একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার বিচারিক আদালতের রায়ে দণ্ডিত ছিলেন ৪৯ জন, এখন দেখার বিষয় আপিলের রায়ে তাদের কী হয়?
২০ বছর আগের নজিরবিহীন এই হামলার ঘটনায় ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে শুরু হয়েছিল বিচার, আওয়ামী লীগ সরকার আমলে রায়ের ছয় বছর পর এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে আসছে হাই কোর্টের রায়।
রবিবার বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের বেঞ্চ আলোচিত এই মামলায় মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন এবং আসামিদের আপিলের রায় দেবে।
গ্রেনেড হামলা চালিয়ে শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার এই মামলায় ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর বিচারিক আদালতের রায় দিয়েছিলেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর তৎকালীন বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে এই হামলায় দলটির নেতা-কর্মীসহ ২৪ জন নিহত হয়।
২০০৮ সালে ফখরুদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে সিআইডি তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র দিলে তার ভিত্তিতে শুরু হয়েছিল বিচার।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর অধিকতর তদন্তে আসামির তালিকায় যুক্ত হয় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ৩০ জনের নাম। ফলে আসামির সংখ্যা বেড়ে হয় ৫২ জন।
তার প্রায় এক দশক পরে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর বিচারিক আদালতের রায়ে ৫২ আসামির মধ্যে ৪৯ জন দণ্ড দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে ৭ জন রাজনীতিক, ৮ জন পুলিশ, ৫ জন সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা এবং ২৯ জন জঙ্গি ছিলেন।
অন্যান্য মামলায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া বাকি ৩ আসামির নাম বাদ দেওয়া হয় এই মামলা থেকে। এই তিনজন হলেন-খালেদা জিয়ার সরকারের মন্ত্রী, জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী (হুজি) নেতা মুফতি আবদুল হান্নান ও তার সহযোগী শরীফ শাহেদুল আলম বিপুল।
দণ্ডিত ৭ রাজনৈতিক নেতা
মামলায় তারেক রহমানসহ আট রাজনীতিকের বিরুদ্ধে গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়। এছাড়া তাদের বিরুদ্ধে গ্রেনেড হামলা পরিচালনার জন্য আর্থিক সহায়তা, প্রশাসনিক সহায়তা এবং গ্রেনেড সরবরাহ করার অভিযোগ আনা হয়।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ২১ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে ওই হামলা চালানো হয়। হামলায় অংশ নেয় নিষিদ্ধ সংগঠন হুজির জঙ্গিরা। তারা সহযোগিতা নেয় বিদেশি জঙ্গিদের। হামলায় ব্যবহৃত আর্জেস গ্রেনেড আনা হয়েছিল পাকিস্তান থেকে।
এই ষড়যন্ত্রের পেছনে তখনকার চারদলীয় জোট সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ‘ইন্ধন’ ছিল বলে অভিযোগে বলা হয়েছিল।
আদালতে উপস্থাপিত জঙ্গি নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানের জবানবন্দিতে বলা হয়, বিএনপি সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের সহায়তায় তিনি আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিলেন। ওই পরিকল্পনা হয়েছিল ‘হাওয়া ভবনে’, যার নিয়ন্ত্রণ ছিল তারেক রহমানের হাতে।
রাজনীতিকদের মধ্যে দণ্ডিত অন্য ছয়জন হলেন- খালেদা জিয়ার সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য লুৎফুজ্জামান বাবর, বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, সাবেক শিক্ষা উপমন্ত্রী ও ও বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য আবদুস সালাম পিন্টু, খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, বিএনপি নেতা হানিফ পরিবহনের মালিক মো. হানিফ ও বিএনপির সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার আরিফুল ইসলাম আরিফ।
এদের মধ্যে তারেক রহমান, কায়কোবাদ ও হারিছ চৌধুরীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। বাবর, পিন্টু ও হানিফকে মৃত্যুদণ্ড দেয় বিচারিক আদালত।
তারেক রহমান ২০০৮ সাল থেকেই যুক্তরাজ্যে রয়েছেন। তাকে পলাতক দেখিয়েই হয়েছিল বিচার। কায়কোবাদ ও হানিফও পলাতক। হারিছ চৌধুরী মারা গেছেন বলে তার পরিবার দাবি করলেও তা এখনও অমীমাংসিত। বাবর, পিন্টু, আরিফ কারাগারে রয়েছেন।
দণ্ডিত ৮ পুলিশ কর্মকর্তা
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে গ্রেনেড হামলার তদন্ত ভিন্ন খাতে নিতে ‘জজ মিয়া নাটক’ সাজানোর ঘটনা ছিল আলোচিত। সেই কারণে ওই সময়কার তদন্ত কর্মকর্তারাসহ পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা হয়েছিলেন দণ্ডিত।
কর্তব্যকাজে অবহেলার পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সমাবেশের নিরাপত্তা দেওয়ার ব্যর্থতার অভিযোগ ওঠে। হামলাকারী জঙ্গিদের নির্বিঘ্নে পালিয়ে যেতে সহায়তার অভিযোগও আসে তাদের বিরুদ্ধে।
পুলিশের দণ্ডিত আট কর্মকর্তা হলেন- সাবেক আইজিপি খোদা বকশ চৌধুরী, সাবেক আইজিপি শহুদুল হক, সাবেক আইজিপি আশরাফুল হুদা, সাবেক উপকমিশনার ওবায়দুর রহমান খান, সাবেক উপকমিশনার খান সাঈদ হাসান, সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সিআইডির জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার মুন্সি আতিকুর রহমান ও সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার আবদুর রশীদ।
সাবেক তিন আইজিপির মধ্যে খোদা বকশ চৌধুরীর ৩ বছর কারাদণ্ড এবং শহুদুল হক ও আশরাফুল হুদার ২ বছর কারাদণ্ড হয়। ওবায়দুর রহমান, খান সাঈদ হাসানের ২ বছর, রুহুল আমিন, আতিকর রহমান ও আবদুর রশীদের ৩ বছর কারাদণ্ড হয়।
এই মামলায় দণ্ড খেটে মুক্তি পাওয়া খোদা বকশ বর্তমানে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টার বিশেষ সহকারীর দায়িত্বে রয়েছেন।
দণ্ডিত সামরিক বাহিনীর ৫ কর্মকর্তা
সামরিক বাহিনীর দণ্ডিত কর্মকর্তারা হলেন- ডিজিএফআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক আবদুর রহীম, ডিজিএফআইয়ের সাবেক পরিচালক এ টি এম আমিন আহমদ, ডিজিএফআইয়ের সাবেক কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার এবং খালেদা জিয়ার ভাগ্নে অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কমান্ডার সাইফুল ইসলাম ডিউক।
তাদের মধ্যে দুজনের বিরুদ্ধে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র ও আদালতের অনুমতি ছাড়া মামলার আলামত ধ্বংস করার অভিযোগ আনা হয়। আর বাকি তিনজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আসামিদের পালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সহায়তার অভিযোগ আনা হয়।
বিচারিক আদালত রেজ্জাকুল ও আবদুর রহীমকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। আর আমিন আহমদ, সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার ও সাইফুল ইসলাম ডিউককে ২ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
দণ্ডিত ২৯ জঙ্গি
পাঁচটি জঙ্গি সংগঠনের ৩১ জনের বিরুদ্ধে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে ২৪ জনকে হত্যার অভিযোগ আনা হয়। পাঁচটি জঙ্গি সংগঠন হলো হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ (হুজি), লস্কর-ই-তাইয়েবা, হিযবুল মুজাহিদীন, তেহরিক-জিহাদি আল ইসলাম এবং রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন।
হামলার প্রধান পরিকল্পনাকারী হিসাবে ছিলেন হুজির শীর্ষ নেতা মুফতি হান্নান এবং একই সংগঠনের নেতা মাওলানা তাজউদ্দীন। তিনি সাবেক উপমন্ত্রী সালাম পিন্টুর ভাই।
বিচারিক আদালতে ২৯ জঙ্গির মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। এদের মধ্যে ১৪ জনের মৃত্যুদণ্ড ও ১৫ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। ওই আদালতের রায় হওয়ার আগেই অন্য মামলায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ায় মুফতি হান্নান ও জেএমবি সদস্য শহিদুল আলম বিপুলের নাম বাদ দেওয়া হয়।
মৃত্যুদণ্ড ১৪ জঙ্গির: মাওলানা তাজউদ্দীন, মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে ডা. জাফর, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, মো. জাহাঙ্গীর আলম, হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, হোসাইন আহমেদ তামিম, মাইনুদ্দিন শেখ ওরফে আবু জান্দাল, রফিকুল ইসলাম ওরফে খালিদ সাইফুল্লাহ, মো. উজ্জ্বল ওরফে রতন, কাশ্মিরী নাগরিক আবদুল মাজেদ ভাট, আব্দুল মালেক ওরফে গোলাম মোহাম্মদ ওরফে জিএম, মাওলানা শেখ আবদুস সালাম, মাওলানা শওকত ওসমান ওরফে ফরিদ ও মুফতি হান্নানের ভাই মুহিবুল্লাহ মফিজুর রহমান ওরফে অভি।
যাবজ্জীবন ১৫ জঙ্গির: শাহদাত উল্লাহ ওরফে জুয়েল, মাওলানা আবদুর রউফ ওরফে পীর সাহেব, মাওলানা আব্দুল হান্নান ওরফে সাব্বির, আরিফ হাসান সুমন, জাহাঙ্গীর আলম বদর, হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, আবু বকর ওরফে সেলিম হাওলাদার, মুফতি শফিকুর রহমান, মহিবুল মোত্তাকিন, আনিসুল মোরসালিন, মো. খলিল, মো. ইকবাল, লিটন ওরফে মাওলানা লিটন, মুফতি আবদুল হাই ও বাবু ওরফে রাতুল বাবু।