রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বিক্ষোভের মুখে শিল্পকলা একাডেমিতে নাটক বন্ধ করার ঘটনায় ক্ষোভে ফুঁসছে সংস্কৃতি অঙ্গন। সোশাল মিডিয়ার সমালোচনা বিক্ষোভেও গড়িয়েছে।
সোমবার শিল্পকলা একাডেমির সামনে নাট্যকর্মীদের এক বিক্ষোভ থেকে এই ঘটনায় তৃতীয় পক্ষের কোনও ইন্ধন রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখার আহ্বানও জানানো হয়।
এই প্রেক্ষাপটে পুরো ঘটনার তদন্ত করে দেখার কথা জানিয়েছে শিল্পকলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ। সেই সঙ্গে নাটকের মধ্যে ‘স্বৈরাচারের দোসর’ কেউ থাকলে তার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দলকেই ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শিল্পকলা একাডেমির নেতৃত্বও যায় বদলে। প্রায় দেড় দশক ধরে মহাপরিচালকের দায়িত্বে থাকা লিয়াকত আলী লাকীকে সরিয়ে সেই দায়িত্বে সৈয়দ জামিল আহমেদকে আনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
এরপর গত শনিবার শিল্পকলার জাতীয় নাট্যশালায় দেশ নাটকের নাটক ‘নিত্যপুরাণ’ মঞ্চায়নের সময় এক দল ব্যক্তি বিক্ষোভ শুরু করে একাডেমির ফটকে।
বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে নাটকের দলটির সদস্য এহসানুল এজাজ বাবুর একটি ফেইসবুক পোস্টের প্রতিবাদে তারা নাটক বন্ধের হুমকি দেয়। এরপর নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে শিল্পকলার মহাপরিচালক সৈয়দ জামিল আহমেদ নিত্যপুরাণ এর প্রদর্শনী বন্ধ করে দেন।
তার প্রতিবাদে সোমবার বিকালে ‘বিক্ষুব্ধ থিয়েটারকর্মীগণ’ ব্যানারে শিল্পকলা একাডেমির প্রাঙ্গণে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে নাট্যকর্মীরা।
একাডেমির মূল মূল ফটকের সামনে অবস্থান নেয় তারা। উপস্থিত সাংবাদিকদের উদ্দেশে নিজেদের লিখিত বক্তব্য তারা পড়ে শোনায়।
দেশ নাটকের দলপ্রধান নাট্যকার মাসুম রেজা, অভিনেতা আজাদ আবুল কালাম, নাজনিন চুমকী, মোহাম্মদ আলী হায়দার সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
তারা পাঁচটি দাবি তুলে ধরেন। তার মধ্যে রয়েছে- দেশ নাটকের বন্ধ প্রদর্শনী সাতদিনের মধ্যে ফেরত দিতে হবে, সেই প্রদর্শনী নির্বিঘ্ন করতে নাট্যকর্মীরাই পাহারা দেবে; শিল্পকলায় আমলানির্ভরতা কমাতে হবে; প্রদর্শনী বরাদ্দে স্বজনপ্রীতি বন্ধ করতে হবে; সাধারণ নাট্যকর্মী, দর্শক, নাগরিকদের জন্য শিল্পকলাকে উন্মুক্ত করে দিতে হবে; শিল্পকলা থেকে সেনাসদস্যদের সাতদিনের মধ্যে সরিয়ে নিতে হবে।
লিখিত বক্তব্যে নাট্যকর্মী আলী হায়দার বলেন, শিল্পকলায় নাটক বন্ধের ঘটনা বাংলাদেশের নাট্যচর্চার ইতিহাসে এক করুণতম দৃষ্টান্ত।
লিখিত বক্তব্যে দেশ নাটকের কর্মী এহসানুল এজাজ বাবুর ফেইসবুক পোস্টটির সমালোচনা করেই বলা হয়, কিন্তু কোনও একক ব্যক্তির জন্য নাটক বন্ধের দাবি তোলা কখনোই কাম্য নয়।
কারও দাবিতে নাটক বন্ধ করে দিয়ে শিল্পকলা কর্তৃপক্ষও দায়িত্বহীন আচরণ করেছে বলে মনে করেন নাট্যকর্মীরা।
“কারণ শিল্পকলার প্রত্যেকের দায় আছে যেকোনও মূল্যে প্রদর্শনীরত দলকে নাটক শেষ করা পর্যন্ত নিরাপত্তা দেওয়া। সে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হওয়া শিল্পকলার দায়, মহাপরিচালক যে দায় নিজের মাথা পেতে নিয়েছেন, যা তার দায়িত্বশীলতাকে আরও মহিমান্বিত করতে পারত, যদি এই সংগঠিত হিংস্র আচরণকে শিল্পকলা ঠেকাতে পারত।”
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে হায়দার আলী বলেন, “আগের আমলে যেমন কিছু হলেই শেখ হাসিনা এবং সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়ে যাবার ‘অপরাধে’ মানুষকে শাস্তি দেওয়া হতো, সে প্রথার পুনরাবৃত্তি আমরা চাই না।”
নাট্যকর্মীরা বলেন, আওয়ামী লীগ আমলে বিভিন্ন দলের বিভিন্ন মানুষের ফেইসবুক স্ট্যাটাসের জেরে তার দলকে ‘রাজাকার ট্যাগ’ দিয়ে নানাভাবে হেনস্থা এবং নিপীড়ন করা হয়েছে। সেই একই চর্চা নতুন বাংলাদেশে চালু হওয়ার সুযোগ নেই।
একজন ব্যক্তির ফেইসবুক পোস্ট ধরে ব্যানার তৈরি করে সংগঠিত বিক্ষোভের পেছনে তৃতীয় কোনও পক্ষের ইন্ধন রয়েছে কি না, সেই সন্দেহও রয়েছে অনেক নাট্যকর্মীর। তারা বলছেন, সৈয়দ জামিল আহমেদকে বিপদে ফেলতে পরিকল্পিতভাবে এটা করা হয়ে থাকতে পারে।
আলী হায়দার বলেন, “দেশ নাটকের আলোচ্য সদস্যের নাট্যাঙ্গনের বাইরে তেমন পরিচিতিই নেই। মানে একজনের পোস্ট নিয়ে এতবড় মব সংগঠিত করা কেবল বাইরের লোকের পক্ষে সম্ভব না।
“আর সেনাবাহিনীর কারণে যেহেতু সাধারণ নাট্যকর্মীদের প্রবেশাধিকার শিল্পকলায় সীমিত, কাজেই এই পুরো ঘটনায় পতিত প্রশাসনের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়েও এখনও টিকে থাকা কোনও গ্রুপ বা নতুন করে ক্ষমতায় যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কাজ করা অন্য কোনও অংশের ভূমিকা থাকার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।”
নাট্যকর্মীদের বিক্ষোভের আগেই শিল্পকলা একাডেমিতে থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে নাটক বন্ধের ঘটনায় দুঃখপ্রকাশ করা হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সর্বাবস্থায় জনগণের, শিল্পচর্চার ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিশ্বাস করে। এজন্য বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি উক্ত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে কাজ করছে।”
এর পাশাপাশি নাট্যদলগুলোর উদ্দেশে বলা হয়, “শিল্পকলা একাডেমি মনে করে, জুলাই বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশে কোনও ব্যক্তির কারণে নাটকের দল যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে প্রচেষ্টা সাংস্কৃতিক সংগঠন বা নাটকের দলের থাকা উচিৎ।
“কোনও দলের ভেতরে বিতর্কিত কেউ যদি থাকে, যারা জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে অস্বীকার করে এবং স্বৈরাচারীর দোসর হয়ে ফ্যাসিস্ট সরকারের কার্যক্রমকে এখনও সমর্থন করে, তাহলে দলের পক্ষ থেকেই তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
শিল্পকলার এমন আহ্বানের প্রতিক্রিয়াও জানানো হয় নাট্যকর্মীদের বিক্ষোভ থেকে।
আলী হায়দার বলেন, “নাটকের দল একটি যৌথ প্রতিষ্ঠান। সাধারণত সেখানে সব রাজনৈতিক দল-মত ও আদর্শের মানূষের সহবস্থান থাকে। শিল্পচর্চায় এসব খুব বড় বাধা নয়, বরং এ সহাবস্থান আর সহিষ্ণুতার চর্চাই থিয়েটারের মূল শক্তি।”