পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) পার্টির প্রতিষ্ঠাতা কারাবন্দি ইমরান খানের স্ত্রী বুশরা বিবির ওপর চটেছে দলটির নেতাকর্মীরা। ক্ষোভ ও হতাশা থেকে তারা বুশরা বিবির গাড়িতে ভাংচুরও চালিয়েছে।
বৃহস্পতিবার পাকিস্তানের জিও নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বুশরা বিবির পাশাপাশি পিটিআই নেতা খাইবার পাখতুনখোয়া প্রাদেশিক সরকারের মুখ্যমন্ত্রী আলী আমিন গান্দাপুরও দলের কর্মীদের ক্ষোভের শিকার হয়েছেন। ভাংচুর চালানো হয়েছে তার গাড়িতেও।
কারাবন্দি ইমরান খানের মুক্তি দাবিতে রবিবার থেকেই দেশজুড়ে পথে নেমেছিল পিটিআই নেতাকর্মীরা। এক পর্যায়ে ইমরান খানের স্ত্রী বুশরা বিবি ঘোষণা করেন, স্বামীকে মুক্ত না করে ঘরে ফিরবেন না।
তবে সরকারের ব্যাপক দমন-পীড়ন সহ্য করেও কর্মীরা যখন কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছিল, তখন মাঝপথে রণে ভঙ্গ দিয়ে বিক্ষোভস্থল ত্যাগ করেন বুশরা বিবি ও আলী আমিন গান্দাপুর। এরপরই দলীয় কর্মীদের ক্ষোভের মুখে পড়েন তারা।
সোশাল মিডিয়ায় প্রচারিত একটি ভিডিওতে দেখা যায়, হঠাৎ কর্মসূচি স্থগিত করায় হতাশ ও ক্ষুব্ধ পিটিআই কর্মীরা বুশরা বিবি ও আলী আমিন গান্দাপুরের গাড়িতে ইট-পাথর ও লাঠি দিয়ে আঘাত করছে।
বিক্ষোভকারীদের দাবি ছিল, ইমরান খানের মুক্তির জন্য অবস্থান ধর্মঘট অব্যাহত থাকবে। কিন্তু প্রতিবাদ কর্মসূচি হঠাৎ স্থগিত করে বুধবার ভোরে খাইবার পাখতুনখাওয়ার মুখ্যমন্ত্রী আলী আমিন গান্দাপুর এবং ইমরান খানের স্ত্রী বুশরা বিবিসহ দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা ইসলামাবাদের বিক্ষোভস্থল ত্যাগ করেন।
গত রবিবার ইমরান খানের সমর্থকরা পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে বিক্ষোভ-মিছিল নিয়ে রাজধানী ইসলামাবাদের দিকে যাওয়া শুরু করে।
অন্যদিকে, সরকার ইসলামাবাদে লকডাউন জারি করে শহরে প্রবেশের সব রাস্তা বন্ধ করে দেয়।
সোমবার থেকে ইসলমাবাদের চারপাশে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ শুরু হয়। মঙ্গলবার রাতের মধ্যে পিটিআইয়ের নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ ও সংঘর্ষ করতে করতে ইসলামাবাদের ডি–চকে পৌঁছে যায়।
নিরাপত্তা বাহিনীও বিক্ষোভকারীদের ওপর চড়াও হয়। মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবার সকাল পর্যন্ত অন্তত ১ হাজার বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার আগের দুদিনেও কয়েক হাজার জনকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে দাবি করে পিটিআই।
এ ছাড়া পিটিআই মহাসচিব সালমান আকরাম রাজা দাবি করেছেন, নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে তাদের অন্তত ২০ জন নিহত হয়েছেন এবং তিনি সরকারের বিরুদ্ধে আদালতে যাবেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করবেন।
তবে ইসলামাবাদের পুলিশপ্রধান আলী রিজভি দাবি করেছেন, অপারেশন চলাকালীন কোনও তাজা গুলি ব্যবহার করা হয়নি।
তিনি জানান, মঙ্গলবারের অভিযানে ৬০০ প্রতিবাদকারীকে আটক করা হয়েছে, ফলে প্রতিবাদ শুরু হওয়ার পর থেকে মোট আটকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯৫৪ জনে।
তবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, বিক্ষোভকারীরা রাজধানীতে প্রবেশ করলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বেআইনি ও অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করেছে।
পাকিস্তানের মানবাধিকার কমিশন এক বিবৃতিতে বলেছে, পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের দলের উচিত, অবিলম্বে একটি রাজনৈতিক সংলাপ শুরু করা।
উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, এ বিক্ষোভে কেউ বিজয়ী হয়নি। বিক্ষোভ দমনের কারণে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ক্ষোভ বাড়ছে। একই সঙ্গে পিটিআই সদস্যদেরও এর মূল্য গুনতে হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন ও ট্রাম্প প্রশাসনের আইনপ্রণেতারাও দ্রুত ইমরান খানের মুক্তি ও আলোচনার ওপর জোর দিয়েছেন।
ইমরান খান ২০২৩ সালের আগস্ট থেকে কারাগারে আছেন। তার বিরুদ্ধে একশর বেশি মামলা রয়েছে। কয়েকটি মামলায় তাকে দণ্ডও দেওয়া হয়েছে। এ কারণে তিনি গত ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি। নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ করেন তিনি।
নির্বাচনের পর থেকে পিটিআই সরকারি দমন-পীড়ন উপেক্ষা করে নিয়মিত সভা-সমাবেশ করে আসছিল। নির্বাচনের পর রাজধানীতে পিটিআইয়ের মঙ্গলবারের সমাবেশটি ছিল সবচেয়ে বড়।
ইমরান খান এই বিক্ষোভকে ‘শেষ ডাক’ হিসেবে উল্লেখ করে দলীয় সব নেতাকর্মীকে তাতে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এতে তিনটি দাবি উত্থাপন করা হয়— তার কারামুক্তি এবং গত দুই বছরে আটক হওয়া শত শত দলীয় কর্মীদের মুক্তি ও সরকারের পদত্যাগ।
ইমরান খানের দাবি, তার বিরুদ্ধে মামলার পেছনে সেনাবাহিনী ও রাজনৈতিক বিরোধীরা রয়েছে। গত জুন মাসে ইমরান খানকে নির্বিচার আটকের বিষয়টি বেআইনি বলে ঘোষণা করে জাতিসংঘের একটি সংস্থা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পাকিস্তানের সাবেক শাসক দলের সাম্প্রতিক প্রতিবাদ তৎপরতা দেশটিতে রাজনৈতিক বিভাজনকে আরও তীব্র করবে। প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ দেশের অস্থিরতা থেকে মুক্তি পেতে কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
এছাড়া, বর্তমান শাসক দল পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) বেলুচিস্তান অ্যাসেম্বলিতে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করতে চলেছে। এতে ইমরান খানের দল পিটিআইকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানানো হবে। তাদের বিক্ষোভের সময় একাধিক আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য নিহত হয়েছেন।
সরকারের চ্যালেঞ্জ ছাড়াও, পিটিআই নিজেও অভ্যন্তরীণ সংকটে ভুগছে, যদিও খাইবার পাখতুনখোয়ার মন্ত্রী আলী আমিন গান্দাপুর জানিয়েছেন, প্রতিবাদ চলবে। কিন্তু পিটিআইয়ের আরেক নেতা শওকত ইউসুফজাই প্রতিবাদে নেতৃত্বের ব্যর্থতার কারণে একটি অভ্যন্তরীণ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন।