Beta
সোমবার, ২৭ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
সোমবার, ২৭ জানুয়ারি, ২০২৫

পরীমনির পক্ষে সরব সংস্কৃতিকর্মীরা

চিত্রনায়িকা পরীমনি।
চিত্রনায়িকা পরীমনি।
[publishpress_authors_box]

ধর্মীয় গোষ্ঠীর হুমকিতে এক অনুষ্ঠানে যেতে না পারার পরদিনই আদালত থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা- দুটি ঘটনাই পরীমনিকে নিয়ে।

দুই দিনের মধ্যে দুটি ঘটনা দুই অঙ্গনের হলেও তার মধ্যে যোগসূত্র খুঁজছেন অভিনয়শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীরা। তাদের যোগসূত্র আবিষ্কারের উপাদান হয়েছে এই চিত্রনায়িকার একটি ফেইসবুক পোস্ট।

হেফাজতে ইসলাম ও খেলাফতে মজলিশের বিরোধিতার মুখে টাঙ্গাইলে হারল্যানের শাখা উদ্বোধনে যেতে না পারার পর পরীমনি ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছিলেন ফেইসবুকে।

তিনি লিখেছিলেন, “এত চুপ করে থাকা যায় নাকি! পরাধীন মনে হচ্ছে। শিল্পীদের এত বাধা কেন আসবে? ইনসিকিউরড ফিল হচ্ছে! এমন স্বাধীন দেশে নিরাপদ নই কেন আমরা!!”

ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রতি জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নমনীয়তার ইঙ্গিত দিয়ে তিনি বলেন, “মেহজাবীন, পড়শী এর আগে এমন হেনস্থার শিকার হয়েছেন! ধর্মের দোহাই দিয়ে কি প্রমাণ করতে চলেছেন তারা!?

“এ দেশে সিনেমা-বিনোদন সব বন্ধ করে দেওয়া হোক তাহলে! তাহলে কি আমরা ধরে নেব, আমরা ইমোশনালি ব‍্যবহার হয়েছিলাম তখন! নাকি এখন হচ্ছি? কোনটা? এই দায়ভার কিন্তু আমাদের সবার নিতে হবে।”

ক্ষোভ প্রকাশের পরদিন রবিবারই ঢাকা বোট ক্লাবের সভাপতি নাসির উদ্দিন মাহমুদের করা মামলায় পরীমণির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আদেশ হয় ঢাকার আদালত থেকে।

এই নাসিরের বিরুদ্ধে ২০২১ সালে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ এনে মামলা করেছিলেন পরীমনি। তখন নাসিরও পাল্টা মামলা করেন তাকে হুমকি দেওয়া এবং বোট ক্লাবে ভাংচুরের অভিযোগ তুলে।

সেই মামলায় প্রায় চার বছর বাদে রবিবার অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ঢাকার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম মো. জুনাইদ। সেই সঙ্গে অনুপস্থিত আসামি পরীমনির বিরুদ্ধে জারি করেন গ্রেপ্তারি পরোয়ানা।

টাঙ্গাইলে পরীমনিকে বাধা দেওয়ার পর থেকে মুখ খুলতে শুরু করেন সংস্কৃতি অঙ্গনের অনেকে; গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর তাদের ক্ষোভ আরও বেড়েছে।

মহানগরখ্যাত নির্মাতা আশফাক নিপুন টাঙ্গাইলে শোরুম উদ্বোধনে স্থানীয়দের বাধাকে ‘মব’ আখ্যায়িত করে তা ঠেকাতে সরকারকে কঠোর হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

জুলাই অভ্যুত্থানের সমর্থক এই নির্মাতা রবিবার ফেইসবুকে লিখেখেন, “মবের প্রতিবাদের মুখে পরীমণির দোকান উদ্বোধন করতে না পারার ক্ষোভ উদগীরণের পরপরই তার বিরুদ্ধে দায়ের করা পুরোনো মামলায় হাজিরা দিতে না যাওয়ায় গ্রেপ্তারের আদেশ জারি বড়ই কাকতালীয়, সরকার।

“আবার সাজাপ্রাপ্ত দাগি আসামি সকলের জামিনে বের হয়ে ত্রাস সৃষ্টি করা মোটেও কাকতালীয় না। ঠিক যেমন আদিবাসীদের ওপর সভেরন্টি গ্রুপের হামলাও কাকতালীয় না, আবার নারী অভিনেতাদের তথাকথিত ‘মব’ এর প্রতিবাদের মুখে শোরুম উদ্বোধন করতে না পারাও এখন আর কাকতালীয় না।”

সরকারের উদ্দেশে আশফাক নিপুন বলেন, “কাকতালীয় বা অকাকতালীয় কোন সরকারই হইয়েন না, জনাব সরকার, কাজের সরকার হোন। ‘মব’ ঠেকান। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক করেন, জুলাই হত্যাকাণ্ডের কুশীলবদের ধরার ব্যবস্থা করেন। নাহলে আপনাদের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাওয়াও কাকতালীয় হবে না।”

পরিমনি অবিচারে শিকার হচ্ছেন দাবি করে এনিয়ে দেশের সবাইকে সরব হওয়ার আহ্বান জানান জুলাই অভ্যুত্থানের সমর্থক অভিনয়শিল্পী কাজী নওশাবা আহমেদ।

তিনি ফেইসবুকে লিখেছেন, “পরীমনি, মেহজাবিন, এরপর?!!আমরা চুপ।! শিল্প,  সংস্কৃতির একটি জাতির ধারক, এটাতে  হাত দিলে, এবং যারা হাত  দিতে সাহস দিচ্ছেন, তারা নিজেদের ধ্বংস ডেকে আনছেন! সত্তাকে বিকিয়ে বেশি দূর এগোনো যায় না, ওয়েক আপ বাংলাদেশ!”

অভিনেতা ইহতিশাম আহমেদ লিখেছেন, “পয়েন্টটা হল, আপনারা বলতেছেন, এখন নাকি আমরা কথা বলার স্বাধীনতা উপভোগ করতেছি। তাহলে স্ট্যাটাস দেওয়ার পরপরই তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলো কেন?

“ব্যাস। পয়েন্ট এটুকুই। এর বাহিরে আপনি যা কিছু বলবেন সব নাহয় আগে থেকেই মেনে নিলাম। আপনারা শুধু এই পয়েন্টটার ব্যাখ্যা দেন, যদি পারেন…”

শিল্পীদের প্রতিবাদী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে গীতিকার জাহিদ আকবর লিখেছেন, “পরীমনি অনুষ্ঠানে যেতে পারলেন না। তাকে সেখানে যেতে বাধা দেওয়া হলো। এই বাধার সংখ্যা দীর্ঘ হচ্ছে।

“শিল্পীদের সংগঠনগুলো, শিল্পীরা চুপ আছেন। নিরাপদ দুরত্বে নিজেদের রাখছেন। তাদের এই নীরবতা সামনে আরও বিপদ ডেকে আনবে।”

প্রবাসী নারীবাদী লেখক তসলিমা নাসরিনও দেশের এই বিষয়টি নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।

তিনি ফেইসবুকে লিখেছেন, “টাঙ্গাইলে পরীমণির যাত্রাভঙ্গ করা ছাড়াও পরীমণির বিরুদ্ধে কে বা কারা হত্যামামলা রুজু করেছে। পরীমণি আওয়ামী লীগের কর্মী নন, তিনি বরং হাসিনা-পতনের আন্দোলনে আর সবার মতো সমর্থন জানিয়েছিলেন। ২৪ এর স্বাধীন দেশে তার পায়ে কেন শিকল পরানো হচ্ছে, তাকে কেন মিথ্যে মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে? এর একটিই কারণ, তিনি নারী।”

তিনি আরও বলেন, “প্রতিটি নারীর পায়ে পরানো হয়ে গিয়েছে অদৃশ্য শিকল। কোথাও আর কিছু উদ্বোধন করতে কোনও নারীকে ডাকতে ভয় পাবে উদ্যোক্তারা। কোনও নারীশিল্পীকে নাচ-গানের জন্য, যাত্রা-নাটকের জন্য ডাকবে না আয়োজকরা। ডাকলেও হামলার ভয়ে নারীশিল্পীরাও মঞ্চে উঠতে ভয় পাবে।”

পরীমনিকে নিয়ে এই ঘটনাপ্রবাহ ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সমর্থকরা কাজে লাগাচ্ছে বলে অন্তর্বর্তী সরকারকে সতর্ক করেছেন উপস্থাপক আব্দুন নূর তুষার।

তিনি ফেইসবুকে লিখেছেন, “আওয়ামী লীগের আশ্রয় এখন পরীমনি। দেশের সিনেমাকে ভারতের হাতে তুলে দিয়ে জওয়ান আর ডানকি দেখানোর ব‍্যবস্থা করে – এফডিসির সমিতিতে গায়ের জোরে উত্থানরহিত বৃদ্ধ – বংশ কোটায় লীগ নেতার স্নেহধন‍্য নিপুনকে সিটে বসিয়ে আজকে কর্মহীন দেশে পরীমনিকে দোকানের ফিতা কাটতে যেতে হচ্ছে।

“আজকে প্রশ্ন করেন শাবানা-ববিতা-কবরী কোনদিন মফস্বলে দোকানের ফিতা কাটতে যেত? এখন কেন পরীকে ফিতা কাটার অতিথি হয়ে যেতে হয়? নিজেরা তো ভারতে বসে দীপিকা-কিয়ারা-ইধিকা-রাশমিকার দোল দেখছেন। নোরাটা ভালো। সে আপনাদের মতো দুবাই যায় ফিতা কাটতে।”

জুলাই অভ্যুত্থানের পর সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা দেশে ও বিদেশের অনেকেই নজরে পড়ার কথা জানিয়েছে।

এর আগে অভিনয়শিল্পী-মডেল মেহজাবিন চৌধুরী এবং কণ্ঠশিল্পী সাবরিনা পড়শী ঢাকার বাইরে দুটি প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় কেন্দ্র উদ্বোধনে বাধা পেয়েছিলেন। সর্বশেষ পরীমনি বাধার মুখে পড়লেন।

চিত্রনায়ক শাকিব খানের মালিকানাধীন কসমেটিক্স ব্যান্ড হারল্যান’র একটি শাখা হারল্যান স্টোর উদ্বোধনে পরীমনির শনিবার টাঙ্গাইলে যাওয়ার কথা ছিল।

কিন্তু হেফাজতে ইসলাম ও খেলাফতে মজলিশের বিরোধিতার মুখে অনুষ্ঠানটি বন্ধ করতে বাধ্য হন স্থানীয় হারল্যান স্টোরের মালিক ও পরিবেশক মীর মাসুদ রানা। তারপরই ক্ষোভ প্রকাশ করে ফেইসবুকে লেখেন পরীমনি।

নড়াইলের মেয়ে শামসুন্নাহার স্মৃতি এক দশক আগে পরীমনি নাম নিয়ে আসেন ঢাকাই চলচ্চিত্রে। মুক্তির আগেই দুই ডজনের বেশি চলচ্চিত্রে চুক্তিবদ্ধ হয়ে রীতিমতো শোর ফেলে দিয়েছিলেন তিনি।

পরীমনি, পরীমণি, ঢালিউড, চিত্রনায়িকা
পরীমনির এই ছবি অভিনেত্রীর ফেইসবুক পেইজ থেকে নেওয়া।

২০২১ সালের ১৩ জুন আকস্মিক এক সংবাদ সম্মেলনে রীতিমতো বোমা ফাটানো সংবাদ দিয়ে হৈ চৈ ফেলে দিন এই চিত্রনায়িকা।

তিনি অভিযোগ করেন, তার পাঁচ দিন আগে ৮ জুন তুরাগ নদীর তীরের ঢাকা বোট ক্লাবে গিয়ে ধর্ষণচেষ্টার শিকার হন তিনি। তার অভিযোগ ছিল, বোট ক্লাবের কার্যনির্বাহী কমিটির তখনকার সদস্য ব্যবসায়ী নাসিরের বিরুদ্ধে।

 পরদিন পরীমনি মামলা করলে নাসিরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তবে নাসির ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ অস্বীকার করে পাল্টা মামলা করেন পরীমনির বিরুদ্ধে।

এর মধ্যে ওই বছরের ৪ আগস্ট ঢাকার বনানীর ১২ নম্বর সড়কে পরীমনির বাসায় অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মদ, আইস ও এলএসডি উদ্ধারের কথা জানায় র‌্যাব।

সেদিন মাদকের মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় পরীমনিকে। দুই দফায় রিমান্ডে নিয়েও তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এক মাস পর জামিনে মুক্তি পান তিনি।

পরীমনির মামলায় নাসিরের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি এখনও চললেও তার আগেই নাসিরের করা মামলায় পরীমনির বিচার শুরুর আদেশ হলো। এই মামলায় দোষি সাব্যস্ত হলে এই চিত্রনায়িকার সর্বোচ্চ ৩ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে।

গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর পরীমনি বলেছেন, তার দুবার আদালতে যাওয়ার কথা থাকলেও বেশ কিছু কারণে তিনি যেতে পারেননি।

পরীমণির কথায়, “আমি আজ আদালতে যেতে পারিনি। এর আগেও একবার যেতে পারিনি, সেবার আমার মৃত নানুর একটা বিষয় ছিল। এবার আমার অসুস্থতার কারণে। আমার আইনজীবীকে তা জানিয়েছি। শরীর অসুস্থ থাকলে তো কিছুই করার নেই।”

তবে একে ‘বিব্রতকর ও উটকো ঝামেলা’ আখ্যায়িত করে পরীমণি বলেন, “এখানে ভয়ের কিছু নেই। আমি আইনিভাবে মোকাবেলা করব। জামিনের জন্য আবেদন করবেন আমার আইনজীবী।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত