সুপারহিরো ব্লকবাস্টার সিনেমা হোক অথবা নেটফ্লিক্সের রোমান্টিক কমেডি, স্ক্রিনে ভেসে ওঠা দৃশ্যে স্কটল্যান্ড দেখা যাবেই।
গত বছরের শরতে ‘টুইস্টার্স’ অভিনেতা গ্লেন পাওয়েল গ্লাসগোতে ‘দ্য রানিং ম্যান’ নামে একটি সাই-ফাই সিনেমার দৃশ্য ধারণ করছিলেন। নতুন নির্মাণে ফ্র্যাংকেনস্টাইনকে দেখানো হবে, পেছনে থাকবে আর এডিনবার্গ এবং অ্যাবারডিনশায়ারের দৃশ্যপট।
গত এক দশকে স্কটল্যান্ডে শুটিং করা চলচ্চিত্র এবং টিভি শো-এর তালিকা আরও দীর্ঘ হয়েছে।
দেশটির পর্যটন কর্তৃপক্ষ আশা করছে, সফল প্রযোজনাগুলো সংস্থাগুলো নিউজিল্যান্ডের বিকল্প হিসেবে সামনের দিনে স্কটল্যান্ডকে দেখবে। প্রসঙ্গত নিউজিল্যান্ডে লর্ড অব দ্য রিংস এবং হবিট এর মতো বিগ বাজেটের সিনেমাগুলোর শুটিং হয়েছিল। সিনেমা নির্মাতারা স্কটল্যান্ডকে নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের মতো করেও ভাবে। ’গেম অব থ্রোনস’ দেখার পর সিনেমার সেসব জায়গা দেখতে নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডে ভক্তদের ভ্রমণ বেড়ে গিয়েছিল।
স্কটল্যান্ডের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অভিভূত হওয়ার মতই। এখানকার প্রধান শহরগুলো থেকে আসা-যাওয়া দ্রুতই করা যায়।
রয়েল কনজারভেটরি অব স্কটল্যান্ডের চলচ্চিত্র বিভাগের প্রধান রে ট্যালান মনে করেন, বড় পর্দার জন্য এই শহর উপযুক্ত।
স্কটল্যান্ডে স্টুডিও সংখ্যা বেড়ে যাওয়াকে ইতিবাচক মনে করছেন ট্যালান। লিথ এলাকায় ফার্স্ট স্টেজ স্টুডিও এবং কম্বারনল্ড শহরে ওয়ার্ডপার্ক ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন স্টুডিওতে অসংখ্য কাজ হচ্ছে বলে জানালেন তিনি।
“শুধু স্কটল্যান্ডের প্রাকৃতিক দৃশ্যই নয়, এখানে স্টুডিও সুবিধাও পাচ্ছে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো; যা কাজে খুব সহায়ক হয়ে উঠছে। এখানে যত বেশি প্রযোজনা সফলভাবে শুট হচ্ছে, ততই এই সেক্টরের প্রতি আস্থা বাড়ছে এবং খ্যাতিও ছড়িয়ে পড়ছে।”
বিবিসি স্কটল্যান্ডের কাছে এভাবেই ব্যাখ্যা করে বললেন ট্যালান।
আরও একটি কারণের কথা বলছে বিবিসির প্রতিবেদন; তা হচ্ছে- সেটি হচ্ছে অর্থের সাশ্রয়।
যুক্তরাজ্যের বাকি অংশের মতো, স্কটল্যান্ডও প্রযোজনায় ট্যাক্স মওকুফ করে থাকে। এ কারণেই স্কটল্যান্ডের প্রতি দুর্বল হয়ে উঠছে সবাই। পাশাপাশি এখানে অনুদান পাওয়াও বেশ সহজ।
গ্লাসগো সিটি কাউন্সিল ওয়ার্নার ব্রসকে প্রায় দেড় লাখ পাউন্ড দিয়েছিল ডিসি কমিকসের ’ব্যাটগার্ল’ সিনেমা এখানকার শহরে শুটিং করতে। অবশ্য স্টুডিও কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্তে এই সিনেমা কখনোই মুক্তি দেওয়া হয়নি।
বিশ্বখ্যাত ওয়ার্নার ব্রস স্টুডিওর প্রযোজনায় তৈরি সিনেমা- ‘দ্য ব্যাটম্যান’, মার্ভেল স্টুডিওর ‘অ্যাভেঞ্জারস: ইনফিনিটি ওয়ার’, ‘অ্যাভেঞ্জারস: এন্ড গেম’, নেটফ্লিক্সের ‘দ্য প্রিন্সেস সুইচ ট্রিওলজি’, ‘ওয়ান ডে’ দৃশ্যধারণ হয়েছে স্কটল্যান্ডেই।
বিশাল প্রযোজনার আয়োজন যখন শহরের একটি অংশ দখল করে শুটিং করে তখন স্থানীয় ব্যবসার ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়ে?
‘ব্যাটগার্ল’ সিনেমা নিয়ে গ্লাসগো সিটি কাউন্সিল ডেইলি রেকর্ডকে বলেছিলেন, ”এই প্রযোজনা বিশাল এই শহরে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সুবিধা এনে দিয়েছে।”
তবে শুটিং হওয়ার স্থানের ব্যবসায়ীরা ততটা সন্তুষ্ট ছিল না। তারা বিবিসিকে এই সিনেমার কারণে ’ব্যবসায় আর্থিক ক্ষতির কথা’ জানিয়েছিলেন ।
শেষ পর্যন্ত এখানে ‘ব্যাটগার্ল’ সিনেমার কাজ বন্ধ হয়ে যায়।
কিং স্ট্রিটের দ্য সোশাল রিক্লজ ব্র্যান্ডের পোশাকের দোকানটি শুটিং চলাকালে ১০ দিন বন্ধ রাখতে হয়েছিল। এতে তাদের এক হাজার পাউন্ড ক্ষতিপূরণ দেয়া হলেও দোকানের কর্মীরা বলেছিল, আর্থিক ক্ষতির সাপেক্ষে এই ক্ষতিপূরণ কিছুই না।
‘ইন্ডিয়ানা জোনস’ এবং ‘রানিং ম্যান’ রিমেক চলাকালে গ্লাসগো শহরের অনেক কিছু পাল্টে ফেলা হয়; সড়কের অনেক অংশ বন্ধ রাখা হয়। তখন প্রশ্ন ওঠে, এতে করে ভুক্তভোগীরা কী সুবিধা পাচ্ছে?
এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. এউলিনা ল্যাকা বলেন, “একটি সিনেমা এখানে নির্মাণ হচ্ছে এটাই মূল কথা নয়। কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়, যা আসলে বিপণনের সঙ্গে জড়িত।
“এর মধ্যে দিয়ে ভিজিট স্কটল্যান্ড সংস্থার গুরুত্বকে তুলে ধরা হয়। পর্যটনের জন্য বিপণন কৌশল শুটিংয়ের আগে ও পরে কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা হয়।”
জনপ্রিয় ‘আউটল্যান্ডার’ টিভি শো নির্মাণ হয়েছিল আমেরিকান লেখক ডায়ানা গ্যাবালডনের বই থেকে।
এরপর অনেক কোম্পানি আউটল্যান্ডার ট্যুরের আয়োজন করছে, টিভি শোতে যত স্থান দেখানো হয়েছিল পর্যটকদের সেখানে নিয়ে যাচ্ছে।
ড. ল্যাকা বলেন, “একে আসলে ডাইভারশন ইফেক্ট বলে। শুটিং লোকেশনগুলো দেখা ভ্রমণের অংশ করে নিচ্ছে লোকে।”
এই সিরিজ নিয়ে ট্যালান বলেন, “এর কারণে পর্যটন শিল্পে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সবাই শুটিংয়ের জায়গাতেই ঘুরতে যাচ্ছে।”
স্কটল্যান্ডের চলচ্চিত্র শিল্প হলিউড থেকে বিনিময়ে কী পাচ্ছে?
স্ক্রিন স্কটল্যান্ড মনে করে, স্কটল্যান্ডের স্থানীয় চলচ্চিত্র শিল্প এমন বড় বড় প্রযোজনা থেকে লাভবানই হচ্ছে।
কনওয়ে বলেন, “প্রশিক্ষণার্থী এবং স্কটিশ ক্রুদের জন্য অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। এতে পেশাগত জীবনে ভালো করবে তারা।”
একই কথা বললেন ট্যালান।
“যথেষ্ট অভিজ্ঞরা বড় বড় প্রযোজনায় কাজ পেয়ে যান। এতে করে নতুনরা ছোট পরিসরের কাজে সুযোগ গড়ে নিতে পারে সহজেই।”
গ্লাসগো সম্প্রতি স্টিফেন কিং রচিত বইয়ের গল্প থেকে ‘দ্য রানিং ম্যান’ সিনেমার শুটিংয়ের জন্য হালে গ্লাসগো দখল করা হয়েছিল। আগে ১৯৮০ সালের দশকেও আর্নল্ড শোয়ার্জনেগারকে নিয়ে এই অ্যাকশন সিনেমা নির্মাণ হয়েছিল।
এবার গ্লেন পাওয়েল সেই চরিত্রে অভিনয় করলেন। সিনেমার চিত্রনাট্য অনুযায়ী, তাকে একটি নিষ্ঠুর ‘গেম শো’তে বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করতে হয়। গ্লাসগো এখানে ভবিষ্যতের শহরের মতো করে সেজে ওঠে।
এডিনবার্গ এবং অ্যাবারডিনশায়ারও ১৮শ শতকের জার্মানি হয়ে উঠবে। এখানে নির্মাণ হবে নতুন গথিক হরর সিনেমা ‘ফ্র্যাংকেনস্টাইন’, যা নেটফ্লিক্সের জন্য পরিচালনা করছেন গুয়েইলমো ডেল তোরো।
স্কটল্যান্ডে থাকতে মজার এক অভিজ্ঞতা ‘হেলবয়’ চলচ্চিত্রটির পরিচালক গুয়েইলমোর। সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট করে তিনি বলে, যে হোটেলে আছেন তা হয়তো ভূতুড়ে।
‘লকারবি: আ সার্চ ফর ট্রুথ’ আসছে জানুয়ারিতেই, এরও শুটিং হয়েছে স্কটল্যান্ডে লিনলিথগো শহরে।
(বিবিসি অবলম্বনে)