ইসরায়েল গত দুই সপ্তাহ ধরে ব্যাপক মাত্রায় বিমান হামলা চালাচ্ছে লেবাননে। দেশটির দক্ষিণাংশে ও রাজধানী বৈরুতে চালানো ইসরায়েলি হামলায় এরই মধ্যে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এতে নিহত হয়েছেন দেশটির শক্তিশালী সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহপ্রধান শেখ হাসান নাসরাল্লাহ।
লেবাননে হিজবুল্লাহ ছাড়াও আছে দেশটির নিয়মিত সেনাবাহিনী। কিন্তু দক্ষিণ লেবাননে ইসরায়েলি বাহিনীর বিরুদ্ধে হিজবুল্লাহর যোদ্ধারা প্রতিরোধ গড়লেও নিয়মিত সেনাবাহিনী অনুপস্থিত।
কেন লেবাননের সেনাবাহিনী অনুপস্থিত, এর পেছনে আছে এক জটিল সমীকরণ। সেনাবাহিনী চাইলেও ইসরায়েলের হাত থেকে নিজ ভূখণ্ডের একাংশকে রক্ষা করতে পারছে না। উল্টো সেখান থেকে সেনা সদস্যরা চলে যাচ্ছে, এমন খবরও পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন মিডিয়ায়। যদিও এ নিয়ে দেশটির কোনও আনুষ্ঠানিক বিবৃতি জানা যায়নি।
বিমান হামলার পাশাপাশি ইসরায়েলি সেনারা লেবাননে স্থল অভিযানও চালাচ্ছে। এসব হামলায় এরই মধ্যে হিজবুল্লাহর বেশ কয়েকজন শীর্ষ কমান্ডারসহ দুই হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। পাশাপাশি আহতের সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি। আর বাস্তুচ্যুত হয়েছে ১০ লক্ষাধিক।
এমন অবস্থায় লেবাননের নিয়মিত সেনাবাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে ইউরো নিউজের এক প্রতিবেদনে। প্রশ্ন তোলা হয়েছে, লেবাননে আদৌ কি কোনও সেনাবাহিনী আছে? থাকলে কেন তাদের কোথাও দেখা যাচ্ছে না?
সংকট কোথায়
লেবাননের সেনাবাহিনীর একজন জেনারেল ও বৈরুতের সেন্ট জোসেফ ইউনিভার্সিটির ভূ-রাজনীতির অধ্যাপক খলিল হেলো ইউরো নিউজকে বলেছেন, “লেবাননের সেনাবাহিনীর ভূমিকা শুধু দেশের সীমানা রক্ষা করা নয়।
“এটি পশ্চিমা কোনও দেশের সেনাবাহিনীর মতো ক্ল্যাসিক নয়। লেবাননের সেনাবাহিনী দেশটির সরকারের নির্দেশনার অধীন। কিন্তু দেশটির সরকারে দীর্ঘকাল ধরেই চরম বিভাজন চলছে।
“ফলে সেনাবাহিনীকে নিজের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এখন সেনাবাহিনীর নেতৃত্বকেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়, এমন পরিস্থিতিতে তাদের জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ কী হতে পারে।”
লেবাননের নেতৃত্বকে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচনায় রাখতে হয়। আর এসব বিবেচনার সবগুলোরই পরিণতি গুরুতর।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর স্থল হামলার ফলে দক্ষিণ লেবানন ও বেক্কা ভ্যালি থেকে দেশের বাকি অংশে সহিংসতা ছড়ালে গোটা মধ্যপ্রাচ্য হুমকির মুখে পড়বে।
দক্ষিণ লেবানন ও বেক্কা ভ্যালি ২০০৬ সালের যুদ্ধের পর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত ১৭০১ নম্বর প্রস্তাবের আইনি আশ্রয়ের অধীনে রয়েছে।
এই প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ লেবাননে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনী ইউনাইটেড নেশনস ইনট্রিম ফোর্স ইন লেবানন (ইউএনআইএফআইএল) গঠন করা হয়। এতে লেবাননের নিয়মিত সেনাবাহিনীকেও একটি সক্রিয় ভূমিকায় রাখা হয়।
এছাড়া লেবানন সরকার ও ইউএনআইএফআইএলকে তাদের বাহিনী একসঙ্গে মোতায়েন করার আহ্বানও জানানো হয়। যাতে ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) সরে যাওয়ার পর লেবানন সরকারের সম্মতি ছাড়া সেখানে কোনও সশস্ত্র গোষ্ঠী না থাকে এবং অন্য কারও কর্তৃত্বও না থাকে।
কিন্তু এখন লেবাননের সশস্ত্র বাহিনী একটি দ্বিধার মুখোমুখি হয়েছে— তাদেরকে হয় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর মোকাবিলা করতে হবে নতুবা হিজবুল্লাহকে বলপ্রয়োগ করে নিরস্ত্র করতে হবে। উভয় ক্ষেত্রেই তাদের জাতিসংঘের প্রস্তাব মেনে চলতে হবে। কিন্তু তারা দুটোর কোনোটিই করতে চাইছে না বা পারছে না বলেই মনে হচ্ছে।
ক্ষমতার সূক্ষ্ম ভারসাম্য ও শত্রুভাবাপন্ন প্রতিবেশী
১৯৭৫ ও ১৯৯০ সালের মধ্যে গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত লেবানন হয়ে ওঠে প্রধান আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিদের খেলার মাঠ।
লেবাননের বর্তমান সরকার গঠিত হয়েছে দেশটির বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের মধ্যে সূক্ষ্ম ভারসাম্যের ভিত্তিতে। আর সেনাবাহিনী সাংবিধানিকভাবে সেই রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের অধীনস্থ, যার সদস্যদের মধ্যে চলমান সংকট নিয়ে পরস্পর বিরোধী মত রয়েছে।
জেনারেল খলিল হেলো বলেন, “স্থল হামলার পর দক্ষিণে মোতায়েন সেনা ইউনিটগুলোকে নিজেদের রক্ষা করা উচিৎ ছিল। তাদের দায়িত্বে থাকা লেবাননের ভূখণ্ডও রক্ষা করা উচিৎ।
“কিন্তু দক্ষিণে মোতায়েন করা ব্রিগেডগুলোর লক্ষ্য হল মূলত জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীর সঙ্গে একত্রে কাজ করা। কোনও বল প্রয়োগের রাস্তায় তারা হাঁটতে চায় না। ফলে এটি কোনও যোদ্ধা বাহিনী নয়। এটি এমন বাহিনী নয় যা ইসরায়েলের মুখোমুখি হতে পারবে। এক্ষেত্রে শক্তির ভারসাম্য আদৌ আমাদের পক্ষে নয়।”
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ১৭০১ নম্বর প্রস্তাব মেনে হিজবুল্লাহর দক্ষিণ লেবানন থেকে সরে যাওয়া উচিৎ ছিল। বিশেষ করে ইসরায়েলকে লক্ষ্যবস্তু করতে সক্ষম তাদের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা সরানো উচিৎ ছিল। কিন্তু তারা সেই প্রতিশ্রুতি মেনে চলেনি।
হিজবুল্লাহ আনুষ্ঠানিকভাবে লেবাননের একটি বৈধ এবং সাংবিধানিক রাজনৈতিক শক্তি। এর অধিকাংশ সদস্য লেবানিজ শিয়া মুসলমান। এই বাহিনী লেবাননের সেনাবাহিনীর কমান্ড কাঠামোর বাইরে অত্যন্ত সক্রিয় একটি বাহিনী হিসাবে কাজ করছে।
হিজবুল্লাহ যখন ইসরায়েলকে টার্গেট করার একতরফা উদ্যোগ নেয়, তখন লেবাননের অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তি ও সেনাবাহিনী সম্পূর্ণভাবে নিষ্ক্রিয় থাকে।
অন্যরা হিজবুল্লাহর পরাজয়কে মাথাব্যথা হিসাবে দেখবে না। তবে লেবাননের বাকীরাও জানেন, একটি আন্তঃসাম্প্রদায়িক সীমারেখা রয়েছে যা অতিক্রম করা যায় না।
খলিল হেলো বলেন, “হিজবুল্লাহর মোকাবিলা করতে গেলে গৃহযুদ্ধ বাধবে। সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব জানে, সবচেয়ে বড় বিষয় হলো স্থিতিশীলতা এবং সেনাবাহিনী ও হিজবুল্লাহর মধ্যে সংঘর্ষ এড়ানো।”
হিজবুল্লাহ ও লেবাননের নিরাপত্তা কাঠামোর মধ্যে সম্পর্কগুলোও সহযোগিতার কিছু গঠনমূলক মুহূর্তের মাধ্যমে চিহ্নিত।
ইতালির মিলানভিত্তিক আন্তর্জাতিক রাজনীতি গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষক ক্লাউদিও বোর্তোলোতি ইউরো নিউজকে বলেন, “সিরিয়া ও ইরাকে ইসলামিক স্টেটের সর্বাধিক সম্প্রসারণের সময় হিজবুল্লাহ এবং লেবাননের সেনাবাহিনীর মধ্যে সহযোগিতার কথাই ভাবুন। সেসময় ইসলামিক স্টেট গ্রুপ ও আল-নুসরার সঙ্গে যুক্ত উপাদানগুলো লেবাননে উপস্থিত ছিল। প্রস্তুতি, প্রশিক্ষণ ও নিয়োগের জন্য লেবাননের মধ্যেই কাজ করছিল।”
হিজবুল্লাহর সশস্ত্র শাখার একটি অদ্ভুত আধাসামরিক কাঠামো রয়েছে। তাদের বিশাল ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের ভাণ্ডার রয়েছে। তবে তারা গেরিলা ইউনিটগুলোকেই পদাতিক বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করে। এদের কোনও বিমান বা ট্যাঙ্ক বাহিনী নেই।
বিপরীতে লেবাননের নিয়মিত সেনাবাহিনীর একটি পূর্ণাঙ্গ সামরিক কাঠামো রয়েছে কিন্তু অস্ত্রশস্ত্র অপর্যাপ্ত।
ইউরোপের ভূমিকা
লেবাননের নিরাপত্তা সংবাদদাতা অ্যাগনেস হেলো ব্যাখ্যা করেছেন, “ইউরোপীয় ইউনিয়ন সবসময়ই লেবাননের সেনাবাহিনীর সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করে আসছে। এটা নতুন কিছু নয়। তারা লেবাননের সেনাবাহিনীকে সাহায্য করেছে।
“জার্মানি লেবাননের সেনাবাহিনীকে সব টাওয়ার, নৌবাহিনীর নজরদারি টাওয়ারগুলো, সেইসঙ্গে স্থলভাগে সিরিয়ার সঙ্গে স্থল সীমান্ত ও ভূমধ্যসাগরের নৌস্থলগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করতে সাহায্য করেছে।
“ফলে লেবানন সরকার ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ছাড়া ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না।”
ইইউতে নিযুক্ত লেবাননের রাষ্ট্রদূত ফাদি আজালি ইউরো নিউজকে বলেন, “১৭০১ নম্বর প্রস্তাব বাস্তবায়নে কেন্দ্রীয় ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে লেবাননের সেনাবাহিনীকে অর্থ দেয় ইউরোপিয়ান পিস ফ্যাসিলিটিজ (ইপিএফ)। তাদের লক্ষ্য লেবাননসহ এই অঞ্চলে শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখা।”
তিনি বলেন, “লেবাননের সেনাবাহিনীর ওপর অতিরিক্ত দায়িত্ব চাপানো হয়েছে। তাদেরকে লেবাননের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিষয়ক, যেমন ইইউতে অভিবাসীদের উপচে পড়া ঠেকাতেও কাজ করতে হয়।
“এজন্য লেবাননের সেনাবাহিনীকে সিরিয়ার শরণার্থী ও ফিলিস্তিনি ক্যাম্পগুলোরও দেখভাল করতে হয়।”
বেক্কায় লেবানিজ সেনাবাহিনী
বেক্কায় থাকা সেনাবাহিনী নতুন ফ্রন্টে কাজ করতে অক্ষম। আর তাছাড়া লেবাননের নিয়মিত সেনাবাহিনী আইডিএফ ও হিজবুল্লাহর মধ্যে সরাসরি স্থল সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লে পশ্চিম, সৌদি আরব এবং উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর অর্থ সহায়তা হারাতে পারে।
ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র লেবাননের ভূখণ্ডে আঘাত করছে, কিন্তু লেবাননের সেনাবাহিনী তাদের গুলি করার চেষ্টাও করছে না। কেন?
এবিষয়ে খলিল হেলো বলেন, “ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা এবং বিমান প্রতিরক্ষা একই জিনিস। এটি উড়ন্ত লক্ষ্যবস্তুর বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা। কিন্তু লেবাননের সেনাবাহিনীর নিজস্ব কিছু নেই।
“হিজবুল্লাহর কাছেও নেই। সিরিয়ানদের কাছে এস-৩০০ আছে। কিন্তু তা মোটেও কাজ করেনি।”
বোর্তোলোতি বলেন, “বেক্কা ভ্যালি এমন একটি ব্রিগেড দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, যেটি মূলত মানসম্পন্ন কর্মীদের নিয়ে গঠিত একটি অপারেশনাল ব্রিগেড। প্রশ্ন হলো, এতে কি পর্যাপ্ত সংখ্যক সেনা আছে এবং এটি কি একই সঙ্গে একটি বহিরাগত ও অভ্যন্তরীন হুমকির মোকাবিলা করতে প্রস্তুত?
“ইসরায়েলের স্থল আক্রমণের ফলে নিয়মিত সেনারা বেক্কা ভ্যালি থেকে সরে যেতে পারে। একে ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে একটি যুদ্ধক্ষেত্র হিসাবে ছেড়ে দিতে পারে। এমনটা ঘটার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি।”
২০০৬ সালের ইসরায়েলি আগ্রাসনের সময় লেবাননের নিয়মিত সেনাবাহিনীর কয়েকটি ঘাঁটিতে বোমা হামলা হয়। কিন্তু তারপরেও তারা আইডিএফের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়নি। আবার ১৭০১ নম্বর প্রস্তাবে বাধ্যতামূলক বিধান থাকা সত্ত্বেও লেবাননের সেনাবাহিনী হিজবুল্লাহকে নিরস্ত্র করার জন্যও তার শক্তি ব্যবহার করেনি।
এবারও লেবাননের নিয়মিত সেনাবাহিনীর সদস্যরা এরই মধ্যে হিজবুল্লাহ অধ্যুষিত দক্ষিণাঞ্চল থেকে সরে যেতে শুরু করেছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে দাবি করা হচ্ছে।