Beta
বুধবার, ৩ জুলাই, ২০২৪
Beta
বুধবার, ৩ জুলাই, ২০২৪

কক্সবাজার হাসপাতাল এখন চলবে কীভাবে

রবিবার বিশ্বব্যাংকের প্রকল্প শেষে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসাসেবায় বিপর্যয় নেমে আসতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
রবিবার বিশ্বব্যাংকের প্রকল্প শেষে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসাসেবায় বিপর্যয় নেমে আসতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
Picture of আঞ্চলিক প্রতিবেদক, কক্সবাজার

আঞ্চলিক প্রতিবেদক, কক্সবাজার

রোগীদের সন্তোষজনক সেবা প্রদান, অতিরিক্ত রোগীর চাপ সামলানো, জরুরি বিভাগে চিকিৎসা সেবার উন্নত মানসহ আটটি মানদণ্ডে ২০২২ সালে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালকে সারাদেশের মডেল হাসপাতাল ঘোষণা দিয়েছিল সরকার।

স্থানীয়দের পাশাপাশি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের চিকিৎসা সেবা দিতে হাসপাতালটির ওপর যে বাড়তি চাপ পড়েছিল, তা মোকাবেলা করা সম্ভবপর হয় অতিরিক্ত জনবলের কারণে। এই অতিরিক্ত জনবল নিয়োগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বিশ্ব ব্যাংক।

সংস্থাটির অর্থায়নে একটি প্রকল্পের অধীনে দেশি-বিদেশি কয়েকটি এনজিওর মাধ্যমে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে অতিরিক্ত রোগীর চিকিৎসা সেবা নির্বিঘ্ন করতে চিকিৎসকসহ ১৯৯ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।

৩০ জুন সেই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ায় এই ১৯৯ জন ব্যক্তি তাদের চাকরি হারাতে যাচ্ছেন। বিশাল এই জনবলকে সোমবার থেকে কাজে পাওয়া যাবে না বলে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে হাসপাতালটির চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্টরা। চিন্তিত জেলার মানুষও।

তাদের আশঙ্কা, জনবলে ঘাটতি দেখা দিলে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। বহির্বিভাগ ও জরুরি বিভাগে চিকিৎসা সেবায় নেমে আসবে বিপর্যয়। বন্ধ হয়ে যেতে পারে নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র (আইসিইউ), করোনারি কেয়ার ইউনিটসহ (সিসিইউ) গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিভাগ। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় দেখা দেবে সংকট।   

স্থানীয় বাসিন্দাসহ লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে চিকিৎসা সেবা দিতে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতাল আধুনিকায়নের পাশাপাশি চিকিৎসা সেবার মান উন্নয়নের প্রয়োজন পড়েছিল বলেই বিশ্ব ব্যাংকের শরণ নেওয়া হয়েছিল।

২০১৯ সালের জুলাইয়ে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে সে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব দ্য রেড ক্রস (আইসিআরসি) প্রকল্প পরিচালনার দায়িত্ব নেয়।

২০২১ সাল পর্যন্ত আইসিআরসি এই দায়িত্ব পালন করে। এরপর বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে আইওএম, ইউনিসেফ-পিএইচডি, ইউএনএফপিএ, শেড, অ্যাকশনএইড ও ইউনিসেফ-এসএএম এই ছয়টি দেশি-বিদেশি সংস্থা কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্বে থাকে।     

৩০ জুন শেষ হচ্ছে বিশ্ব ব্যাংকের প্রকল্পের মেয়াদ।

বিশ্ব ব্যাংকের এই প্রকল্পের আওতায় হাসপাতালটির সেবার পরিধি বাড়ানো হয়। জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়।

কক্সবাজার সিভিল সার্জন কার্যালয়ের দেওয়া ১ জুনের তথ্য বলছে, বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে ৬টি সংস্থার অধীনে ১৯৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে আছে আইসিইউ, সিসিইউ পরিচালনায় বিশেষজ্ঞসহ ৪৬ জন চিকিৎসক।

এছাড়া রয়েছে ১৩ জন নার্স ও মিডওয়াইফ, ১ জন বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ার, ৫ জন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, ২ জন ল্যাবরেটরি টেকনোলজিস্ট, ২ জন রেডিওলজিক টেকনোলজিস্ট, ১ জন লাইফ অপারেটর, ১ জন অ্যাম্বুলেন্স চালক, ১ জন ইলেকট্রিশিয়ান, ৩৮ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী, ১ জন ওয়ার্ড মাস্টার, ১৫ জন আনসার সদস্য, ৭ জন নিরাপত্তাকর্মী, ২০ জন ওয়ার্ড বয়, ২০ জন আয়া, ৬ জন অপারেশন থিয়েটার (ওটি) সহযোগী।

একই সঙ্গে ১ জন সিনিয়র ফার্মাসিস্ট, ২ জন ল্যাব সহকারী, ১ জন স্টোরকিপার, ১ জন ডাটা অপারেটর, ২ জন ইন্টিগ্রেটেড ম্যানেজমেন্ট অব চাইল্ডহুড ইলনেস (আইএমসিআই) বিশেষজ্ঞ, ৪ জন ক্লিনিক্যাল বিশেষজ্ঞ, ১ জন সমন্বয়কারী, ১ জন চক্ষু বিশেষজ্ঞ, ১০ জন ম্যানুয়াল ওয়ার্কার, ২ জন কেস ওর্য়াকার, ৮ জন ইডি সহযোগী, ১ জন স্যানিটারি কর্মী ও টিকেট বিভাগে ৫ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়।

অন্যদিকে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের সরকারি মঞ্জুরিকৃত ৩২৮টি পদের মধ্যে ৭৬টি পদ শূন্য রয়েছে। এর মধ্যে প্রথম শ্রেণির ৬৮টি চিকিৎসকের পদে কর্মরত এখন ৫২ জন, দ্বিতীয় শ্রেণির নার্সের ১৮০টি পদে কর্মরত ১৫৭ জন, তৃতীয় শ্রেণির ৩৬ পদে ৩১ জন এবং চতুর্থ শ্রেণির ৪৪ পদে ১২ জন কর্মরত রয়েছে।

প্রকল্পের অধীনে ১৯৯ জন চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মী সেবা দিয়ে যাওয়ায় হাসপাতালের মূল জনবলের অভাব এতদিন অনুভূত হতো না। এখন তা দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে।

কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. আশেকুর রহমান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ৩ হাজার রোগী এখানে চিকিৎসা নেন। চিকিৎসক কমে গেলে এই রোগীদের সেবা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। রবিবারের পর জরুরি বিভাগে ১৫ জন চিকিৎসকের পরিবর্তে ২ জনকে সামলাতে হবে। এটা কোনোভাবেই সম্ভব না।”

কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে আগামী দিনে চিকিৎসা সেবা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা করছেন হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মং টিং ঞো। বিষয়টি এরই মধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্টদের লিখিতভাবে জানানো হয়েছে বলে জানান তিনি।

হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য, কক্সবাজার প্রেস ক্লাবের সভাপতি আবু তাহের সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে নিয়োগকৃত জনবল দিয়ে হাসপাতালে আন্তর্জাতিক মানের জরুরি বিভাগের চিকিৎসা সেবা, ওষুধ প্রদান, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, নিবিড় শিশুস্বাস্থ্য পরিচর্যা কেন্দ্র, আইসিইউ, সিসিইউ ও ২৪ ঘণ্টার প্যাথোলজি ব্যবস্থা আছে।

“এসব কারণেই এটি মডেল হাসপাতাল। জনবল না থাকলে তা রক্ষা করা যাবে না। দ্রুত সময়ের মধ্যে এটি রক্ষার উদ্যোগ নিতে হবে। নয়তো স্থানীয় বাসিন্দা ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর চিকিৎসাসেবায় চরম বিপর্যয় নেমে আসবে।”

একই আশঙ্কা প্রকাশ করেন কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মো. মাহাবুবুর রহমান। তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ চালুর দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও এই প্রতিষ্ঠানের কোনও হাসপাতাল আজ পর্যন্ত চালু হয়নি। এটি চালুর কাজ চলছে।

“সদর হাসপাতাল এখন জেলার সর্বোচ্চ চিকিৎসা সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান। এর ওপর জেলার মানুষ, রোহিঙ্গারা নির্ভরশীল। এটি রক্ষায় দ্রুততম সময়ের মধ্যে উদ্যোগ না নিলে চিকিৎসা সেবা বেহাল হয়ে পড়বে।”

রোহিঙ্গাদের জন্য বরাদ্দ অর্থের ২৫ শতাংশ স্থানীয়দের জন্য। সেই অর্থে হাসপাতালে জনবল নিয়োগের প্রসঙ্গে পৌরসভার মেয়র মাহাবুবুর রহমান বলেন, “রোহিঙ্গাদের জন্য অর্থ বরাদ্দ আছে। আরও আসছে। সেক্ষেত্রে হাসপাতালের প্রকল্প বন্ধ হওয়ার কারণ কী, তা পরিষ্কার নয়।

“হাসপাতালে স্থানীয় বাসিন্দা ও রোহিঙ্গারা ছাড়াও বিভিন্ন সংস্থায় কর্মরত দেশি-বিদেশি কর্মকর্তারা চিকিৎসা নেন। হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে দেওয়া যাবে না। এটি রক্ষা নাগরিকদের দায়িত্ব।”

ডা. মং টিং ঞো বলেন, বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আলোচনা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিষ্ঠান আইএসও-এর অধীনে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদায়ন করার আলোচনা চলছে।

তবে তা হতেও কমপক্ষে দুই-তিন মাস সময় লাগতে পারে। এর মধ্যে বিভিন্ন স্থান থেকে সরকারিভাবে ১৫ জন চিকিৎসক এনে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা চলছে বলে জানান হাসপাতালটির তত্ত্বাবধায়ক।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত