বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান দুরবস্থার কারণ খুঁজতে নেমে এক গোলকধাঁধায় পড়েছেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
‘অনাচারী অর্থনীতি’ থেকে ‘স্বেচ্ছাচারী রাজনীতি’, নাকি ‘স্বেচ্ছাচারী রাজনীতি’ থেকে ‘অনাচারী অর্থনীতি’র সৃষ্টি হয়েছে, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন তিনি।
বৃহস্পতিবার ঢাকায় পরিকল্পনা কমিশন মিলনায়তনে ইকোনোমিক রিপোর্টার্স ফোরামের সদস্যদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক মতবিনিময় সভায় এ প্রশ্ন তোলেন অর্থনীতির অবস্থা নিয়ে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান দেবপ্রিয়।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত অগাস্টে শেখ হাসিনার দেড় দশকের শাসন অবসানের পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করে।
আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদী শাসনকালে ব্যাপক দুর্নীতি, বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের প্রান্তে নিয়ে গেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
আওয়ামী লীগ কোন অবস্থায় দেশকে রেখে গেছে, সেই চিত্র তুলে ধরার দায়িত্ব নেওয়া দেবপ্রিয় এমন এক প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার কথা তুললেন, যার এক ব্যাখ্যা কার্ল মার্কস দিয়ে গেছেন, আর তার দর্শনের ওপর প্রতিষ্ঠিত সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়াশোনা করে এসেছেন দেবপ্রিয়।
পৃথিবীর ইতিহাসকে শ্রেণী সংগ্রামের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে ব্যাখ্যা করে আসা কার্ল মার্কসের মতে, কোনও সমাজের রাজনীতি হলো অর্থনীতির ঘনীভূত রূপ।
১৯১৭ সালে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্যদিয়ে গঠিত হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। আর সেই দেশের মস্কোর প্লেখানভ ইনস্টিটিউট অব ন্যাশনাল ইকোনমিতে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করার পর পিএইচডি ডিগ্রি নেন দেবপ্রিয়।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় বৃহস্পতিবারের অনুষ্ঠানে গত দেড় দশকে অবকাঠামো, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে ঘটে যাওয়া অনিয়ম প্রসঙ্গ তুলে ধরতে গিয়ে রাজনৈতিক দৃর্বৃত্তায়নের কথাও বলেন।
“অর্থনীতির বিভিন্ন সূচককে সাজানো তথ্যের ভিত্তিতে উন্নয়ন সাধনের জন্য বাহবা নেওয়ার চেষ্টা চলে। এর মধ্যে দিয়ে ভোট জালিয়াতির পরও সরকার বৈধতা নেওয়ার চেষ্টা করে।”
ব্যাংক, জ্বালানি ও মেগা প্রকল্পে নানা অনিয়মের বিষয়গুলো ধরে তিনি বলেন, “অপ্রয়োজনে প্রকল্প নির্মাণের মধ্যে দিয়ে দলীয় লোকজনকে বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাতের সুযোগ করে দিয়েছিল সরকার। তাছাড়া তথ্যপ্রযুক্তি খাতেও অর্থ ব্যয়ে বড় ধরনের অনিয়ম বা দুর্ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া আরও কিছু খাতে অনিয়ম হয়েছে। অর্থ পাচার হয়েছে। স্থানীয় সরকারেও অনিয়ম হয়েছে।”
এরপরই তিনি বলেন, “একটা প্রশ্ন দাঁড়ায়, স্বৈরাচারী রাজনীতি বা স্বেচ্ছাচারী রাজনীতি এমন অনাচারী অর্থনীতিকে উসকে দেয়, না কি এই অনাচারী অর্থনীতির সুফল পাওয়া লোকগুলো এ ধরনের স্বেচ্ছাচারী রাজনীতি সৃষ্টি করল?”
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান দেবপ্রিয় বলেন, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাগুলোর মধ্যে স্বচ্ছতা আনার জন্য তারা অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে বড় সমস্যায় পড়েছেন তথ্য-উপাত্ত নিয়ে।
“এসব তথ্য-উপাত্ত নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। বিশেষ করে, প্রবৃদ্ধির হিসাব, মূল্যস্ফীতির হিসাব ও খানা জরিপ, এনবিআরের বিভিন্ন পরিসংখ্যান নিয়ে আমরা কাজ করেছি।”
নভেম্বরের মধ্যেই আর্থিক খাত নিয়ে শ্বেতপত্র সরকারের হাতে তুলে দেওয়ার আশা প্রকাশ করে দেবপ্রিয় বলেন, অনিয়মের পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে, সে জন্য সামগ্রিকভাবে কী কী সংস্কার দরকার, তার সুপারিশ তারা দিয়ে যাবেন।
গত ২৮ আগস্ট ১২ সদস্যের এই শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি বেশিরভাগ সদস্য ইআরএফের মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন। এর মধ্যে বক্তব্য রাখেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সন্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান, সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান, বিশ্ব ব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন।
সভায় ইআরএফের নেতারা অর্থনৈতিক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির কাছে নানা ধরনের সংস্কারের সুপারিশ তুলে ধরেন। এতে নেতৃত্ব দেন সংগঠনের সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মীরধা, সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক শওকত হোসেন মাসুম।