Beta
শুক্রবার, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
Beta
শুক্রবার, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

ঢাকার ৬ নম্বর বাসের একাল-সেকাল

ঢাকার ৬ নম্বর রুটের বাস নিয়ে অনেক স্মৃতি যাত্রীদের।
ঢাকার ৬ নম্বর রুটের বাস নিয়ে অনেক স্মৃতি যাত্রীদের।
[publishpress_authors_box]

৬ নম্বর বাস, মানে রুটটির ক্রমিক হলো ৬। ঢাকার কমলাপুর থেকে গুলশান পথে চলে এই বাস। দেখতে অন্য বাসের তুলনায় লম্বা, দরজাও দুটো, ভেতরে বসার আসন ৫২টি। এমন বাস এখন আর রাজধানীতে অন্য কোনও রুটে দেখা যায় না।

পাকিস্তান আমল থেকেই সেবা দিয়ে আসছে এই ৬ নম্বর বাস। তার সঙ্গে জড়িয়ে রাজধানীর অনেকের অম্লমধুর স্মৃতি।  

৬ নম্বর গাড়িতে চড়ার ৩২ বছরের স্মৃতির মধ্যে ঈদের সময়টা আলাদা করে মনে পড়ে গোলাম রাব্বানীর। তিনি বলেন, “৬ নম্বর গাড়ির একটি বিষয় ছিল ঈদের দিন। ঈদের দিন দূপুর পর্যন্ত তারা কোনও ভাড়া নিত না। আমি ২/১ বার জোর করে দেওয়ার চেষ্টা করেও পারি নাই। তাদের কথা হলো, সব সময়ও আপনারাই দেন, একদিন না হয় আমরা বিনা পয়সায় আপনাদের নিলাম।”

রাজধানীর মূল সড়ক দাপিয়ে বেড়ানো যাত্রীবাহী এই বাহনটির সংখ্যা কমতে কমতে এখন মাত্র নয়টিতে দাঁড়িয়েছে। আগের রুটে কিছুটা পরিবর্তন এনে এখন কমলাপুর থেকে কুড়িল পর্যন্ত চলাচল করছে। আধুনিক সব বাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এখন টিকে থাকার লড়াইয়ে আছে পরিবহনটি।

মতিঝিল বনানী ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি লিমিটেডের অধীনে চলাচলরত ৬ নম্বর বাসকে নতুন আঙ্গিকে সাজানোর পরিকল্পনা করছে মালিক কর্তৃপক্ষ। তার মধ্যে যাত্রীদের মনে ভিড় জমাচ্ছে স্মৃতিগুলো।

৬ নম্বর বাসে উঠে পকেট কাটার শিকারের কথা বলেছেন অনেক যাত্রী।

অম্লমধুর সেই সব স্মৃতি

৬ নম্বর গাড়িতে চড়া নিয়ে মজারা সব স্মৃতি আছে বেসরকারি চাকরিজীবী আহম্মেদ সারোয়ার হোসেন ভুইয়ার।

তার ভাষ্যে, “মতিঝিল থেকে গুলিস্তান বা স্টেডিয়াম যেতে এই বাসই ছিল আমাদের ভরসা। সহজে অল্প ভাড়ায় এই বাসে উঠে স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে যেতাম। বাসটিতে যখন তখন উঠে পড়া যেত। আবার মনমতো জায়গায় নেমেও যাওয়া যেত। অল্প খরচে কাছে কিংবা দূরে যেতে এই বাসটির বিকল্প নাই।”

এই বাসের কন্ডাক্টর বা পরিবহনকর্মীদের কথাও আলাদাভাবে মনে পড়ে সারোয়ারের।

“একটা অবাক ব্যাপার ছিল, সেটা হলো এই বাসের সুপারভাইজারদের কখনও একবারের বেশি দুইবার ভাড়া চাইতে দেখা যেত না। কীভাবে যেন তারা যারা ভাড়া দিয়েছে, তাদের মনে রাখতো।”

এ তো গেল ভালো দিক, মন্দ দিকের কথা বলতে গিয়ে পকেটমারের দৌরাত্ম্যের কথা বলেন তিনি।

“এই বাসে উঠে পকেট মারের শিকার হয়নি, এমন ঘটনা নেহায়েত কম না। ঠেলাঠেলিতে পকেট মার ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। মজার ব্যাপা হলো, যখনই গাড়িতে পকেটমার উঠত, তখন সুপারভাইজাররা ইঙ্গিতে যাত্রীদের সতর্ক করত। এটা ছিল একটা হাস্যকর ব্যাপার।”

মেহেদী হাসান ডালিম নামে একজন তার প্রথম মোবাইল ফোনটি খোয়ান এই ৬ নম্বর বাসে। ২০০৭ সালের সেই ঘটনা স্মরণ করে তিনি বলেন, “তখন আমার একটি বাটন মোবাইল ছিল। ভিড়ের মধ্যে এই বাসে পকেট থেকে কখন যে মোবাইল নিয়ে গেছে, সেটা টেরই পাইনি।”

তখন অল্প ভাড়ার জন্য ৬ নম্বর বাসই ছিল ডালিমের ভরসা। কারণ লেখাপড়া করা অবস্থায় ভাড়ার টাকা বাঁচিয়ে চলতে হতো।

“ফার্মগেইট, মহাখালী, গুলিস্তান যেদিকেই যাই, মগবাজার বা মালিবাগ থেকে ৬ নম্বর বাসে উঠতাম,” বলেন তিনি।

গোলাম রাব্বানীর ঢাকায় আসা ১৯৯২ সালে। তার বড় ভাই তখন তেজগাঁও কলেজে পড়তেন। বাবার সঙ্গে ফার্মগেইট থেকে ৬ নম্বর বাসে ওঠে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছিলেন তিনি।

পরে নিজে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে ২০০৭ সাল থেকে ঢাকায় থিতু। তবে ৬ নম্বর বাস নিয়ে তার অনেক স্মৃতি, তার মধ্যেই জ্বলজ্বলে ঈদের দিনের ঘটনাটি।

দেনছের আলী ৪২ বছর ধরে চালাচ্ছেন ৬ নম্বর বাস।

৪২ বছর ধরে চালকের আসনে

দেনছের আলী, বাবা মো. কাশেম বেপারী, জন্ম ১৯৫৮ সালে ১৮ ফেব্রুয়ারি। ২১ বছর বয়সে মোটর শ্রমিক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন তিনি। প্রথমে হেলপার, পরে সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। এরপর ১৯৭৮ সাল থেকে চালকের জীবন শুরু।

দেনছের আলীর চালক জীবনের ৪৫ বছর পার হলো, তার ৪২ বছরই কেটেছে ৬ নম্বর বাসের আসনে। মাঝে তিন বছর চালিয়েছেন গাজীপুর পরিবহনের বাস।

৬ নম্বর বাস নিয়ে অনেক স্মৃতি জমা দেনছের আলীর জীবনে, যার শুরুটা হয় স্বাধীনতার পরপরই বরিশাল থেকে ঢাকায় আসার মাধ্যমে।

তিনি বলেন, সে সময় ৬ নম্বর বাস গুলশান-২ এর গোল চত্বর থেকে গাড়ি ছেড়ে গুলশান-১ হয়ে মহাখালী দিয়ে ফার্মগেইট হয়ে বাংলামোটর, এরপর মগবাজার মোড় দিয়ে মৌচাক, শান্তিনগর দিয়ে পুরানা পল্টন হয়ে গুলিস্তান হয়ে টিকাটুলী দিয়ে মতিঝিল হয়ে কমলাপুর পীরজঙ্গি মাজার পর্যন্ত চলত।

তখন গুলশান থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ভাড়া ছিল ১ টাকা ৮০ পয়সা। অর্ধ শতক পর সেই ভাড়া বেড়ে এখন ৫৫ টাকা।

এক সময় যাত্রী ও গাড়ির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় তিনটি গ্রুপ এ, বি, সি ভাগ করে বাসগুলো চলাচল করতে দেখেছেন দেনছের। এখন দেখছেন গাড়ির নগন্য সংখ্যা।

এই বাসটি ছাড়ার সময় নির্ধারিত থাকলেও পৌঁছানোর সময়ের কোনও ঠিক-ঠিকানা নেই, এনিয়ে যাত্রীদের বিস্তর অভিযোগ।

তানিয়ে চালক দেনছের বলেন, যানজটের কারণে সময় ধরে চালানো যাচ্ছে না।

“কিন্তু আগে সময় নির্ধারিত ছিল। প্রতিটি গাড়ির জন্য ৫৫ মিনিট করে সময় ছিল। এ সময়ের মধ্যে পৌঁছতে হবে। তখন যে যত মিনিট দেরিতে পৌঁছত, তাকে ৫ টাকা জরিমানা কিংবা অতিরিক্ত এই সময় তার থেকে কেটে নিয়ে পরের গাড়িকে দেওয়া হতো।”

এখন কতটা সময় লাগে কুড়িল থেকে কমলাপুর পৌঁছাতে- জানতে চাইলে দেনছের বলেন, “এখন কুড়িল থেকে গাড়ি ছাড়লে যাওয়া-আসা মিলিয়ে ৫ ঘণ্টা সময় লাগে। তবে কোনও কোনও দিন শুধু একবার যাইতেই পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা লাগে।”

একটি ট্রিপে ৫ ঘণ্টা যদি সময় লাগে, তাতে খরচ বাদ দিয়ে ৩ হাজার টাকা টেকে বলে জানান দেনছের। আবার কখনও কখনও আয় ৯০০ টাকায়ও নেমে আসে।

এই ৪২ বছরে মধ্যে একবার একটি দূর্ঘটনায় ডাক পুলিশের এক সদস্যকে আহত করেছিলেন দেনছের।

“মগবাজার এলাকার কাছে একটি দূর্ঘটনা ঘটে। তখন একজন ডাক পুলিশ আহত হন। পরে এই ঘটনায় মামলা হয়, সে সময়ে আমি ৪ হাজার টাকা জরিমানা দিয়েছিলাম।”

প্রবীণ এই গাড়িচালক বলেন, গণপরিবহন চালাতে হলে একজন চালকের মাথা অনেক ঠাণ্ডা রাখতে হয়।

“অনেকে অনেক কথা বলবে, সেগুলো কানে নেওয়া যাবে না। এগুলো যদি কানে নেয়, তাহলে তার দ্বারা লোকাল গাড়ি চালানো হবে না।”

৬ নম্বর বাসের আরেক চালক মো. সাগর হোসেন। তিনি ২০০৭ সাল থেকে এই গাড়িতে আছেন। হেলপার থেকে শুরু করে এখন চালক। মাঝে কনডাক্টরের কাজও করেছেন।

তিনি জানান, যানজট না থাকলে দুই-আড়াই ঘণ্টায়ও ট্রিপ শেষ করা যায়। কিন্তু যানজট হলে পাঁচ/ছয় ঘণ্টাও লেগে যায়।

৬ নম্বর বাসে কোনও তাড়াহুড়ো নেই, তাই একে ‘রিলাক্সড গাড়ি’ বলেন পরিবহনকর্মীরা।

‘রিলাক্সড গাড়ি’

সাগরের চোখে ৬ নম্বর বাস হলো ‘রিলাক্সড গাড়ি ‘। কেন? তার উত্তরে তিনি বলেন, “তাড়াহুড়া করে এই বাস চলে না। মালিক থেকেই নির্দেশনা রয়েছে আস্তে আস্তে গাড়ি চালানোর। প্রয়োজনে রিকসার পেছনে চালানোর। মালিক বলেছেন, আর যাই কর গাড়িতে কোনো দূর্ঘটনা ঘটানো যাবে না। সারাদিনে দুই ট্রিপ বা এক ট্রিপ হোক, তাতে কোনও সমস্যা নাই। রিলাক্স হয়ে চালাতে হবে।”

তাড়াহুড়ো নেই বলেই ৬ নম্বর বাস চালান সাগর।

এখন কমলাপুর থেকে উঠে কোনও যাত্রী কুড়িল পর্যন্ত যাচ্ছে, এমন নজির খুব কম। রাজধানীবাসীর কাছে ৬ নম্বর বাস মানে ‘সর্বোচ্চ লোকাল’।

কমলাপুর থেকে ছাড়ার পর মতিঝিল, গুলিস্তান, পল্টন, কাকরাইল, শান্তিনগর, মৌচাক, মগবাজার, বাংলামোটর, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেইট, বিজয় সরণি, মহাখালী, গুলশান-১, বাড্ডা লিংক রোড, হোসেন মার্কেট, নতুন বাজার হয়ে কুড়িল গিয়ে থামে বাসটি।

শুরুতে পাঁচ বছর ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়াও গাড়ি চালিয়েছিেলন বলে স্বীকার করেন সাগর। ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের আন্দোলনের পর কড়াকড়ির কারণে লাইসেন্স করান তিনি।

সাগর বলেন, “এখন লাইসেন্স আছে। অভিযানের পর লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালানো যায় না।”

সারাদিন গাড়িয়ে চালিয়ে খরচ বাদ দিয়ে ১৫০০ টাকার মতো থাকে বলে জানান তিনি। 

“আগে একটা গাড়িতে চার থেকে পাঁচজন লোক কাজ করত। এখন দুইজনে গাড়িয়ে চালিয়েও তেমন লাভ হয় না। ভাড়া বাড়লেও আয় বাড়েনি।”

৬ নম্বর বাস বদলে কোস্টার চালুর খবর দিলেন সুপারভাইজার আব্দুস সোবহান।

নতুন পরিকল্পনা

৬ নম্বর বাসের সুপারভাইজার ৬৫ বছর বয়সী আব্দুস সোবহান ৪০ বছর ধরেই এই পরিবহনে যুক্ত আছেন। তিনি জানালেন, ৬ নম্বর বাস সব বদলে কোস্টার চালু হবে বলে তিনি জেনেছেন।

“ঢাকা শহরে বড় বাস তেমন চলে না। এত বড় গাড়ি কখন ভরবে, কখন ছাড়বে, সে কারণে বড় গাড়ি চলে না। সব গাড়ি নতুন করে কোস্টার করে ছাড়বে মালিকরা।”

ব্যবসা আগের মতো নেই বলে বদলের চিন্তা বলে জানিয়েছেন মতিঝিল বনানী ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি লিমিটেডের চেয়ারম্যান ইউসুফ খান।

তিনি বলেন, “এক সময় এই লাইনে আমার নিজেরই আটটা বাস ছিল। কমতে কমতে এখন আমার একটা মাত্র বাস চলছে। আগের মতো এখন আর ব্যবসা নাই। শুধু ঐতিহ্যটা ধরে রেখেছি।”

কোস্টার নামানোর বিষয়ে তিনি বলেন, “এখন যে ৬ নম্বর বাস চলছে, গাড়িগুলো বড় আকৃতির হওয়ায় যাত্রীরা বেশি উঠে না। নতুন করে কোস্টার ছাড়া হবে। ৬ নম্বরের ঐতিহ্য ধরে রেখেই নতুন করে বাস চলাচল করবে।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত