Beta
মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪

দরবেশ কারাগারে, তবে পুঁজিবাজারে কার আছর

আবদুর রহিম হারমাছি। প্রতিকৃতি অঙ্কন: মোতাসিম বিল্লাহ পিন্টু।

সফেদ দাড়ির সঙ্গে সফেদ পাজামা-পাঞ্জাবি, সেই এক ‘দরবেশ’; পুঁজিবাজার নিয়ে কথা উঠলেই সবার মুখে আসে তার নাম। এই নামের ‘গুণে’ কতজনের কত কী যে হয়েছে! পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান কে হবেন, কোন কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান বাজারে আসবে, দুই স্টক একচেঞ্জ (ডিএসই ও সিএসই) কারা পরিচালনা করবে, সবই ঠিক হতো এই নামের ‘আধ্যাত্মিকতায়’!

১৯৯৬ সালের মহাধসের সময় থেকেই বাজারে উত্থান-পতন কিংবা পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে বিনিয়োগকারীদের পথে বসা কিংবা আত্মহত্যা, সব আলোচনায় চলে আসে এই নাম। আওয়ামী লীগের গত দেড় দশকের শাসনকালে এই দরবেশের দোর্দণ্ড প্রতাপ দেখেছে দেশের মানুষ।

কিন্তু ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে সেই দরবেশেরও পতনের পর বিনিয়োগকারীরা একটু হাঁফ ছেড়েছিল। কিন্তু বাজার পরিস্থিতি শঙ্কা জাগাচ্ছে, এক দরবেশ গিয়ে আবার কি অন্য কোনও দরবেশ আসছে? নাকি দরবেশের আছর রয়ে গেছে?

এতক্ষণ যে দরবেশের কথা বলছি, তার নাম বলাই বাহুল্য। সালমান এফ রহমান— বনেদী পরিবারের জাঁকালো এই নাম আড়াল করে দিয়েছে দরবেশ নামটি। তিন দশক আগে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়ে গভর্নরকে হুমকি দিয়ে এসে ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছিলেন সালমান রহমান। তখনই পুঁজিবাজার কেলেঙ্কারিতে এসেছিল তার নাম। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টার পদ পান তিনি। বাড়ে তার ‘দরবেশী ক্ষমতা’, আর তা ছড়িয়ে পড়ে দেশের গোটা আর্থিক ব্যবস্থায়।

এই দরবেশ নামটি তাকে প্রথম কে দিয়েছিল, তা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তবে সাংবাদিক মুন্নী সাহা তার এক টকশোতে সালমান রহমানকে অতিথি করেছিলেন। সেখানে মুন্নী সাহা এক পর্যায়ে বলেছিলেন, ‘‘আপনাকে সবাই দরবেশ কেন বলে?” তারপর থেকে নামটি সালমান রহমানের নামের সঙ্গে আরও গেঁথে যায়।

এখানে বলে রাখা ভালো, পুঁজিবাজারের সঙ্গে ব্যাংক খাতকেও গত দেড় দশকে দেখতে হয়েছে ‘দরবেশের কেরামতি’। সে নিয়ে না হয় আরেকদিন আলাপ করা যাবে। আজ পুঁজিবাজারেই থাকি।

সাংবাদিক মুন্নী সাহা তার এক টকশোতে সালমান রহমানকে অতিথি করেছিলেন। সেখানে মুন্নী সাহা এক পর্যায়ে বলেছিলেন, ‘‘আপনাকে সবাই দরবেশ কেন বলে?” তারপর থেকে নামটি সালমান রহমানের নামের সঙ্গে আরও গেঁথে যায়।

১৯৯৩ সাল থেকে ৩১ বছরে পুঁজিবাজারে এমন কোনও কেলেঙ্কারি নেই, যেখানে সালমান রহমানের সংযোগ ছিল না। বলা হয়, কারসাজির নিত্যনতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেন তিনি। আর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার চরম অপব্যবহার করে সব সময়ই থেকেছেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।

১৯৯৬ সালে শাইনপুকুর সিরামিক ও দোহা সিকিউরিটিজের কেলেঙ্কারিতে নাম আসে সালমান রহমানের। সেই মামলায় এখনও আসামি তিনি। মামলাটি উচ্চ আদালতে চলমান। তার কয়েক বছর পর সৌদি যুবরাজের রূপালী ব্যাংকের শেয়ার কেনার নাটক সাজিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটির শেয়ার থেকে ৯০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।

গত তিন বছরে পুঁজিবাজার থেকে ৬ হাজার ৬০০ কোটি টাকা প্রকাশ্যেই নিয়েছেন তিনি। এর মধ্যে বেক্সিমকো সুকুক বন্ড ৩ হাজার কোটি টাকার, আইএফআইসি আমার বন্ড ১ হাজার কোটি টাকার এবং বেক্সিমকো জিরো কুপন বন্ড ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকার।

পুঁজিবাজারে কারসাজি নিয়ে ২০১১ সালে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের তদন্ত প্রতিবেদনেও এসেছিল সালমান রহমানের নাম। ওই সময় প্রভাব খাটিয়ে বেক্সিমকো ফার্মার প্রেফারেন্স শেয়ার পাস করিয়ে নেন তিনি। এ শেয়ারের মাধ্যমে প্রিমিয়ামসহ ৪১০ কোটি টাকা সংগ্রহ করেন। একই সময়ে শাইনপুকুর সিরামিকের মাধ্যমে ২৮৬ কোটি এবং বেক্সিমকো টেক্সটাইলের মাধ্যমে ৬৩৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করেন। এছাড়া জিএমজি এয়ারলাইন্সের প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রি করে ৩০০ কোটি টাকা তিনি তুলে নেন। পরে ওই কোম্পানি উধাও হয়ে যায়। কিন্তু বিনিয়োগকারীদের আর টাকা ফেরত দেননি। আবার জিএমজি এয়ারলাইন্সের নামে সোনালী ব্যাংক থেকে ২২৮ কোটি ঋণ নেন তিনি।

গত তিন বছরে পুঁজিবাজার থেকে ৬ হাজার ৬০০ কোটি টাকা প্রকাশ্যেই নিয়েছেন তিনি। এর মধ্যে বেক্সিমকো সুকুক বন্ড ৩ হাজার কোটি টাকার, আইএফআইসি আমার বন্ড ১ হাজার কোটি টাকার এবং বেক্সিমকো জিরো কুপন বন্ড ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকার।

পুঁজিবাজারে দরবেশের সঙ্গে তার ‘মুরীদ’ হিসাবে চৌধুরী নাফিজ সরাফাতও ছিলেন আলোচনায়। অচেনা নাফিজ ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর হয়ে ওঠেন প্রভাবশালী। নাফিজ সরাফাত চেয়েছেন, কিন্তু হয়নি, পুঁজিবাজারে এমন ঘটনা ঘটেনি ১৫ বছরে। শেখ হাসিনা সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির পর থেকে লাপাত্তা গোপালগঞ্জের নাফিজ। আর ‘রুই-কাতলাদের’ মধ্যে প্রথম ধরা পড়ে ‘দরবেশ’ও এখন আছেন বেশ বিপদে। আড়াই মাস ধরে কারাগারে, কয়েক দফা রিমান্ডেও নেয় পুলিশ।

এদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তিন মাস হতে চলেছে। কিন্তু কোনও সুখবর নেই পুঁজিবাজারে, নেই আশার কোনও আলোও। টানা পতন হচ্ছে; লেনদেন শুরু হলেই পড়ছে সূচক।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে পুঁজিবাজার ভালো যায় না— দীর্ঘদিন ধরে এমন প্রচার ছিল বাজারে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালে বড় পতন হয় বাজারে। টানা ধসে সে সময় বেশ কিছুদিন পুঁজিবাজারে লেনদেন বন্ধ ছিল। এর পর উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গেছে বাজার। কিন্তু কখনোই বাজার স্থিতিশীল-স্বাভাবিক হয়নি; অস্থিরতা, বিনিয়োগকারীদের ক্ষোভ হতাশার মধ্য দিয়েই গেছে বাজার। এরই মধ্যে ২০২০ সালে আরেকটি ধস দেখা দেয় বাজারে। সেই মন্দা শেখ হাসিনা পদত্যাগের আগের দিন পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।

পুঁজিবাজারে দরবেশের সঙ্গে তার ‘মুরীদ’ হিসাবে চৌধুরী নাফিজ সরাফাতও ছিলেন আলোচনায়। অচেনা নাফিজ ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর হয়ে ওঠেন প্রভাবশালী। নাফিজ সরাফাত চেয়েছেন, কিন্তু হয়নি, পুঁজিবাজারে এমন ঘটনা ঘটেনি ১৫ বছরে।

গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর কিছুদিন শেয়ারবাজারে সূচকের উল্লম্ফন হলেও একপর্যায়ে দরপতন শুরু হয়। সেই ধারা চলছে তো চলছেই। এর মধ্যে বিএসইসিতে নতুন প্রশাসন কাজ শুরু করেছে, কিন্তু পরিস্থিতির উন্নয়ন হয়নি; উল্টো দিন যত যাচ্ছে, বাজার ততই খরাপের দিকে যাচ্ছে।

টানা পতনের প্রতিবাদে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি ভবনের সামনে কয়েকদিন বিক্ষোভ-মানববন্ধন করেছেন ছোট বিনিয়োগকারীরা; প্রধান উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন। কিন্তু বাজার ইতিবাচক ধারায় ফিরছে না; পতন থামছেই না। সবশেষ গত সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস বৃহস্পতিবারও দেশের দুই পুঁজিবাজারে বড় ধরনের দরপতন হয়েছে। ভালো ভালো কোম্পানির শেয়ারের দর হারানোর ফলে এই দরপতন হয়।

চলতি সপ্তাহের প্রথম দিন রবিবারও বড় ধস দেখা গেছে বাজারে। দেশের প্রধান বাজার ডিএসইতে প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৫০০০ পয়েন্টের নিচে নেমে এসেছে। এদিন সাড়ে তিন বছরে মধ্যে সর্বোচ্চ দরপতন হয়েছে। বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ার দর হারানোয় ডিএসইএক্স ১৪৯ দশমিক ২০ পয়েন্ট হারিয়ে ৪ হাজার ৯৬৫ দশমিক ৩৯ পয়েন্টে নেমেছে।

এই সূচক প্রায় চার বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। ২০২০ সালের ২ ডিসেম্বর ডিএসইএক্স পড়তে পড়তে ৪ হাজার ৯৩৪ দশমিক ৮৬ পয়েন্টে নেমে এসেছিল।

চট্টগ্রাম স্টক একচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক সূচক প্রায় ৩০০ পয়েন্ট কমে ১৪ হাজার পয়েন্টে নেমে এসেছে। শতাংশ হিসাবে এই সূচক কমেছে ২ দশমিক শূন্য সাত শতাংশ।

টানা দরপতনের কারণে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আস্থাহীনতায় ভুগছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। এর ফলে বাজারে ক্রেতার সংকট দেখা দিয়েছে। তার বিপরীতে প্রতিদিনই ঋণগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের একটি বড় অংশের শেয়ার জোরপূর্বক বিক্রি বা ফোর্সড সেলের আওতায় পড়ছে। বাজার যত নিচে নামছে, ফোর্সড সেলের চাপও তত বাড়ছে।

শেয়ারের দাম নির্দিষ্ট একটি সীমার নিচে নেমে গেলে ঋণ সমন্বয়ের জন্য ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো শেয়ার বিক্রি করে দেয়। পুঁজিবাজারে এটি ফোর্সড সেল হিসেবে পরিচিত। এদিকে বাজারে ক্রেতার চেয়ে বিক্রেতা বেশি হওয়ায় দরপতনের পাশাপাশি লেনদেনের পরিমাণও কমছে।

বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) যে প্রবৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের যে চেহারা, তার সঙ্গে কখনোই পুঁজিবাজারের কোনও মিল পাওয়া যায়নি।

ব্যাংকিং খাতে উচ্চ সুদের হার, মার্জিন ঋণের বিপরীতে কেনা শেয়ার বিক্রি এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে যাওয়ায় বাজারে অব্যাহত দরপতন হচ্ছে।

বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) যে প্রবৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের যে চেহারা, তার সঙ্গে কখনোই পুঁজিবাজারের কোনও মিল পাওয়া যায়নি। বিদায়ী সরকারের পক্ষ থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা (বিএসইসি) নানা উদ্যোগ নিয়েও বাজার ভালো করতে পারেনি।

সবাই আশা করেছিলেন, নোবেলবিজয়ী ড. ইউনূস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হওয়ার পর পুঁজিবাজার ভালো হবে। কিন্তু শুরুর বুদবুদ হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে কয়েকদিনেই। কয়েকদিন ডিএসইতে লেনদেন ২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। সেই লেনদেন এখন ৩০০ কোটি টাকায় নেমে এসেছে।

তাই প্রশ্ন উঠছে, দরবেশ কারাগারে, নাফিজও উধাও। তারপরও পুঁজিবাজার কেন বেহাল?

অন্য কানাঘুষাও শোনা যাচ্ছে। পুঁজিবাজারে নাকি নতুন ‘দরবেশ’ এর আগমন ঘটেছে। তবে কে সেই নতুন ‘দরবেশ’ সেই নাম জানা যায়নি। দুই-তিন জনের নাম বলাবলি হচ্ছে। তারাই নাকি চালাচ্ছেন এখন পুঁজিবাজার। তাহলে কি বাংলাদেশের পুঁজিবাজার কখনই ‘দরবেশ’মুক্ত হবে না? বাজার তার স্বাভাবিক গতিতে ফিরবে না? লাখ লাখ বিনিয়োগকারীর মধ্যে স্বস্তি ফিরবে না?

লেখক: সাংবাদিক, সকাল সন্ধ্যা।
ইমেইল: [email protected]

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত