Beta
মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪

প্রথম মন্ত্রিসভায় আমার একজন মফিজ ভাই

ডক্টর মফিজ চৌধুরী। আলোকচিত্র: সংগৃহীত ও সম্পাদিত।

ডক্টর মফিজ চৌধুরীর সঙ্গে যখন আমার পরিচয়, সবুজাভ মলাটের কোরিয়ার কবিতা অনুবাদক জাহাঙ্গীর চৌধুরী এক কপি হাতে দিয়ে বললেন, যদি তোমার ভালো লাগে তাহলে মফিজ চৌধুরী আর জাহাঙ্গীর চৌধুরী একই ব্যক্তি, যদি না লাগে তা হলে কি আর করা, পুরোনো খবরের কাগজের সাথে বেঁচে দিয়ো।
আমি বললাম আপনি কোরিয়ান ভাষা জানেন?
তিনি বললেন, তলস্তয়ের বড় বড় বইগুলোর ইংরেজি অনুবাদ হয়েছে ফ্রেঞ্চ-এ অনুদিত তলস্তয় থেকে। কোরিয়ান জানলে ভালো, না জানলেও সমস্যা নেই।

তিনি সদ্য আইএসসি পড়া ক্ষ্যান্ত দেওয়া আমাকে বইটি দিলেন এবং তার অনুদিত হ্যামলেট-এর পাণ্ডুলিপিও কিছুদিন পর খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তে হবে এমন কিছু একটা আমাকে প্রতিজ্ঞা করালেন। তার কন্ঠস্বর ছিল খানিকটা অনুনাসিক।
আমি বললাম, পাণ্ডুলিপি পড়ে আমার কি লাভ? হ্যামলেটের গল্পটা আমি ভালোই জানি।
তিনি বললেন, সে জন্যই তো দেবো। পড়তে গিয়ে কোথাও যদি খটকা লাগে  পেন্সিল দিয়ে সেই জায়গায়টায় দাগ দিয়ে রেখো।

সত্তরের দশকের শেষদিকে অনূদিত হ্যামলেট নাটক-এর খুঁত ধরার মতো জ্ঞান যে আমার হয়নি, চেষ্টা করেও তাকে বোঝাতে পারিনি। কিংবা আমার যে সে বিদ্যে হয়নি এটা তিনি বুঝে থাকলেও আমাকে বুঝতে দেন নি। হয়তো আমাকে উৎসাহিত করার এই এক ছল।

একজন লেখক মন্ত্রী-টন্ত্রীদের চেয়ে অনেক বড় কিছু। আমি অবলীলায় তাকে মফিজ ভাই ডেকে চললাম। কেনো ডাকবো না? কবি আহসান হাবীবকে যদি হাবীব ভাই ডাকতে পারি, কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমানকে শওকত ভাই ডাকতে পারি তিনি কী এমন হয়েছেন যে তাকে মফিজ ভাই ডাকতে পারবো না। এক শ বার মফিজ ভাই বলবো।

আমি জানলাম তার আসল নাম মফিজ চৌধুরী, ডক্টর মফিজ চৌধুরী, মন্ত্রী ছিলেন, তাতে আমার কি?

একজন লেখক মন্ত্রী-টন্ত্রীদের চেয়ে অনেক বড় কিছু। আমি অবলীলায় তাকে মফিজ ভাই ডেকে চললাম। কেনো ডাকবো না? কবি আহসান হাবীবকে যদি হাবীব ভাই ডাকতে পারি, কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমানকে শওকত ভাই ডাকতে পারি তিনি কী এমন হয়েছেন যে তাকে মফিজ ভাই ডাকতে পারবো না। এক শ বার মফিজ ভাই বলবো।

তার সাথে অনেকদিন সাক্ষাৎ হচ্ছে না, মোবাইল ফোনের যুগ আসতে আরো দুই যুগ বাকী, আমাদের টিঅ্যান্ডটির ল্যান্ড ফোনটা ডেড হয়ে আছে অনেকদিন। এটাকে যে ল্যান্ড ফোন বলে সেটাই জানলাম মাত্র সেদিন, মোবাইল ফোন আসার পর। সুতরাং তিনি তার ছোট নোট বইয়ের পেছন দিকে লিখে রাখা নাম-ঠিকানা ধরে এক বিকেলে আমাদের বাসার দরজায় নক করলেন।

নকই করলেন, কারণ কলিং বেলটা কয়েকবার টিপে বুঝতে পেরেছেন ওটা বাজার জন্য নয়, বেল আছে এটা বোঝাবার জন্য লাগিয়ে রাখা হয়েছে। ব্যাটারির দম ফুরিয়েছে অন্তত তিন মাস। বেল বাজলে ছোটদের ঘুম ভেঙ্গে যায়, সুতরাং আমার বাবা মোটামুটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন, ছোটোরা বড় না হওয়া পর্যন্ত কলিং বেলের জন্য ব্যাটারি কিনবেন না, কেনার পয়সাও দেবেন না।

আমার বাবা সরকারি চাকুরে, মন্ত্রী চিনতে তার তো আর ভুল হবার কথা নয়, তবুও চোখ কঁচলে আবারও ভালো করে দেখে সালাম দিয়ে বললেন, স্যার, আপনি?
তিনি সালামের জবাব দিতে দিতে বললেন, শুভঙ্কর কোথায়? ঠিক বাড়িতেই তো এসেছি? এটা ৮৯ রাজাবাজার তো?
আমার বাবা বললেন, জ্বি স্যার নম্বর ঠিকই আছে। আপনি কাকে চাচ্ছেন?
তিনি বললেন, শুভঙ্করকে। ভাগ্যিস ঠিকানাটা জিজ্ঞেস করে নোট বইতে লিখে রেখেছিলাম।

শুভঙ্করের ফাঁকির কথা জানা থাকলেও আমার বাবার কোনোভাবেই জানার কথা নয় যে ফাঁকিবাজকে তিনি খুঁজছেন সে যে তার গৃহেই লালিতপালিত হচ্ছে।

কে এসেছেন দেখার জন্য আমি সামনে এসে একেবারে থ। হ্যামলেটের অনুবাদককে (তখনও বইটা বের হয়নি) আমি বলেই ফেললাম, মফিজ ভাই, আপনি।
তিনি বললেন, এই তো, শুভঙ্করকে পেয়ে গেছি। এতোদিন কোথায় লুকিয়েছিলে?
আমি তার সাথে বেরিয়ে যাই। পেছনে বাবার কথা শুনতে পাই, স্যার, গরীবের বাড়িতে এসেছেন, এককাপ চা খেয়ে গেলে ভালো হতো।
তিনি ঘাড় ফিরিয়ে বললেন, আর একদিন খাবো।

কিন্তু তিনি যে আমার বাবাকে চটিয়ে দিয়ে গেলেন সেটা সামলাবে কে?
বাবা আমার মাকে বললেন, বেয়াদবির একটা সীমা আছে। ডক্টর মফিজ চৌধুরীর মতো একজন মানুষকে তোমার ছেলে ডাকে, মফিজ ভাই! অস্তাগফিরুল্লাহ। এতোদিন কি শিখিয়েছো ছেলেকে?

আমার বাবার চেয়ে বছর দশেক আগের মেধাবী মেট্রিকুলেট ১৯৪৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া থেকে কেমিস্ট্রি ও কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পিএইচডি ড. মফিজ চৌধুরীকে আমার আর কখনোই স্যার ডাকা হয়নি।

মফিজ চৌধুরীর চশমা
তিনি আর একটি বই নিয়ে এলেন, ভাইসেন্তি আলেকজান্দারের কবিতা। এবারও অনেকদিন যোগাযোগ না করায় তিনি হাজির হলেন এবং আমার ওপর ‘শুভঙ্কর’ জাতীয় কিছু শব্দ চাপালেন, চা’তেও চুমুক দিলেন।

যাবার সময় তিনি আর চশমাটা খুঁজে পাচ্ছেন না। চশমা যে ছিল, চোখে নয়, হাতে, আমিও দেখেছি। খোজাখুঁজি করে পাওয়া গেল না। সম্ভবত আমাকে বিব্রতাবস্থা থেকে বাঁচাতে তিনি বললেন, চশমাটা আনিইনি, টেবিলে রেখে এসেছি মনে হয়।

তার বাড়ি ২ নম্বর ইন্দিরা রোড, আমাদেরটা ৮৯ রাজাবাজার— এখন শমরিতা হাসপাতালের অংশ। বড়জোর পনের মিনিটের হাঁটাপথ।

তিনি চলে যাবার পর শুরু হলো আমার চশমা উদ্ধার অপারেশন। আমি চশমাটা দেখেছি। আমাদের সোফাটা পুরোনো কেনা, গুলশান একনম্বরে বিদেশিদের ব্যবহার করা পুরোনো সোফা সস্তায় বিক্রি হতো, সেখান থেকেই আনা। খানিকটা ইঁদুর খাওয়া যে সোফাটাতে মফিজ চৌধুরী বসেছিলেন, সেটি উল্টেপাল্টে দেখতে শুরু করলাম, পলিথিন ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে সোফার এই ফাঁকা, ওই ফাঁক এবং ইদুর খাওয়া গর্ত দিয়ে হাত চালালাম— কলম, সুতার রিল এবং এমনকি কয়েক বছরের পুরোনো মুরগির ঠ্যাং— বেরিয়ে এলো, চশমার দেখা নেই। অগত্যা উল্টো করে দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে ছুরিকাঁচি নিয়ে সোফা সার্জারি করি। নিচের আস্তরণ কিছুটা খুলতেই চোখে পড়ে স্প্রিং আর নারিকেলের ছোবড়ার মধ্যে আটকে আছে বিশিষ্ট সাহিত্যিক অনুবাদক মফিজ চৌধুরীর চশমা। অপারেশন সাক্সেসফুল। আমি চশমা নিয়ে ছুটলাম তার বাসায়।

একাই থাকতেন পরিবার বিচ্ছিন্ন অবস্থায়। একটি কিশোর তার ফুট-ফরমাস খাটতো, তিনি বলতেন, এটা আমার নাতি। তিনি চশমা হাতে নিলেন, চোখে দিলেন এবং বললেন, চশমাটা দেখতে আমারটার মতো হলেও এটা অন্য কারো। তোমার বাবার চশমা খেকো সোফা তাহলে আরো কারো কারো চশমা খেয়েছে।

কিন্ত! এই সোফায় বসে চশমা হারিয়েছেন— মফিজ চৌধুরী ছাড়া আর কারো কথাই মনে এলো না। চশমা হারানোর অভিযোগও কেউ করেননি। তাহলে এই গায়েবি চশমা এলো কোথেকে?

আবার ফিরে এসে সোফা উল্টাই। এবার খোঁচাখুঁচি একটু বেশিই করতে হয়। বেরিয়ে আসে একটা আধুলি, একটা কলম, একটা চাবির গোছা— জং ধরা তিনটি চাবি এবং শেষ পর্যন্ত আরো একটি চশমা।
আমি আবার ছুটি, আমি নিশ্চিত এটাই মফিজ চৌধুরীর চশমা।

আমি তাকে সোফাবৃত্তান্ত বলি— গুলশান ১ নম্বরের বিদেশিদের ব্যবহার করা আসবাবপত্রের দোকান থেকে পুরোনো সোফা কিনেছি।

তিনি বললেন, তাহলে এই সোফাটা যাদের বাড়িতে প্রথম ছিল তাদের কারো সর্বনাশ করে চশমাটা গর্ভে ধারণ করে তোমাদের বাড়িতে এসেছে। তারপর আমারটা! যত তাড়াতাড়ি পারো বেঁচে দাও, নতুবা আরো যে কার চশমা খাবে!
কিন্তু সোফা এতোটাই পুরোনো হয়ে গেছে যে এর রিসেল ভ্যালু হবে সামান্যই।

স্নেহের একটি বড় টুকরো
পরবর্তী সময় চাকরিসূত্রে যখন বগুড়া গেলাম, ড. মফিজ চৌধুরী তার বাড়ি এবং নির্বাচনী এলাকা জয়পুরহাট থেকে ঢাকা আসা যাওয়ার পথে কিছু সময়ের জন্য বগুড়া থামতেন, তার স্নেহের একটি বড় টুকরো আমাকে দেবেন তাই।

একবার রাতে থাকতে হলো, সাবেক মন্ত্রী, বিশিষ্ট ব্যাক্তিত্ব, সার্কিট হাউসের ভিআইপি রুমই বরাদ্দ হলো, কিন্তু থাকলেন না; থাকলেন ডাকবাংলোতে আমার রুমে। আমার মর্যাদা আকাশে তুলে দিলেন। ডাক বাংলোর কেয়ার টেকার মমতাজ মিয়া বলে বেড়ালেন, আপন আত্মীয় না হলে কোনো মন্ত্রী নতুন চাকরি পাওয়া ম্যাজিস্ট্রেটের রুমে থাকে নাকি? মমতাজ মিয়াই ছড়িয়ে দিলেন, ঘনিষ্ট আত্মীয়।

চাকরি জীবনের এক পর্বে প্রধানমন্ত্রীর অফিসে কাজ করি। ড. মফিজ  চৌধুরী এসে বললেন, ধানমনণ্ডির মাস্তানরা তার স্ত্রীর বাড়িটা দখল করে ফেলেছে। আমি বললাম খুব ভালো করেছে, যে বাড়িতে আপনি থাকেনই না  সে বাড়ি থাকলেই কি না থাকলেই বা কি? তারপর তিনি আবেগময় কথা বলেছেন, সেটা থাক। তার একজন সিএসপি ভাগনে থাকলেও তিনি স্বস্তি বোধ করতেন আমার সাথেই। সেই বাড়ি ড. কামাল সিদ্দিকী এবং পুলিশের তখনকার এডিশনাল আইজি এস এম শাহজাহানের হস্তক্ষেপে তিন-চারদিনের মধ্যেই দখলমুক্ত করা হয়। মাঝখানের যোগাযোগের দায়িত্ব সেধে না নিলেও আমার উপরই পড়তো। তার সাথে আরো কিছু স্মরণীয় স্মৃতি আমি লালন করছি। তার লেখা একটি কি দুটি চিঠি এখনো আমার কোনো না কোনো বইয়ের ভেতর পাবো। শুরুটাই, স্নেহের ‘শুভঙ্কর’।

বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায়
‘বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায়’ নামের আত্মজীবনীমূলক বইটি তার জীবদ্দশায় প্রকাশিত হলেও আমি পড়েছি বহুকাল পরে। এই গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি দেখা বা পড়ার সুযোগ আমার হয়নি। আমি তখন চাকরি সূত্রে টানা বেশ ক’বছর ঢাকার বাহিরে, তারপর পড়াশোনার সূত্রে দেশেরও বাইরে। তা ছাড়া তার  মন্ত্রীত্ব আমার আগ্রহের বিষয়ও ছিল না।

‘‘১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচনে নমিনেশন পাবার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত আমি আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলাম না’’— তারই ভাষ্য, তবে তিনি রাজনীতি বিবর্জিতও ছিলেন না। ঢাকার মোহাম্মদ ওয়াসিকের খপ্পরে পড়ে কলকাতার বেকার হোস্টেল, ইসলামিয়া কলেজ, মুসলিম ইনস্টিটিউট চত্বরে সীমিত আকারে হলেও ছাত্ররাজনীতিতে জড়িত হয়েছিলেন।

তবুও মফিজ চৌধুরীর সেই গ্রন্থ থেকে তার জীবনের মন্ত্রীত্ব-পর্বের কিছু কথা একটুখানি প্রেক্ষাপটসহ সংক্ষেপে তুলে ধরছি, তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে।

‘‘১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচনে নমিনেশন পাবার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত আমি আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলাম না’’— তারই ভাষ্য, তবে তিনি রাজনীতি বিবর্জিতও ছিলেন না। ঢাকার মোহাম্মদ ওয়াসিকের খপ্পরে পড়ে কলকাতার বেকার হোস্টেল, ইসলামিয়া কলেজ, মুসলিম ইনস্টিটিউট চত্বরে সীমিত আকারে হলেও ছাত্ররাজনীতিতে জড়িত হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের সদস্য না হলেও ৭০-এর সেপ্টেম্বরে কখনো থানা, কখনো ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভায় সভাপতিত্ব করেছেন কিংবা প্রধান অতিথির ভাষণ দিয়েছেন, এমনকি এক জনসভায় থাকাকালে বার্তা পেলেন ‘শেখ সাহেবের লোক ঢাকাত্তে আসিছে তোমার কাছে।’

তিনি বার্তাবাহককে আশ্বস্ত করলেন, তখন থেকে ঠিক তৃতীয় দিন তিনি স্বশরীর শেখ সাহেবের সামনে হাজির হবেন। কথা রাখলেন, সকালের দিকে হাজির হলেনও।

‘‘বেলা সম্ভবত নয়টা দশটা, শেখ সাহেব চোখ তুলে আমাকে দেখে মৃদু হাসলেন, পরে তাজুদ্দিনের (তিনি এই বানানটাই লিখেছেন) দিকে তাকালেন। তাজউদ্দীন পাশেই বসা, তার পাশে সৈয়দ নজরুল, কামরুজ্জামান হেনা বোধ হয় লম্বা টেবিলটার একপাশে বসা ছিলেন, তাজউদ্দীন মিষ্টি হেসে বললেন, উনার ইন্টারভিউ লাগবেনা আর আমাকে বললেন, আমার নমিনেশন হয়ে গেছে।’’

‘‘বেলা সম্ভবত নয়টা দশটা, শেখ সাহেব চোখ তুলে আমাকে দেখে মৃদু হাসলেন, পরে তাজুদ্দিনের (তিনি এই বানানটাই লিখেছেন) দিকে তাকালেন। তাজউদ্দীন পাশেই বসা, তার পাশে সৈয়দ নজরুল, কামরুজ্জামান হেনা বোধ হয় লম্বা টেবিলটার একপাশে বসা ছিলেন, তাজউদ্দীন মিষ্টি হেসে বললেন, উনার ইন্টারভিউ লাগবেনা আর আমাকে বললেন, আমার নমিনেশন হয়ে গেছে।’’

৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নমিনেশন হওয়া আর জাতীয় পরিষদ সদস্য ঘোষিত হওয়া সমার্থক ছিল, ব্যতিক্রম কেবল দুটি আসন—ময়মনসিংহের নান্দাইল আর পার্বত্য চট্টগ্রাম। ২৫ মার্চের ভয়াল রাতে তিনি তার দুই নম্বর ইন্দিরা রোডের বাড়িতে ছিলেন, ৬ এপ্রিল ঢাকা ছাড়েন এবং ১০ এপ্রিল ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে নিয়ে হিলি সীমান্ত পথে কলকাতা পৌঁছেন।

বগুড়া থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য এডভোকেট হাবিবুর রহমান তারই মতো বালুরঘাটে আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি কাতর হয়ে বললেন, স্ত্রী পুত্র কন্যা আনতে যাবেন। বহু চেষ্টার পর হিলি থেকে তাকে একটি জিপের ব্যবস্থা করে দেওয়া হলো, তিন দিনের মধ্যেই সপরিবার ফিরে আসবেন আশ্বস্ত করলেন, কিন্তু  না ফেরাতে আফসোসের শেষ নেই। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিশ্চয়ই তাকে আর জ্যান্ত রাখেনি।

মফিজ চৌধুরী জিপ জোগাড় করে দিয়েছেন, কাজেই এমন একজন আওয়ামী লীগ নেতার মৃত্যুর দায় কিছুটা তো তাকে নিতেই হবে। কিন্তু অচিরেই দায়মুক্ত বোধ করলেন, খবর পেলেন— ‘‘শেষ অব্দি আমাদের লোক চরিত্র জ্ঞানের ডুগডুগি বাজিয়ে আমাদের বন্ধু অ্যাডভোকেট সাহেব সরকারি খরচে এখন করাচিতে বহাল তবিয়তে আছেন। এমন দেশপ্রেমিকের সংখ্যাটা কম নয়, কলকাতার পথে রওনা হয়ে ধানমণ্ডিতে থেকে যাওয়ার ঘটনাও তো আছে।’’

১০ এপ্রিল ১৯৭১ ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে নিয়ে বর্ডার পার হয়ে কলকাতা চলে এলেন। এসে শুনলেন আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দ সর্বজনাব তাজউদ্দীন, নজরুল ইসলাম এরা সবাই কলকাতা এসে পড়েছেন। নানা গুজবও কানে এলো, কেউ বললেন, এম আর সিদ্দিকী প্রথমে ইন্দিরা গান্ধীর দরবারে হাজির, পরে তাজউদ্দীন, তারপরে আরো জানলেন আগে যিনিই পৌঁছান না কেন শ্রীমতি গান্ধী তাজউদ্দীনকেই বাংলাদেশের প্রতিনিধি বলে মেনে নেন।

স্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রিসভা গঠন করতে আরও কয়েকদিন লেগে যাবে। তার কলকাতায় অবস্থানের তৃতীয় দিন লোকসভার প্রবীণ সদস্য সমর গুহ বঙ্গবন্ধুর কথা জানতে চাইলে তিনি জানান— ‘‘আমি বললাম ঢাকায় থাকতেই আমরা নিশ্চিত জেনেছি তাকে বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তিনি বললেন কদিন ধরে খবরের কাগজে বের হচ্ছে শেখ সাহেব মারা গেছেন, একটা বিবৃতি দেওয়া দরকার তিনি বেঁচে আছেন এবং এখন পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে বন্দি; বিবৃতিটা না দিলে তারা যদি শেখ সাহেবকে মেরে ফেলে আমাদের কিছু করার থাকবে না কারণ কাগজে তো বলাই হচ্ছে তিনি মারা গেছেন। আপনি ন্যাশনাল আসেম্বলির সদস্য, আপনি এই বিবৃতি দিলে ভালো হয়।’’

যুক্তিপূর্ণ এই পরামর্শের পর মফিজ চৌধুরীর স্বাক্ষরে ভারতের কয়টি দৈনিকে একটি বিবৃতি প্রকাশ হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে আছেন এবং পাকিস্তানে বন্দী অবস্থায় রয়েছেন। আটক অবস্থায় করাচি বিমানবন্দরে শেখ মুজিব সোফায় বসা, দু’পাশে দুজন সৈন্য পরিবেষ্টিত— পরিচিত এই ছবিটি ১২ই এপ্রিল ১৯৭১ দৈনিক দৈনিক পাকিস্তানে প্রকাশিত হয়।

যুক্তিপূর্ণ এই পরামর্শের পর মফিজ চৌধুরীর স্বাক্ষরে ভারতের কয়টি দৈনিকে একটি বিবৃতি প্রকাশ হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে আছেন এবং পাকিস্তানে বন্দী অবস্থায় রয়েছেন। আটক অবস্থায় করাচি বিমানবন্দরে শেখ মুজিব সোফায় বসা, দু’পাশে দুজন সৈন্য পরিবেষ্টিত— পরিচিত এই ছবিটি ১২ই এপ্রিল ১৯৭১ দৈনিক দৈনিক পাকিস্তানে প্রকাশিত হয়।

জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের সময় বাংলাদেশ পরিস্থিতি জানান দিতে যারা ভারত হয়ে নিউ ইয়র্ক পৌঁছেন তাদের মধ্যে ড. মফিজ চৌধুরী ছাড়াও ছিলেন আব্দুস সামাদ আজাদ, সৈয়দ আব্দুস সুলতান, সিরাজুল হক, ফকির শাহাবুদ্দিন এবং ফণীভূষণ মজুমদার; তাদের সাথে প্রবাস থেকে যোগ দেন ডক্টর এ আর মল্লিক, রেহমান সোবহান, এম আর সিদ্দিকী প্রমুখ।

দেশ স্বাধীন হলো, ঢাকায় এসে দেখলেন বহু জাদরেল ব্যক্তি যারা পরবর্তীকালে নানা সুবিধা ও ফন্দির কায়কারবার করতেন, তাদের ঘন ঘন আনাগোনা ছিল গণভবনে। মফিজ চৌধুরীর আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতার সাথে কোনো চেনা জানা ছিল না, তিনি তাদের চিনেছেন পত্রিকার ছাপা ছবি দেখে।

প্রধানমন্ত্রীর সেক্রেটারির ফোন পেলেন, পরদিন সকাল দশটায় প্রধানমন্ত্রী তাকে ডেকেছেন। কেউ কেউ রটিয়েছেন মফিজ চৌধুরী রাষ্ট্রদূত হচ্ছেন, এমনকি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদও জিজ্ঞেস করেছেন, কি ডাক্তার সাহেব বিদেশ যাবেন নাকি? বিদেশ মানেই রাষ্ট্রদূত হওয়া। প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই এটাই জিজ্ঞেস করবেন। সকাল থেকে মনে মনে ঠিক করলেন ‘এ’ ক্যাটাগরির দেশ হলে রাজি হবেন, আজেবাজে দেশ হলে সোজা না বলবেন।

তিনি সত্যিই জানতেন না। সাড়ে দশটায় বঙ্গবন্ধু ঘরে ঢুকলেন একা, ঘরের মাঝখানে যে বড় উঁচু টেবিল ছিল তার উপর অনেকটা আমেরিকানদের কায়দায় পা ঝুলিয়ে বসলেন, বললেন, জেন্টলম্যান, ইউ আর গোয়িং টু বি মাই কলিগ ফ্রম টুডে। বিকেল পাঁচটায় শপথ, আর সব জানাবেন রফিক উল্লাহ চৌধুরী সাহেব।

পরদিন সকাল দশটায় পাজামা পাঞ্জাবি পরে, গায়ে ‘মুজিব কোট’ চাপিয়ে গণভবনের দোতালায় সিঁড়ির মুখে পরিচিত একজনকে পেলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, ভাই ব্যাপারটা কি? তিনি ব্যাঙ্গাত্মক কন্ঠে বললেন, ইস জানেন না বুঝি।

তিনি সত্যিই জানতেন না। সাড়ে দশটায় বঙ্গবন্ধু ঘরে ঢুকলেন একা, ঘরের মাঝখানে যে বড় উঁচু টেবিল ছিল তার উপর অনেকটা আমেরিকানদের কায়দায় পা ঝুলিয়ে বসলেন, বললেন, জেন্টলম্যান, ইউ আর গোয়িং টু বি মাই কলিগ ফ্রম টুডে। বিকেল পাঁচটায় শপথ, আর সব জানাবেন রফিক উল্লাহ চৌধুরী সাহেব।

তিনি তখন প্রধানমন্ত্রীর সচিব, বর্তমান স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর বাবা।

কিন্তু কেমন করে মন্ত্রীর তালিকায় নাম ঢুকলো? হেয়ার স্ট্রিটে মন্ত্রী কামারুজ্জামানের বাড়িতে গিয়ে তাকে প্রশ্নটা করলেন। তিনি বললেন, উত্তরবঙ্গের লোক পাওয়া যায় না ভাই, আমি তো অনেক খুঁজে পেতে আপনার নাম দিয়েছি।

খন্দকার মোশতাক তাকে বললেন, আরে মফিজ ভাই, আমি আপনার হইয়া কনসেন্ট দিছি।

দীর্ঘ একটি নামের পোর্টফোলিও তাকে প্রদান করা হয়— বিদ্যুৎ, প্রাকৃতিক সম্পদ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণা, আণবিক শক্তি।

পদ্মা মেঘনা যমুনা
বাংলাদেশে তেল অনুসন্ধানে ভূতাত্ত্বিক জরিপ করার জন্য ড. মফিজ চৌধুরীর মন্ত্রণালয় পরিকল্পনা করেছে বেশি সংখ্যক অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে কাজ করানো হবে।

‘‘বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে ও কন্টিনেন্টাল সেল্ফে তেল অনুসন্ধান ও উত্তোলন করার জন্য আমরা ব্লক সমূহ লিজ দিতে চাই এই বিজ্ঞপ্তি বিশ্বব্যাপী প্রচারিত হলে বিভিন্ন দেশের ৪০টি প্রতিষ্ঠান তাদের প্রস্তাব পেশ করে। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফর এসে যায়। প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় লোকের একটি বহর বটে! পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান অধ্যাপক নুরুল ইসলাম এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডক্টর কামাল হোসেনও সফরসঙ্গী। রাষ্ট্রীয় অতিথিরা জাপান থাকতেই সংবাদ ছাপা হলো, বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরে তেল সন্ধানে ভূতাত্ত্বিক জরিপ করার জন্য বাংলাদেশ সরকার জাপানকে একছত্র অধিকার প্রধান করেছে।’’

মন্ত্রণালয়ের এতদিনের কাজ পণ্ড হয়ে যাবার জোগাড়। মন্ত্রী ক্ষুব্ধ। বঙ্গবন্ধু ফেরার পর মফিজ চৌধুরী বললেন, আপনি জানেন আমরা বঙ্গোপসাগরে সাত আটটি দেশকে আনার চেষ্টা করছি। তবু এ সিদ্ধান্ত কেন নিলেন?

বঙ্গবন্ধু বললেন, আমি জানিনা, সব ড. নুরুল ইসলাম আর কামাল করেছে, আপনি কামালকে একটা ফোন করেন। মন্ত্রী বললেন, আমি আপনাকেই শুধু বলতে পারি আর কাউকে না।

তখনও তেল বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর পূর্বতন নাম আমিন অয়েল, দাউদ এবং এসসো কোম্পানি বহাল। মফিজ চৌধুরী স্বাধীনতা আন্দোলনের স্মরণীয় স্লোগানটি মনে করলেন— ‘‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’’। প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করে বদলে ফেললেন নাম: আমিন হলো ‘যমুনা’, দাউদ হলো ‘পদ্মা’, এসসো হলো ‘মেঘনা’।

মন্ত্রীর অসন্তোষ ও উত্তেজনার কারণেই তেল অনুসন্ধানের বিষয়টি মন্ত্রিপরিষদ বৈঠক উত্থাপিত হলে পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান এককভাবে জাপানকে দায়িত্ব দেওয়ার পক্ষে বক্তব্য রাখলেন। কেন আমেরিকা ব্রিটেন জার্মানি ফ্রান্সের মতো দেশকে রাখতে চান মন্ত্রী তা ব্যাখ্যা করলেন। দু’ঘন্টা ধরে বাদানুবাদের পর প্রধানমন্ত্রী বললেন, ডক্টর সাহেব যা বলেছেন তাই হবে। সুতরাং যারা জাপানকে একচ্ছত্র অধিকার দিতে চেয়েছেন তারা ক্ষুব্ধ হলেন।

তখনও তেল বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর পূর্বতন নাম আমিন অয়েল, দাউদ এবং এসসো কোম্পানি বহাল। মফিজ চৌধুরী স্বাধীনতা আন্দোলনের স্মরণীয় স্লোগানটি মনে করলেন— ‘‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’’। প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করে বদলে ফেললেন নাম: আমিন হলো ‘যমুনা’, দাউদ হলো ‘পদ্মা’, এসসো হলো ‘মেঘনা’।

মফিজ চৌধুরী লিখেছেন চাটুকার তোষামোদকারী স্বার্থসন্ধানীর দল তখন তাকে ঘিরে ফেলেছে, আর উত্তুঙ্গ জনপ্রিয়তায় নন্দিত বঙ্গবন্ধুও সিজারের মতো অদৃষ্টের হাতে ক্রমশ সমর্পিত হতে চলেছিলেন।

আমলাদের সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, বিদেশ ভ্রমণে কড়াকড়ি থাকলেও আমলারা যেনতেন প্রকারে একটা করে নিজেদের জন্য বিদেশ ভ্রমণের হুকুম আদায় করে নিতেন। এদের অধিকাংশ কুটবুদ্ধিবিশারদ ছিলেন। এদের খলবুদ্ধি যেমন প্রবল ছিল অভিজ্ঞতা ও বিষয় জ্ঞান তেমন ছিল বলে মনে হয়নি। সম্মানীয় ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলাদেশের উচ্চ ও মাঝারি পদসমূহে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন এমন সব ব্যক্তি যারা রাওয়ালপিন্ডিতে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির পদে অবসরের আশায় ধুঁকছিলেন। এদের সাথে মুক্তিযুদ্ধের সুবাদে কিছু লোক প্রায় বাহুবলে চর দখল প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন উচ্চ পদ দখল করে নেন।

তিনি স্বীকার করেন, ‘‘মন্ত্রী হিসেবে আমাদের অদক্ষতা ছিল যথেষ্ট। এর আগে মন্ত্রণালয় চালানোর অভিজ্ঞতা কেবলমাত্র বঙ্গবন্ধু ও মনসুর আলীর ছিল, তাছাড়া মন্ত্রিসভায় প্রতিটি ব্যক্তি ছিলেন এয়ারটাইট কম্পার্টমেন্ট, অন্তত আমার অভিজ্ঞতা তাই। কেউ খুলে মনের কথা বলতেন না, সহযোগীকে সৌহার্দ্যের সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতা দেওয়া ছিল বিরল ঘটনা।’’

মন্ত্রী পরিকল্পনা কমিশনকে কটাক্ষই করেছেন, বঙ্গবন্ধুর চারটি নীতি কোন মন্ত্রণালয়ের কোন প্রস্তাবে ত্বরান্বিত হচ্ছে সেসব জানার প্রত্যক্ষ উপায় ছিল না। এই দায়িত্ব ছিল প্রধানত প্ল্যানিং কমিশনের। কিন্তু হায়! প্ল্যানিং কমিশন তখন আরো একটি দুর্ভেদ্য দুর্গে পরিণত হয়েছিল, সেটা ছিল আর এক সুপার কেবিনেট।

মন্ত্রী পরিকল্পনা কমিশনকে কটাক্ষই করেছেন, বঙ্গবন্ধুর চারটি নীতি কোন মন্ত্রণালয়ের কোন প্রস্তাবে ত্বরান্বিত হচ্ছে সেসব জানার প্রত্যক্ষ উপায় ছিল না। এই দায়িত্ব ছিল প্রধানত প্ল্যানিং কমিশনের। কিন্তু হায়! প্ল্যানিং কমিশন তখন আরো একটি দুর্ভেদ্য দুর্গে পরিণত হয়েছিল, সেটা ছিল আর এক সুপার কেবিনেট।

যারা মনে করে থাকেন পরিকল্পনা কমিশনের উপর কেবল আমলারা ক্ষুব্ধ ছিলেন তাদের ধারণা কিছুটা ভ্রান্তই বলতে হবে। ড. মফিজ চৌধুরী যিনি মূলত চাকরিজীবী থেকে ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ, তার উষ্মা তো স্পষ্ট; অধিকাংশ রাজনৈতিক মন্ত্রীর কাছে পরিকল্পনা কমিশন কোনো আদরণীয় প্রতিষ্ঠান ছিল না। প্রতিষ্ঠানের অন্তর্নিহিত কোনো দুর্বলতার কারণে নয়, যারা প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দিয়েছেন তারা নিজেদের রাজনীতিবিদদের কাছেও গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারেননি।

উদ্ধৃতিযোগ্য আরো কয়েকটি পংক্তি:

‘‘তথাকথিত ডিগ্রীধারী লেখাপড়া জানা লোকের প্রতি বঙ্গবন্ধুর এক গভীর দুর্বলতা ছিল, সম্ভবত সে কারণেই তৎকালীন প্ল্যানিং কমিশনের কর্ণধাররা খুবই দাপিয়ে বেড়াতেন।’’

‘‘বঙ্গবন্ধুও আমাকে কয়েকবারই বলেছেন, ডাক্তার সাহেব, আপনি পলিটিক্স বোঝেন না, আমিও উত্তর দিয়েছি আপনি যতটুকু শিখিয়েছেন তার বেশি পলিটিক্সের বিদ্যা কোথায় পাবো।’’

নোট:
১১ জানুয়ারি ১৯৭২ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। একই দিনে শপথ নিলেন ফণীভূষণ মজুমদার (কৃষি), মনসুর আলী (বাণিজ্য), শেখ আব্দুল আজিজ (যোগাযোগ). ইউসুফ আলী (শিক্ষা) তাজউদ্দীন আহমদ (অর্থ ও পরিকল্পনা), আব্দুস সামাদ আজাদ (পররাষ্ট্র), জহুর আহমদ চৌধুরী (স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা), সৈয়দ নজরুল ইসলাম (শিল্প), খন্দকার মোশতাক আহমেদ (ভূমি রাজস্ব), কামাল হোসেন (আইন ও সংসদ বিষয়ক) এ এইচ এম কামারুজ্জামান (ত্রাণ ও পুনর্বাসন), এমএজি ওসমানী (নৌপরিবহন)। অল্প দিনের মধ্যেই শপথ নিলেন মতিউর রহমান, মোল্লা জালাল উদ্দিন আহমদ, আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, মিজানুর রহমান চৌধুরী, মোস্তাফিজুর রহমান (এম আর) সিদ্দিকী, আব্দুল মান্নান, সোহরাব হোসেন। ড. মফিজ চৌধুরী যোগ দেন ১৯৭২ এর এপ্রিলে।

যেদিন বাকশাল গঠনের সিদ্ধান্ত হয় সেদিনটিতে নাটকীয় ঘটনা ঘটে। আগে থেকে টাইপ করা পদত্যাগ পত্র সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন থেকে শুরু করে সকল মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী সই করেন। পরদিন ৮ জুলাই ১৯৭৪ ইত্তেফাকে প্রকাশিত সংবাদ:  

‘‘গতকাল রবিবার ছয়জন মন্ত্রী ও তিনজন প্রতিমন্ত্রী পদত্যাগ পত্র পেশ করেন এবং প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি তাহাদের পদত্যাগ পত্র গ্রহণ করিয়াছেন বলিয়া সরকারিভাবে ঘোষণা করা হইয়াছে। পদত্যাগকারী মন্ত্রীগণ হইলেন ডাক টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী শেখ আবদুল আজিজ, পাট বিষয়ক মন্ত্রী জনাব শামসুল হক, ভূমি সংস্কার ও ভূমি প্রশাসন মন্ত্রী মোল্লা জালাল উদ্দিন, সমবায় স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রী জনাব মতিউর রহমান, জাহাজ চলাচল আইডব্লিউটিএ ও বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রী এম এ জি ওসমানী, এবং প্রাকৃতিক সম্পদ বিজ্ঞান কারিগরি গবেষণা ও আণবিক শক্তি বিষয়ক মন্ত্রী ডক্টর মফিজ চৌধুরী।’’

পাদটীকা:
ভালোই হয়েছে, নইলে আমি কি আর সেই ১৯৭৫-এর পর থেকে আমার বাবার চেয়েও বছর দশকের বড় এমন একজন জ্ঞানবান মানুষকে মফিজ ভাই ডাকতে পারতাম! মফিজ ভাই, আমি যে সত্যিই আপনাকে স্মরণ করছি। আপনি কি বলবেন, ‘‘কী এতোদিন কোথায় ছিলে শুভঙ্কর?’’

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক।
ইমেইল: [email protected]

আন্দালিব রাশদী। প্রতিকৃতি অঙ্কন: সব্যসাচী মজুমদার
ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত