এইচএসসি পরীক্ষার প্রকাশিত ফল নিয়ে আপত্তি তুলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ঘেরাওয়ে গিয়েছিল একদল শিক্ষার্থী। সেখানে তাদের সঙ্গে মারামারি বাধে বোর্ড কর্মচারীদের। তাতে কয়েকজন আহত হয়েছে।
পাঁচ দিন আগে প্রকাশিত এইচএসসি পরীক্ষার ফলে বৈষম্য করা হয়েছে, এমন অভিযোগ তুলে রবিবার দুপুরে পুরান ঢাকার বকশীবাজারে ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বোর্ডে গিয়েছিল ওই শিক্ষার্থীরা।
বোর্ডের কর্মকর্তাদের দাবি, শিক্ষার্থীরা বোর্ডের ভেতরে ঢুকে ভাংচুর করে। এমনকি তারা বোর্ডের চেয়ারম্যানের কক্ষেও ভাংচুর চালায়। তখন কর্মচারীরা তাদের থামানোর চেষ্টা করেছিল।
অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা বলছে, তারা তাদের দাবি আদায়ে কথা বলতে ভেতরে গেলে কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা তাদের ওপর হামলা করে। এতে একজন নারী শিক্ষার্থীর মাথা ফেটে যাওয়াসহ গুরুতর আহত হয় কয়েকজন শিক্ষার্থী। তাদের বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
দুপুর ২টায় এই মারামারির পর বিকাল ৫টায়ও কিছু শিক্ষার্থী বোর্ডের সামনে অবস্থান করছিল।
আন্দোলন কী নিয়ে?
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ২০২৪ সালে রাজধানীর বিভিন্ন কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল। পাস করা ও অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বেশ কয়েকজন নারী অভিভাবককেও তাদের সঙ্গে দেখা যায়।
গত ১৫ অক্টোবর এইচএসসি-সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়। এতে ১১টি শিক্ষা বোর্ডে গড় পাসের হার ৭৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ। সারা দেশে জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১ লাখ ৪৫ হাজার ৯১১ জন।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে স্থগিত হওয়া বিষয়গুলোর পরীক্ষা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে বাতিলের কারণে এবার এইচএসসি পরীক্ষার মূল্যায়ন হয় ভিন্ন পদ্ধতিতে।
বাতিল হওয়া পরীক্ষাগুলোর মূল্যায়ন হয়েছে পরীক্ষার্থীদের এসএসসি বা সমমানের পরীক্ষার নম্বরের ভিত্তিতে (মাবজেক্ট ম্যাপিং)। অর্থাৎ এসএসসিতে যে নম্বর পেয়েছিলেন শিক্ষার্থী, সেটা এইচএসসিতে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। আর এইচএসসিতে যে বিষয়গুলোর পরীক্ষা হয়েছিল, সেগুলোর উত্তরপত্রের ভিত্তিতে মূল্যায়ন হয়েছে। এ দুই মূল্যায়ন মিলে এবারের এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল তৈরি করা হয়।
বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, যে ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে, তা বৈষম্যমূলক।
তারা চায়, সবগুলো বিষয়ের ওপর ‘ম্যাপিং’ করে আগের ফলাফল বাতিল করে নতুন করে ফলাফল প্রকাশ করা হোক।
আন্দোলনে থাকা ইমতিয়াজ খান ইন্তু নামে এক শিক্ষার্থী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বাতিল ৬টি পরীক্ষা যে পদ্ধতিতে ম্যাপিং করে ফলাফল তৈরি করা হয়েছে তাতে চরম বৈষম্য তৈরি হয়েছে। ফলাফলের গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার জন্য তারা ঢালাওভাবে ভুল ফলাফল দিয়েছে।
“কোনও বোর্ডে কেউ ৬টি পরীক্ষা দিয়েছে, কেউ ৩টি পরীক্ষা দিয়েছে। অথচ রেজাল্টের ক্ষেত্রে কম পরীক্ষা দেওয়া বোর্ডের রেজাল্ট ভালো হয়েছে। এই ফলাফল আমরা মানি না। অবিলম্বে ঘোষিত ফলাফল বাতিল করে নতুন পদ্ধতিতে রেজাল্ট প্রকাশের দাবি জানাতেই আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছি।”
শিক্ষাবোর্ডে কী ঘটেছে
রবিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ‘এইচএসসি ব্যাচ ২০২৪’-এর ব্যানারে একদল শিক্ষার্থী কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জড়ো হয়। সেখানে সমাবেশ করে বেলা ১২টার পর তারা মিছিল নিয়ে ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের উদ্দেশে রওনা দেয়।
বেলা ১টার দিকে মিছিলটি বোর্ডের ফটকের সামনে পৌঁছায়। শিক্ষার্থীরা ভেতরে ঢুকতে চাইলে মূল ফটকে তালা দিয়ে দেয় বোর্ড কর্মচারীরা। ফটকের সামনে প্রায় আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করে শিক্ষার্থীরা আলোচনার জন্য আহ্বান জানাতে থাকে।
দুপুর ২টার দিকে শিক্ষার্থীরা ফটকের তালা ভেঙে বোর্ডের ভেতরে ঢুকে পড়ে। খবর পেয়ে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরাও সেখানে যায়। তারা শিক্ষার্থীদের বোঝানোর চেষ্টা করলেও কোনও বাধা দিতে দেখা যায়নি।
ভেতরে ঢুকে শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি জানাতে সরাসরি বোর্ডের ভেতরে চেয়ারম্যানের কক্ষে চলে যায়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, সেখানে বাক-বিতণ্ডার এক পর্যায়ে মারামারি বেধে যায়।
কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা দল বেধে মারধর করে বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের।
কর্মকর্তারা বলছে, শিক্ষার্থীরা অতর্কিত ভাংচুর চালালে কর্মচারীরা বাধা দেয় এবং সেখানে ধাক্কাধাক্কিতে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটতে পারে।
তখনকার কয়েকটি ভিডিওতে দেখা যায়, শিক্ষা বোর্ডের সিঁড়ি দিয়ে শিক্ষার্থীরা দৌড়ে নেমে আসছে। তার কয়েকজন কর্মচারী তাদের মারধর করছে। লাল হিজাব পরা এক নারী শিক্ষার্থী ধাওয়ার মুখে সিঁড়ি থেকে পড়েও যান।
বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে গিয়ে দেখা যায়, বোর্ড চেয়ারম্যানের কক্ষের ভেতরে অনেক নথিপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। একটি টি টেবিলের কাচ ভেঙে পড়ে আছে।
ওই কক্ষের সামনেও ফুলের টবসহ বেশকিছু জিনিস ভাঙ্গা এবং এলোমেলোভাবে মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখা যায়।
দায়িত্বশীলরা কী বলছেন
ঘটনাস্থলে থাকা চকবাজার থানার ওসি রেজাউল হোসেন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, ফলাফলে বৈষম্য হয়েছে- এই অভিযোগ শিক্ষার্থীদের। এর প্রতিবাদে তারা বোর্ডের সামনে অবস্থান করছিলেন। তারা একপর্যায়ে বোর্ডের ভেতরে ঢুকে পড়ে।
“নথিপত্রসহ অন্যান্য জিনিসপত্র রক্ষায় বোর্ডের কর্মচারীরা শিক্ষার্থীদের বাধা দেন। তখন ধাক্কাধাক্কিতে কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন বলে আমি শুনেছি।”
শিক্ষার্থীদের সরিয়ে না দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, “তাদের সরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে আমাদের কোনও নির্দেশনা নেই। ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যানের সঙ্গে আমরা সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছি। বিষয়টি উনি সমাধান করবেন বলে আমাদের জানিয়েছেন।”
ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার আলোকে ইতিমধ্যে এই পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে। এখানে বৈষম্যের সুযোগ নেই। তারপরেও শিক্ষার্থীরা কী বলতে চায়, আমরা শুনব, শিক্ষাবোর্ডকে অবগত করব।
“আর তারা যদি মনে করে, ফলাফল সঠিক নয়, তারা বঞ্চিত হয়েছে, তাহলে নিয়ম অনুযায়ী তারা ফল পুনঃবিবেচনার জন্য আবেদন করবে।”
“তা না করে কয়েকজনের বিভ্রান্তিকর তথ্যের ভিত্তিতে তারা বিক্ষোভ করছে। এভাবে তো সমাধান হবে না,” বলেন তিনি।
অধ্যাপক তপন বলেন, “আমরা কথা বলছি তাদের সঙ্গে। দ্রুত বিষয়টি সমাধান করা হবে।”
তবে চাপের মুখে রাতে তিনি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন বলে প্রথম আলো জানিয়েছে।