পুরুষতান্ত্রিক এই দুনিয়ায় নারীদের চলার পথে বাধা প্রতি পদেই। সেই বাধা ঠেলতে ঠেলতেই এগিয়ে যেতে হচ্ছে নারীদের। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও এই পথ চলা যে সুগম নয়, তা ফুটে ওঠে দেশটির প্রায় আড়াইশ বছরের ইতিহাসে এখনও কোনও নারীর প্রেসিডেন্ট না হওয়াটা।
ইতিহাস গড়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর এখন প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড়ে রয়েছেন কমলা হ্যারিস। তার এই এগিয়ে চলাকে নারীর অগ্রযাত্রাও হিসাবে দেখে সমর্থন নিয়ে পেছনে দাঁড়াচ্ছেন সেলেব্রিটি অনেকে। জেনিফার লোপেজের মতো তারকা গায়িকা-অভিনেত্রী এবারের ভোটে কমলাকে সমর্থন জানিয়ে বলছেন, “আমি নারীর শক্তিতে বিশ্বাস করি।”
গত বৃহস্পতিবার কমলা হ্যারিসের নির্বাচনী সমাবেশে হাজির হয়েছিলেন জেনিফার লোপেজ। আরেক তারকা গায়িকা টেইলর সুইফটও সমর্থন জানিয়েছেন কমলা হ্যারিসকে। তিনিও বলছেন, “আমি কমলা হ্যারিসকে ভোট দেব, কারণ তিনি অধিকারের জন্য লড়াই করেন।” কমলাকে ‘যোদ্ধা’ অভিহিত করে তিনি বলেন, “আমি বিশ্বাস করি, চ্যাম্পিয়ন হবার জন্য একজন যোদ্ধার প্রয়োজন।”
কমলার প্রতি সমর্থন দিয়েছেন সাবেক ফার্স্টলেডি মিশেল ওবামাও। ডেমোক্রেট প্রার্থীর পক্ষে কথা বলেছেন অভিনেতা জর্জ ক্লুনি। তিনি সিএনএনকে বলেছেন, ঐতিহাসিক এই সফরে তিনি কমলার পাশে রয়েছেন। কমলা সমর্থন পাচ্ছেন অভিনেতা রবার্ট ডি নিরো, লিওলার্ডো ডিক্যপ্রিওর।
কিন্তু একজন নারী প্রেসিডেন্ট দেখতে যুক্তরাষ্ট্র কতটা প্রস্তুত? ইতিহাসের দিকে চোখ রাখলে সেই প্রশ্ন এসেই যায়। ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট হওয়ার খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন হিলারি ক্লিনটন; কিন্তু শেষে যার কাছে হার মানতে হয়েছিল, সেই ডোনাল্ড ট্রাম্পই বাধা কমলার সামনে।
অনেক নারীর অভিযোগ মাথায় নিয়ে চলা ট্রাম্পকেই ভোট দিতে চান নিউ ইয়র্কে বসবাসরত বাংলাদেশি যুঁথী আবেদীন। কেন- সকাল সন্ধ্যার এই প্রশ্নে তিনি বলেন, তার দৃষ্টিতে কমলা হ্যারিস ‘অ্যারোগেন্ট’। তিনি এতদিনেও দেশের জন্য ভালো কিছু করেননি।
তবে এবারের নির্বাচনী লড়াইটা জমে উঠেছে মন্তব্য করে যুঁথী বলেন, “লড়াই হবে, বেশ ভালোভাবেই হবে।”
ভোটের পাঁচ দিন আগেও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি ফ্লোরিডায় বসবাসরত বাংলাদেশি পারভীন বেগমের। তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “শুনছি সবার কথাই, তবে এখনও সিদ্ধান্ত নিইনি। ভোটকেন্দ্রে যাব, মন যাকে চাইবে, সে মুহূর্তে তাকেই ভোট দেব।”
আগামী ৫ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোটগ্রহণ হবে। প্রার্থী সাতজন হলেও ডেমোক্রেট প্রার্থী কমলা হ্যারিস আর রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্পের ওপরই সবার নজর।
বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যবসায়ী ইলন মাস্কের সমর্থন বাগিয়ে নিয়েছেন ট্রাম্প। তার পক্ষে রয়েছে আরও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানও। তবে বিভিন্ন জরিপে তারকা সমর্থন বা নারী সমর্থন- দুটোতেই এগিয়ে আছেন কমলা। তিনি এগিয়ে আগাম ভোটেও। যদিও এ এগিয়ে থাকাই যে শেষ হাসি হাসাবে, তেমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ফলাফল ঠিক করে দেয় সাতটি অঙ্গ রাজ্য, যেগুলোকে সুইং স্টেট নামেই ডাকা হয়।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে হরেক রকমের অভিযোগ। দেশটিতে দুই বার অভিশংসিত হওয়া একমাত্র প্রেসিডেন্ট তিনি। ফৌজদারি মামলায় দোষি সাব্যস্তও হয়েছেন তিনি। এত অভিযোগ নিয়ে কেউ কোনও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে আসীন হতে পারেন না বলে অনেকের মত।
গত নির্বাচনে জো বাইডেনের কাছে হারের পর ফল না মেনে পার্লামেন্ট ভবনে হামলার যে উসকানি তিনি দিয়েছিলেন, তাতে এবারও যদি তিনি না জেতেন, তবে গণ্ডগোল বাঁধিয়ে দিতে পারেন বলে আশঙ্কা রয়েছে। কারণ এবারও তিনি বলে রেখেছেন, তিনি না জিতলে বুঝতে হবে ভোটে চুরি হয়েছে।
এই বক্তব্যতেই তার মনোভাবটি বোঝা যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন ইউনিভার্সিটি অব সাদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার ভিজিটিং স্কলার ও সাংবাদিক রেদওয়ান আহমেদ।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, বাংলাদেশি-আমেরিকানদের জন্য কমলা হ্যারিস বা ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্ব ভিন্ন ভিন্ন প্রভাব ফেলবে।
“কমলার ইমিগ্রেশন পলিসি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশিদের সুবিধা দেবে। অন্যদিকে, অভিবাসনপ্রত্যাশী এবং আনডকুমেন্টেড ইমিগ্র্যান্টদের জন্য ট্রাম্পের জয় আনন্দদায়ক হবে না। আগের টার্মে ট্রাম্প প্রশাসন অভিবাসন প্রক্রিয়া জটিল ও কঠিন করার চেষ্টা করেছিল। যার ফলে ইমিগ্র্যান্ট এবং এমনকি নন-ইমিগ্র্যান্ট ভিসা পাওয়াও ক্ষেত্র বিশেষে হয়েছিল কঠিন।”
অনেক ক্ষুদ্র এবং মাঝারি বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা ট্রাম্পকে পছন্দ করেন জানিয়েও রেদওয়ান বলেন, “বেশিরভাগ বাংলাদেশি-আমেরিকানরা চান, কমলা হ্যারিসই নির্বাচনে জিতুক।”
ট্রাম্প হেরে গেলে রিপাবলিকানরা নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা চালাবে বলে মনে করেন তিনি।
“রিপাবলিকান স্ট্র্যাটেজিস্টরা অলরেডি এমন সব কাজ করে রাখছেন, যেন তারা নির্বাচনে হেরে গেলে পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়াটাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারেন। বিভিন্ন স্ষ্টেটে আগাম ভোটের প্রক্রিয়ায় ‘ফ্রড’র অভিযোগ তুলে তারা ইতোমধ্যেই মামলার আশ্রয় নিয়েছেন, যদিও যেগুলোর বেশিরভাগই খুব ঠুনকো।”
আগাম ভোটে রেকর্ড
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে আগাম ভোট দেওয়া যায়। যারা ভোটের দিন সরাসরি ভোট দিতে অপারগ, তাদের জন্য এই সুবিধা। গত ২৭ অক্টোবর থেকে শুরু করে শনিবার পর্যন্ত চলবে এই ভোট। সেখানে দেখা গেছে, এবারে আগাম ভোটে রেকর্ড হয়েছে। শুক্রবার পর্যন্ত আগাম ভোট পড়েছে ৬ কোটিরও বেশি।
যুক্তরাষ্ট্রে গবেষণারত বাংলাদেশি নাদিম মাহমুদ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, এমআইটি ইলেকশন ল্যাবের তথ্য বলছে, ২০২০ সালের ভোটের সময় সরাসরি কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে ভোটের দিন ভোট প্রদান করেছেন ৩০. ৪০ শতাংশ, আগাম ভোট দিয়েছেন ২৬ শতাংশ আর পোস্টােল ব্যালটে ভোট দিয়েছেন ৪৩ শতাংশ ভোটার। এর আগে ২০১৬ সালে কেন্দ্রে ভোটের হার ছিল ১৬.৫০ শতাংশ, আগাম ভোট ৫৯.৬০ শতাংশ এবং পোস্টাল ব্যালটে ২১ শতাংশ।
মূলত কোভিড মহামারীর কারণে ২০২০ সালের নির্বাচনে পোস্টাল ব্যালটে ভোট বেড়েছিল। তবে এবার ঠিক কত শতাংশ ভোটার পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেবে, তা জানতে ৫ নভেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
নাদিম মাহমুদ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে ২৩ কোটিরও বেশি মানুষ ভোট দেওয়ার যোগ্য। এখানে ভোটার সংখ্যা ১৬ কোটির মতো। কারণ সবাই ভোট দিতে নিজের নাম নিবন্ধন করান না। আবার সব ভোটারই যে ভোট দেন, তাও নয়।