আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে হওয়া তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, সাইবার নিরাপত্তা আইনের মতো নিবর্তনমূলক ধারা অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ- ২০২৪ খসড়ায় অন্তর্ভুক্ত করার অভিযোগ তুলে সেগুলো প্রত্যাহারের দাবি করেছে এক আলোচনা সভার বক্তারা।
সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ (খসড়া) থেকে অজামিনযোগ্য ধারা প্রত্যাহার, পরোয়ানা ছাড়া তল্লাশি ও গ্রেপ্তার সংক্রান্ত পুলিশ ও আমলাদের ‘অসীম ক্ষমতা’ না রাখা এবং স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে মানুষ যেন আশঙ্কামুক্ত থাকে—সেসব বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছেন আলোচকরা।
শনিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) ‘সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ- ২০২৪ (খসড়া) : রাষ্ট্রীয় নিবর্তন ব্যবস্থা বহাল ও ভুক্তভোগীদের বয়ান’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তরা এসব কথা বলেন। ভয়েস ফর রিফর্ম ও ডিএসএ (ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট) ভিকটিমস নেটওয়ার্কের যৌথ উদ্যোগে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
আওয়ামী লীগ সরকারের দমন-পীড়নমূলক সাইবার নিরাপত্তা আইনটি বাতিল করে গত ২৪ ডিসেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে নতুন সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ- ২০২৪ খসড়া অনুমোদন করা হয়েছে।
খসড়া এই অধ্যাদেশের বিষয়ে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম ভয়েস ফর রিফর্মের সহ-আহ্বায়ক আলোকচিত্রী শহিদুল আলম বলেন, “যে কোনও আইনের পেছনে একটা চিন্তা আছে, সেই চিন্তাটা বুঝতে হবে। আমি আলোকচিত্রী, আমি যখন ছবি তুলি তখন কী ধরণের ছবি তুলব, সেটার ভিত্তিতে আমি লেন্স বাছাই করি। সেই লেন্সে আমি আমার বিষয়টি বলি।”
সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে ‘মানবাধিকার ও জনগণের স্বার্থে লেন্স ব্যবহার করা হয়নি’ বলেন মন্তব্য করেন শহিদুল আলম।
তিনি বলেন, “নিপীড়ন কীভাবে করা যায়, সেই লেন্স ব্যবহার করা হয়েছে। এটা মৌলিক জায়গা বলে আমি মনে করি, এটা নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে।”
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও সাইবার নিরাপত্তা আইনের মতো সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের খসড়ায় ৩৫ ধারায় পরোয়ানা ছাড়াই তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্ষমতা বহাল রাখা হয়েছে।
পুলিশসহ নিরাপত্তা বাহিনীকে এ অধ্যাদেশে অনেক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে মন্তব্য করে শহিদুল আলম বলেন, “আমাদের মনে রাখতে হবে, নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে শেখ মুজিবুর রহমান মারা গেছেন, মেজর জিয়াউর রহমান মারা গেছেন। ক্রস ফায়ার এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, নিপীড়ন, নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে হয়েছে।”
২০২৪ সালে জুলাই আন্দোলনের সময় হেলিকপ্টার থেকে গুলি করা হয়েছে, জ্যান্ত মানুষকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “যারা এই কাজগুলো করেছে, তাদেরকে আমরা ক্ষমতায়ন করার জন্য একটা আইন বানাচ্ছি, যাতে তারা নিজেদের স্বার্থের ভিত্তিতে কাজ করতে পারে।”
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের দাবিতে এসেছে এবং তারা জনগণের লেন্স দিয়ে দেখবেন বলে প্রত্যাশা আলোচচিত্রী শহিদুলের।
তিনি বলেন, “এখনও যদি ফ্যাসিবাদী লেন্স দিয়ে দেখা হয়, সেই লেন্সের মাধ্যমে যদি আইন তৈরি করা হয়, এবং সেই লেন্সের মাধ্যমে দেশ চলে, তাহলে সত্যিকার অর্থে আমরা স্বাধীন হয়নি। সেই স্বাধীনতার স্বপ্ন এখনও আমাদের আছে। সেই স্বপ্ন যদি বাস্তবায়ন করতে হয়, তাহলে আমি অনুরোধ করব তারা চশমা বদলাবেন।”
নিজের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের হওয়া মামলা এখনও চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এফআইআরে যা যা বলা আছে, তার কিছুই পাওয়া যায়নি। কারও কারও মামলা খারিজ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমি তদবির করতে যাব না। মামলার বিষয়ে জণগণের জন্য যা হবে, আমার বেলায় তাই হবে, তাই হওয়া উচিত।”
সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের খসড়ায় একটা গোঁজামিল রয়েছে মন্তব্য করে সাংবাদিক ও গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ বলেন, “এই আইনে যে সুরক্ষার কথা বলা হচ্ছে, তা কার সুরক্ষা এটা পরিস্কার না। অবশ্যই নাগরিকদের অধিকারের সুরক্ষার দরকার আছে। ইন্টারনেটে মতপ্রকাশের অধিকারসহ সব ধরনের অধিকার যেন সুরক্ষা হয়, এর গ্যারান্টি দরকার। আবার রাষ্ট্র বলতে পারে, তার সুরক্ষা দরকার, ইন্টারনেটের সুরক্ষা দরকার। কিন্তু অবকাঠামোর সেই সুরক্ষা ঠিকমতো হয়নি।”
এ অধ্যাদেশে সুরক্ষার বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে স্পষ্টকরণ বা ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি বলে উল্লেখ করে তার জন্য আইনের অপব্যবহার হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেন কামাল আহমেদ। তিনি বলেন, “এমন অপব্যবহার অতীতে হয়েছে, ভবিষতেও হবে। সুতরাং এ আইনে যেখানে যেখানে অস্পষ্টতা আছে, সেগুলোর ব্যাখ্যা এবং স্পষ্টীকরণ অত্যন্ত জরুরি।”
জনগণের মতামতের ভিত্তিতে অধ্যাদেশের খসড়া চূড়ান্ত করতে পরামর্শ দিয়ে কামাল আহমেদ বলেন, “আমি আশা করি, নাগরিক সমাজ থেকে যে উদ্বেগ তুলে ধরা হচ্ছে, তা আমলে নিয়ে আবার আলোচনার উদ্যোগ নেবে সরকার। সেই আলোচনার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় বিষয় রেখে অনুমোদন করতে হবে।”
সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে একটি এজেন্সি থাকবে এবং সেই এজেন্সি সরকারের আমলা দ্বারা পরিচালিত হওয়ার কথাও বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে সাংবাদিক কামাল বলেন, “সেই আমলাদের দক্ষতা কতটা দেখুন। এই সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ- ২০২৪ এর খসড়া আইসিটি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে নেই। এটা আছে মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে। এটা কি মাছ ও পশুদের জন্য আইন?”
আলোচনায় বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, “সাইবার সুরক্ষার বিষয়টি আগে সরকারকে বুঝতে হবে। আজকে পর্যন্ত ইউটিউব, ফেইসবুকের একটা অফিস বাংলাদেশে স্থাপন করা গেছে? কিংবা তাদের কোনও কর্মকর্তা এখানে নিয়োজিত করতে পেরেছি। এখন পর্যন্ত করা সম্ভব হয়নি।
“আমার মাথার ওপর দিয়ে যে মাধ্যম অপপ্রচারে ব্যবহৃত হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে কি সরকার মামলা করেছে? ইউরোপ, অ্যামেরিকাতে দেখুন ফেইসবুকের বিরুদ্ধে মামলা করে। সাত হাজার মামলা হয়েছে, ওইসব দেশে তো তার জনগণের বিরুদ্ধে এত মামলা করেনি।”
অতীতে নিবর্তনমূলক আইনের বিতর্কিত ধারাগুলো খসড়া এ অধ্যাদেশের ১৭, ১৮, ১৯, ২২ ও ২৩ ধারায় অপরাধ উল্লেখ করে সেগুলো অজামিনযোগ্য করা হয়েছে। সভায় বিতর্কিত সেসব ধারার অপব্যবহারের কথা তুলে ধরেছেন ভুক্তভোগীরা।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তুলে নিয়ে মিথ্যা মামলায় জড়িয়েছে এবং বারবার জামিন প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন বলে অভিযোগ করেন ডিএসএ ভিটটিমস নেটওয়ার্কের আহ্বায়ক গোলাম মাহফুজ জোয়ার্দার।
নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমি ফেইসবুকে এক পোস্টে জনগণকে নির্যাতনের বিষয়ে আওয়ামী বাহিনী ও পুলিশের কথা লিখেছিলাম। সেখানে তৎকালীন পরিস্থিতি নিয়ে গৃহযুদ্ধ লেগে যেতে পারে, এ কথা লেখার কারণে বাসা থেকে তুলে নিয়ে নির্যাতন চালানো হয়। তারপর মিথ্যা মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। আমার সাতবার জামিন আবেদন প্রত্যাখাত হয়। আট বারের মাথায় আমি জামিন পাই। এরপরও বিভিন্নভাবে তারা অত্যাচার করতে থাকে।”
গোলাম মাহফুজ জোয়ার্দার দাবি করেন, যাদের বিরুদ্ধে ডিএসএ, আইসিটি অ্যাক্ট অথবা সিএসএর ধারায় মামলা করে হয়রানি করা হয়েছে, তাদের যেন অবিলম্বে মামলা থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। একইসঙ্গে তাদের যেন ক্ষতিপূরণ দেওয়ার পাশাপাশি এ ধরনের নতুন কোনও আইন সরকার যাতে না করে, তা নিশ্চিত করতে হবে।
ভুক্তভোগী ইশরাত জাহান ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার হয়ে ৩ বছর ৭ মাস কারাগারে ছিলেন। রিমান্ডের নামে তাকে নির্যাতন করার ভয়াভহ অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন তিনি।
সেসব দিনের কথা তুলে ইশরাত বলেন, “২০২০ সালে একদিন জোর করে আমাকে বাসা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তুলে নিয়ে যায়। আমি তখনও জানতাম না কী কারণে। টুইটারে আমার নাম ব্যবহার করে কেউ কিছু পোস্ট দিয়েছে। সেটা দেখিয়ে পরে আমাকে ডিএসএর মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়। এরপর আমাকে রিমান্ডের নামে নির্যাতন করা হয়েছে।
“৩ বছর ৭ মাস আমি কারাগারে ছিলাম। বারবার জামিন চাইলেও দেওয়া হতো না। বলা হতো- অজামিনযোগ্য মামলা, অথচ আমি সেই অপরাধই করিনি।”
আরেক ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী আল আমিন বলেন, “আমি সাইবার সিকিউরিটি (সিএসএ) আইনের এক মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে সাড়ে ৩ মাস কারাগারে ছিলাম। আমি সরকারের নতুন শিক্ষা কারিকুলামের বিরুদ্ধে সমালোচনা করে তা বাতিল চেয়েছিলাম। তার জন্য জনমত গড়তে বিভিন্ন মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করেছিলাম। এজন্য আমাকে গ্রেপ্তার করে সিএসএ মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়।”