, যেখানে বন্দরের হাজার কোটি টাকার যন্ত্রপাতি যুক্ত আছে। যেটি শুধু চট্টগ্রাম বন্দরই নয়, পুরো দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে, শ্রমিক ধর্মঘটমুক্ত এবং নিরবচ্ছিন্নভাবে পরিচালনার কারণে ২০০৯ সাল থেকেই যে টার্মিনালটি দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে অসাধারণ ভূমিকা রাখছে, সেই সচল টার্মিনাল বিদেশি অপারেটর দিয়ে পরিচালনা করতে হবে কোন যুক্তিতে।

তাদের মতে, নতুন স্থানে একটি আধুনিক টার্মিনাল তৈরি করে সেটি পরিচালনার দায়িত্ব আন্তর্জাতিক স্বনামধন্য অপারেটরদের দেওয়া যেতে পারে। চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ে চারগুণ বড় প্রস্তাবিত বে টার্মিনাল কিংবা মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, এমনকি পায়রা সমুদ্রবন্দরে নতুন টার্মিনাল নির্মাণে বিদেশিদের আগ্রহকে প্রাধান্য দেওয়া যেতে পারে। এতে বিশ্বের সব আধুনিক প্রযুক্তি যন্ত্রপাতি সংযোজন করেই তারা টার্মিনাল পরিচালনা করবে, আন্তর্জাতিক বন্দরগুলোর সঙ্গে সরাসরি সার্ভিস চালু করবে। কতটা যোগ্য তারা সেটিও প্রমাণ হবে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত