Beta
শুক্রবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০২৪
Beta
শুক্রবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০২৪

ডাক্তাররা কেন স্মার্টওয়াচের মতো প্রযুক্তি নিয়ে সতর্ক

Wearables
[publishpress_authors_box]

ওয়্যারেবল বা পরিধানযোগ্য প্রযুক্তি বহু বিলিয়ন ডলারের একটি শিল্প। এই শিল্পের সবচেয়ে জনপ্রিয় ডিভাইস স্মার্টওয়াচ। এর ডিভাইসগুলোর মূল লক্ষ্য মানুষের স্বাস্থ্যের অবস্থার ওপর নজর রাখা।

বলা হয়, এই ডিভাইসগুলো ব্যায়ামের ধরন, শরীরের তাপমাত্রা, হৃদস্পন্দন, ঋতুচক্র এবং ঘুমের গতিপ্রকৃতির ওপর সঠিকভাবে নজর রাখতে পারে।

সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য সচিব ওয়েস স্ট্রিটিং ইংল্যান্ডের এনএইচএসের লক্ষাধিক রোগীকে পরিধানযোগ্য প্রযুক্তি দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন। এর মাধ্যমে রোগীরা বাড়িতে বসে ক্যানসারের চিকিৎসায় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াসহ অন্যান্য লক্ষণের ওপর নজর রাখতে পারবেন।

তবে, অনেক ডাক্তার এবং প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ওয়্যারেবলের মাধ্যমে সংগৃহীত স্বাস্থ্য তথ্য ব্যবহারে এখনও সতর্ক রয়ে গেছেন।

বিবিসির প্রযুক্তি সম্পাদক জো ক্লেইনম্যান বলেন, “আমি বর্তমানে আল্ট্রাহিউম্যান কোম্পানির একটি স্মার্ট রিং ব্যবহার করছি। এটি আমার অসুস্থতার আভাস আগেই দিতে পেরেছে।

“সম্প্রতি এক সপ্তাহান্তে এটি আমাকে জানায়, আমার শরীরের তাপমাত্রা সামান্য বেড়েছে এবং ঘুমও ঠিক মতো হচ্ছিল না। রিংটি আমাকে সতর্ক করে যে, এটি কোনও অসুস্থতার লক্ষণ হতে পারে।”

তিনি বলেন, “আমি ভেবেছিলাম, এটি হয়তো মেনোপোজের আগের কোনও লক্ষণ। বিষয়টি উপেক্ষা করেছিলাম। তবে দুই দিন পর আমি গ্যাস্ট্রিক ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে বিছানায় পড়ে যাই। অবশ্য আমার কোনও চিকিৎসার প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু যদি প্রয়োজন হতো, তাহলে কি এই ডিভাইসের তথ্য চিকিৎসকদের সহায়তা করতে পারত?”

অনেক পরিধানযোগ্য ডিভাইস প্রস্তুতকারক এই ধরনের সহযোগিতার গুরুত্ব তুলে ধরেন জানিয়ে জো বলেন, “উদাহরণস্বরূপ, ‘ওরা’ স্মার্ট রিং এমন একটি সেবা প্রদান করে, যেখানে ব্যবহারকারীরা তাদের ডেটা রিপোর্ট আকারে ডাউনলোড করে ডাক্তারদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারেন।”

ওরা রিং পরা নিয়ে পরামর্শ দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক চিকিৎসক ড. জেক ডয়েচ মনে করেন, পরিধানযোগ্য ডিভাইসের তথ্য তাকে রোগীদের ‘সামগ্রিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতি আরও নির্ভুলভাবে মূল্যায়ন করতে’ সহায়তা করে।

ড. হেলেন সালিসবারি।

তবে, সব চিকিৎসক এ তথ্যকে সবসময় কার্যকর বলে মনে করেন না। অক্সফোর্ডের একটি ব্যস্ত ক্লিনিকের একজন ডাক্তার ড. হেলেন সালিসবারি বলেন, এখনও খুব বেশি রোগী তাদের পরিধানযোগ্য ডিভাইসের তথ্য নিয়ে আসেন না। তবে এটি বাড়ছে, যা তাকে উদ্বিগ্ন করে।

তিনি বলেন, “পরিধানযোগ্য ডিভাইসের তথ্য মাঝেমধ্যে কাজে লাগলেও বেশির ভাগ সময়ই কোনও কাজে লাগে না। আমি উদ্বিগ্ন যে, আমরা হয়তো স্বাস্থ্য নিয়ে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত এবং শরীরের ওপর অতি নজরদারি করা একটি সমাজ গড়ে তুলছি।”

ডা. সালিসবুরি বলেন, মাঝেমধ্যে হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়ার পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। এটি যেমন শরীরের সাময়িক সমস্যার কারণে হতে পারে, আবার যন্ত্রের ত্রুটিজনিত কারণেও হতে পারে। এর জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিশেষ অনুসন্ধানের প্রয়োজন হয় না।

তিনি উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, “মানুষকে যদি সবসময় সবকিছু পর্যবেক্ষণ করতে উৎসাহিত করা হয় এবং যন্ত্র অসুস্থতার সংকেত দিলেই চিকিৎসকের কাছে যেতে বলা হয়, তবে এটি সঠিক নয়। বরং মানুষ নিজে অসুস্থ বোধ করলে তবেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিৎ।”

তিনি আরও বলেন, এমন তথ্যকে অনেকেই আকস্মিক স্বাস্থ্য সমস্যার বিরুদ্ধে এক ধরনের মানসিক নিশ্চয়তা হিসেবে দেখেন। তবে তিনি সতর্ক করেন, স্মার্টওয়াচ বা অ্যাপ ম্যালিগন্যান্ট টিউমারের মতো গুরুতর রোগ নির্ণয়ে সক্ষম নাও হতে পারে।

পরিধানযোগ্য ডিভাইসগুলো ভালো অভ্যাস গড়ে তুলতে সহায়তা করে। তবে এগুলো থেকে সবচেয়ে কার্যকর বার্তা হলো সেই পুরনো পরামর্শ, যা ডাক্তাররা বহু বছর ধরে দিয়ে আসছেন।

ডা. সালিসবুরি বলেন, “আপনার যা করা উচিৎ তা হলো- আরও বেশি হাঁটা, অতিরিক্ত মদপান না করা এবং সুস্থ ওজন বজায় রাখা। এই পরামর্শ কখনও বদলায় না।”

বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বিক্রিত স্মার্টওয়াচ হলো অ্যাপল ওয়াচ। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে এর বিক্রি কিছুটা কমেছে। অ্যাপল এই বিষয়ে কোনও মন্তব্য করেনি।

তবে কোম্পানিটি তাদের হার্ট ট্র্যাকিং ফিচারের মাধ্যমে জীবন রক্ষার সত্যিকারের গল্পগুলো বিজ্ঞাপনে তুলে ধরে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেও এমন উদাহরণ অনেকে শুনেছেন। তবে ভুল সংকেত (ফলস পজিটিভ) পাওয়ার ঘটনার পরিমাণ বিষয়ে তেমন কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি।

রোগীরা পরিধানযোগ্য ডিভাইসের মাধ্যমে সংগ্রহ করা তথ্য চিকিৎসকদের দেখালে, চিকিৎসকরা সাধারণত নিজেদের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে তা পুনরায় পরীক্ষা করতে চান।

স্মার্ট রিং।

শুধুমাত্র পরিধানযোগ্য ডিভাইসের তথ্যের উপর নির্ভর না করার বেশ কয়েকটি ব্যবহারিক কারণ রয়েছে বলে জানান, নটিংহ্যাম ট্রেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিধানযোগ্য প্রযুক্তির সহযোগী অধ্যাপক ড. ইয়াং ওয়েই।

তিনি বলেন, “হাসপাতালে যখন ইসিজি (ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম) মাপা হয়, তখন বিদ্যুৎ খরচ নিয়ে চিন্তা করতে হয় না, কারণ যন্ত্রটিতে সরাসরি বিদ্যুৎ সংযোগ থাকে। কিন্তু ঘড়িতে ইসিজি নিরবচ্ছিন্নভাবে মাপলে ব্যাটারি খুব দ্রুত শেষ হয়ে যায়।”

“এ ছাড়া, ডিভাইসের নড়াচড়া বা ব্যবহারকারীর চলাফেরা ডেটায় “অপ্রাসঙ্গিক শব্দ” সৃষ্টি করতে পারে, যা একে কম নির্ভরযোগ্য করে তোলে”, যোগ করেন তিনি।

বিবিসির প্রযুক্তি সম্পাদক জো ক্লেইনম্যান বলেন, ডা. ওয়েই আমার আঙুলের রিংটি দেখিয়ে বলেছেন, “হৃৎস্পন্দন মাপার জন্য সঠিক পদ্ধতি হলো কবজির কাছ থেকে বা সরাসরি হৃদযন্ত্র থেকে মাপা। আঙুল থেকে মাপলে পুরোপুরি সঠিক হয় না।”

ডা. ওয়েই বলেন, “তথ্যের এমন ফাঁক পূর্ণ করার দায়িত্ব সফটওয়্যারের। তবে পরিধানযোগ্য ডিভাইসের সেন্সর ও সফটওয়্যার কিংবা সংগৃহীত ডেটার ফরম্যাটের জন্য কোনও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নেই।”

তিনি আরও বলেন, “একটি ডিভাইস যত বেশি সময় একটানা ব্যবহার করা হয়, তার ডেটা তত বেশি সঠিক হয়। তবে এখানে একটু সতর্কও থাকতে হবে।”

যেমন, বেন উড একদিন বাইরে ছিলেন। এসময় তার স্ত্রীর কাছে তার অ্যাপল ওয়াচ থেকে কিছু উদ্বেগজনক নোটিফিকেশন আসতে থাকে। সেগুলোতে বলা হয়, বেন গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়েছেন এবং তাকে ফোন না করে টেক্সট করা উচিত। কারণ জরুরি সেবার জন্য লাইন পরিষ্কার রাখা প্রয়োজন।

পরিধানযোগ্য ডিভাইস হিসেবে স্মার্টওয়াচ আছে পছন্দের শীর্ষে।

নোটিফিকেশনগুলো ভুয়া ছিল না। বেনের জরুরি যোগাযোগ হিসেবে তার স্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছিল। তবে এ ক্ষেত্রে তা অপ্রয়োজনীয় ছিল। বেন একটি রেস ট্র্যাকে দ্রুত গাড়ি চালাচ্ছিলেন। তিনি স্বীকার করেন যে, তিনি তেমন দক্ষ ছিলেন না। তবে সবসময় নিরাপদ মনে করেছিলেন। আর এ কারণেই তার অ্যাপল ওয়াচ তার স্ত্রীকে নোটিফিকেশন পাঠায়।

তিনি একটি ব্লগ পোস্টে লিখেছেন, “ঘটনা এবং সতর্কতার মধ্যে সীমারেখা সঠিকভাবে বজায় রাখতে হবে।”

কিংস ফান্ডের ডিজিটাল প্রযুক্তি ফেলো প্রিতেশ মিস্ট্রি বলেন, রোগীর থকে আসা বর্তমান তথ্যকে আমাদের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করা নিয়ে উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যুক্তরাজ্যে এই আলোচনা কয়েক বছর ধরে চলছে, তবে কোনও সুস্পষ্ট সমাধান আসেনি।

তিনি বলেন, যুক্তরাজ্য সরকার স্বাস্থ্যসেবাকে হাসপাতাল থেকে কমিউনিটিতে নেওয়ার চেষ্টা করছে। সেই প্রেক্ষিতে ওয়্যারেবল প্রযুক্তির ব্যবহারকে সমর্থন করার একটি ভালো যুক্তি রয়েছে।

“তবে, প্রযুক্তিগত অবকাঠামোর ভিত্তি না থাকলে এবং কর্মীদের দক্ষতা, জ্ঞান, ক্ষমতা ও আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর উদ্যোগ না নিলে এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত