দেশজুড়ে শনিবার রাতে শুরু হওয়া যৌথ বাহিনীর ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ এ গাজীপুর থেকে ৪০ জনকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানিয়েছেন, যতদিন ‘ডেভিল’ শেষ না হবে, ততদিন বিশেষ এ অভিযান চলবে।
গাজীপুরে ছাত্র-জনতার ওপর হামলার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ও ‘সন্ত্রাসীদের’ আইনের আওতায় আনতে যৌথ বাহিনীর সমন্বয়ে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ নামে এ অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
গাজীপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) চৌধুরী মো. যাবের সাদেক রবিবার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, শনিবার রাতভর অভিযান চালিয়ে ৪০ জনকে আটক করেছে জেলা পুলিশ। তারা বিভিন্নভাবে পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের লোকজন।
রবিবার রাজধানী ঢাকায় এক অনুষ্ঠান শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, “ডেভিল যতদিন পর্যন্ত শেষ না হবে, ততদিন পর্যন্ত অপারেশন চলবে।”
ফার্মগেইটে মৃত্তিকা সম্পদ ইনস্টিটিউটে ‘মৃত্তিকা ভবন’ উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেন।
গাজীপুরের ঘটনা সম্পর্কে এলাকাবাসী ও পুলিশ সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছে, শুক্রবার রাতে একদল বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা গাজীপুর মহানগরের ধীরাশ্রমের দক্ষিণখান এলাকায় সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মোজাম্মেল হকের বাড়িতে হামলা চালান। তারা বাড়ির ভেতরে ঢুকে ভাঙচুর করে। এসময় মসজিদের মাইকে সাবেক মন্ত্রীর বাড়িতে ডাকাত পড়েছে বলে ঘোষণা দিয়ে লোকজনকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়। মাইকিং শুনে আশপাশের লোকজন বাড়িটি ঘিরে ফেলে। এসময় মারধর করে অন্তত ১৫ জনকে আহত করা হয়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের দাবি, আহত এসব শিক্ষার্থী তাদের সংগঠনের। তারা শুক্রবার রাতে সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেলের বাড়িতে ডাকাতির খবর পেয়ে তা প্রতিহত করতে গিয়েছিলেন। সেখানে তাদের মারধর করা হয়।
ঘটনার পর শনিবার গাজীপুরে বিক্ষোভ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি।
এদিন বিকালে গাজীপুর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে রাজবাড়ী সড়কে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিক্ষোভ কর্মসূচিতে গিয়ে দায়িত্বে অবহেলার কথা স্বীকার করে ক্ষমা চান মহানগর পুলিশের কমিশনার নাজমুল করিম খান। তিনি জানান, গাজীপুর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আরিফুর রহমানকে এ ঘটনায় প্রত্যাহার করা হয়েছে।
গাজীপুর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিক্ষোভ শেষে শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে দুর্বৃত্তদের গুলিতে এক শিক্ষার্থী আহত হন।
এর কয়েক ঘণ্টা পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ বিভাগের এক বিজ্ঞপ্তিতে যৌথ বাহিনীর বিশেষ অভিযান ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ সারাদেশে শুরুর কথা জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গাজীপুরে ছাত্র-জনতার ওপর সন্ত্রাসী আক্রমণের ঘটনায় শনিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সমন্বয়ে একটি সভা হয়। সভায় সংশ্লিষ্ট এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে ও সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনতে যৌথ বাহিনীর সমন্বয়ে অপারেশন ডেভিল হান্ট পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়।
এতে আরও বলা হয়, গত শুক্রবার রাতে পতিত স্বৈরাচারের সন্ত্রাসীদের হামলায় ১৫-১৬ জন গুরুতর আহত হন, যাদের প্রায় সবাই শিক্ষার্থী।
যৌথ বাহিনীর এই বিশেষ অভিযানের বিষয়ে রবিবার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম আরও বলেন, “যারা দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে, এক্ষেত্রে যারা আইন অমান্য করে, দুষ্কৃতকারী ও সন্ত্রাসী, তারাই গ্রেপ্তার হবে।”
‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের ব্রিফিং
যারা দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে তাদেরকে আটক করে আইনের আওতায় আনা ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ এর মূল লক্ষ্য বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি।
রবিবার দুপুরে সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ নিয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে একথা জানান তিনি।
সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি জানান, ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ এ মূলত পুলিশ বাহিনী নেতৃত্ব দিচ্ছে। সেনাবাহিনী তাদের সাহায্য করছে।”
তিনি বলেন, “ছয় মাস আগে ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সারাদেশে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। সেসময় আমাদের পুলিশ বাহিনীর বেশকিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তাদের নীতিগত ও মানসিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, থানা পুড়ে গেছে, যে কারণে ‘ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার’ সারাদেশে সেনা মোতায়েন রয়েছে।”
নাসিমুল গনি বলেন, “এই পরিস্থিতিতে কাজ করতে গিয়ে আমরা অনেকগুলো পরিকল্পনা নেই। এর অনেকগুলো চলমান আছে এবং অনেকগুলো প্রয়োগ করতে যাচ্ছি। তার একটা অপারেশন ডেভিল হান্ট।”
তিনি বলেন, “এই অপারেশন যৌথভাবে সকলে মিলে একটা ফোকাসড ওয়েতে কাজ করবে। দেশকে অস্থিতিশীল করার যে চেষ্টা হচ্ছে সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এই অপারেশন চলবে। এর জন্য আইনানুগ পদ্ধতিতে যেসব ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন নেওয়া হবে। সেটার জন্য সব বাহিনীকে প্রস্তুত ও ব্রিফিং করা হয়েছে। একইসাথে তাদের কাজ চলমান রয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব গনি বলেন, “আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে আগে যেভাবে আইন প্রয়োগ করা হতো আমরা সেভাবে হাঁটতে পারবো না। আইনের স্পিরিট নিয়ে কাজটা করতে হবে। মানবাধিকার এবং পরিবেশের বিষয়টি মাথায় রেখে আমরা একটি ভালো সিস্টেম গড়ে তুলতে চাই।
“আমরা চাই, যেন আর কোনও আয়নাঘর তৈরি না হয়। আগামীর জন্য যেন ভালো পরিবেশ রেখে যেতে পারি, আমরা সেই চেষ্টাই করছি। এই প্রেক্ষিতে আগামী ১১ ফেব্রুয়ারি মানবাধিকার ও পরিবেশের ওপর গুরুত্ব দিয়ে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সাথে একটি কর্মশালার আয়োজন করা হচ্ছে।”
পুলিশ বাহিনীর বর্তমান অবস্থা নিয়ে তিনি বলেন, পৃথিবীর যেসব দেশে বিপ্লব হয়েছে, সেসব দেশ পরাজিত শক্তিকে রাখেনি। কিন্তু আমরা অতটা অমানবিক হতে পারিনি।
নাসিমুল গনি বলেন, “আমরা বাহিনীটিকে সংস্কার করতে চেয়েছি। পুলিশের কেউ ভয়ে এবং চাপে পড়ে অন্যায় করেছে। কিছু যারা ডাই-হার্ড ছিল, তারা পালিয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, “একটা বাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে গেছে। পুলিশে সত্যিকার অর্থে সংস্কার আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা চাই পুলিশ কোমর সোজা করে দাঁড়াক। এজন্য তাদের সক্রিয়ভাবে কাউন্সেলিং করা হচ্ছে।”