গত ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দেশে অন্তর্বতীকালীন সরকার গঠনের পর রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন। দেশের বিচার বিভাগে দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান নানা সমস্যা, সংকট, জটিলতা এবং সেসব সংস্কার করে প্রত্যাশিত সমাধানের নানা দিক নিয়ে পর্যালোচনা করেছেন অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা জজ ও দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক মহাপরিচালক মঈদুল ইসলাম। সকাল সন্ধ্যার পাঠকদের জন্য বিশিষ্ট আইন গ্রন্থকার, প্রবন্ধকার, কলামিস্ট ও সাবেক বিচারক মঈদুল ইসলামের তিন পর্বের পর্যালোচনার প্রথম পর্ব প্রকাশ হলো আজ। (বি.স.)
আমাদের বিচার বিভাগ স্বাধীন নাকি স্বাধীন নয় সেটা তর্কসাপেক্ষ। সরকারি দলে যারা থাকেন তারা বলেন স্বাধীন, বিরোধী দলে যারা থাকেন তারা বলেন সরকারের আজ্ঞাবহ। আসলে কী সেটা দেখে বিচার বিভাগকে প্রকৃত অর্থে স্বাধীন করার তরিকা বাতলানোর কথা সদ্যগঠিত বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের।
তবে, এটা তর্কাতীত যে, আমাদের বিচার প্রক্রিয়া সময়খেকো (টাইম কনজিউমিং) এবং ফলত পয়সাখেকো (ব্যয়বহুল)। ফলে, “Only the rich can get justice, only the poor cannot escape it” (বিচার পায় কেবল ধনীরাই, দরিদ্রদের নিস্তার নেই বিচার থেকে), ঊনিশ শতকের অ্যামেরিকান প্রগতিশীল রাজনীতিক ও প্রগতিবাদী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ হেনরি ডেমারেস্ট লয়েডের (১৮৪৭-১৯০৩) এই উক্তিই চরম সত্য আমাদের দেশে। তাই, বিচারের বাণী এখানে হাহাকার করে “Justice delayed is Justice denied” (অনন্তকাল ঝুলিয়ে রাখা বিচার না দেওয়ারই সমান) বলে।
আমি একবার হিসেব করে দেখেছিলাম আমাদের আদাললতগুলোতে নিষ্পত্তি যত তার দ্বিগুণ দাখিল। যেন মশককুল (রাক্ষসের গল্প চলে না একালে)! মরে যত জন্মে তার কয়েকগুণ। জন্ম নিয়ন্ত্রণে আমরা দুর্দান্ত সফল, ‘রোল মডেল’। জার্মান উন্নয়নমন্ত্রী গ্যাড ম্যুলার নাকি আফ্রিকানদের পরামর্শ দিয়েছেন আমাদের অনুসরণ করতে! আদালত আর বিচারকের সংখ্যাবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে দারুণ সফল আমরা অনেক আগে থেকেই! মশা আর মামলার জন্ম নিয়ন্ত্রেণেই আমাদের যত অনাগ্রহ, প্রবল উৎসাহ জন্ম দানে। একটা বিরোধ হলে মামলা হয় ৪টা। একেকটা থেকে হয় আরও চার-চারটা। এই কারবারে আমরা অদ্বিতীয়। মামলা-মশা বাড়িয়ে কী যে মজা!
বিলম্বের কলকাঠি লাগায়নি তো বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে। লাগায়েছে খাঁটি স্বদেশি মতলবিতে। চাবিকাঠি খুঁজতে হবে এ-মাটিতেই। ‘চিচিং বন্ধ’ মন্ত্রে আটকানো ‘চল্লিশ চোর’-এর গোপন-গুহার পাষাণকপাট খোলে কি শত ঠেলাঠেলিতে কিংবা আলু ফাঁক, পটল ফাঁক, বেগুন ফাঁক ডাকে! খোলে শুধুই উল্টো একটা ‘চিচিং ফাঁক’ হাঁকে। ন্যায়বিচার নিয়ে বেরিয়ে আসার পথ আটকানো পাষাণকপাট সরাতে সংশোধনীর ঠেলাঠেলি, আর সংস্কারের হাঁকাহাঁকি তো কম হয়নি এদেশে। সরেনি একচুলও, সেই ‘চিচিং ফাঁক’ হাঁকটা না দেয়ায়। যেই প্যাঁচে তালা আটকায় ঠিক তার উল্টো প্যাঁচেই খোলে।
আদালত, বিচারক ও সহায়ক কর্মচারী বৃদ্ধি
ন্যায়বিচারের অতিবিলম্ব ঘোচাবার কথা উঠলে চট করেই মাথায় আসে আদালত বাড়াবার কথা। ভাবনাটা ভুল নয় একেবারে। কিন্তু, বাড়বে কেমন, কতটা! মাথাব্যাথা হলে সরকারও আদালত বাড়ায় মাঝেমধ্যে। ভিন্ন আদালত নামেই শুধু! অনেকক্ষেত্রে বিচারক একই জন, বিচারকক্ষও একটাই। ভোল পাল্টায়ে হয় কখনও দেওয়ানি, কখনও পারিবারিক, কখনও অর্থ ঋণ, কখনও দায়রা, কখনও স্পেশাল টাইব্যুনাল, কখনও স্পেশাল জজ। ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে জেলাগুলোতে আদতেই ভিন্ন করা হয়েছিল দ্বিতীয় সাব-জজ আদালত। তাতে ‘একমেবাদ্বিতীয়ম’ ছিলেন ঐ সাব-জজই। স্টেনোগ্রাফার-সেরেস্তাদার-আর্দালি দূরে থাক একজন পেশকারেরও পদ করা হয়নি তার। যুগ্ম জেলা জজ নামে চলছে এখনও সেভাবেই। অতিরিক্ত জেলা জজ রিক্ত এসবে তারও আগে থেকে। ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে স্টেনোটাইপিস্ট ছাড়াই চলছিল ঢাকার ১০টি স্পেশাল জজ কোর্ট। দুদক থেকে লেখালেখি করে সেই পদগুলো করিয়েছিলাম ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে। হাল আমলে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল হয়েছে সেই দ্বিতীয় সাব-জজের ‘একমেবাদ্বিতীয়ম’ আদলে। হাইকোর্ট জজ দিয়ে ‘একমেবাদ্বিতীয়ম-আদল’ আদবে বাধে বলে আপিল ট্রাইব্যুনাল আর হয়নি, রয়ে গিয়েছিল কেতাবে ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে। ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে হয়েছে আবারও সেই জেলা জজের আর অতিরিক্ত জেলা জজের ‘একই অঙ্গে আরেক রূপ ধারণ’ স্টাইলে!
মহকুমা থেকে উন্নীত অনেক জেলায় তখন দ্বিতীয় সাব-জজের মামলা ঘাটতি ছিল। ঘাটতি ছিল অনেক উপজেলা আদালতেও। অল্প কিছু মামলা নিয়ে অপর্যাপ্ত নিষ্পত্তির কৈফিয়ত দিতে দিতে এসিআর বিরূপ হয়েছে অনেকের। যেখানে যতটা প্রয়োজন ততটা বাড়াতে হবে আদালত। সাথে সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারী, অফিস-এজলাস এবং পৃথক বিচারক দিয়ে। মামলাভারাক্রান্ত আদালতে প্রতিদিন গাদাগাদা নথি লেখা, সেগুলোর ডায়রি-কজলিস্ট লেখা, সমন-ওয়ারেন্ট লেখা-ইস্যুর অসাধ্য সাধন এক পেশকারের দু-হাতে আর হয় না সবটা, বকেয়াই রয়ে যায় বেশিটা। অনাহূত, তাই সাক্ষী আসে না নির্ধারিত তারিখে। এসব কাজে আরও দু-একটা পদ বাড়ানো জরুরি।
উপজেলায় আদালত ও বিভাগীয় শহরে হাইকোর্ট বেঞ্চ
পুরো আদলে আদালত বাড়াবার আর জায়গা নেই রাজধানী কিংবা জেলা শহরে। সুপ্রিম কোর্ট, জেলা আদালত, সবার প্রাঙ্গণ আজ বিল্ডিংয়ের বন হয়ে আছে। কোলাহলপূর্ণ পরিসরে বাজার চলে, বিচারে লাগে শান্ত-স্নিগ্ধ পরিসর, ভাবগম্ভীর পরিবেশ। আদালত বাড়াতে হবে সেই পরিবেশের পরিসরে। উকিলবিহীন ‘গ্রাম্য’ কিংবা ‘ভ্রাম্য’ আদালত সে বিকল্প নয়। সাক্ষী শুনে আর দলিল দেখে বিচার হয় দেখেই চোখ-কানওয়ালা যে-কেউই বিচারকর্ম সারতে পারে ভাবাটা বিরাট ভ্রম। বিশেষ জ্ঞানসম্পন্ন ন্যায়নিষ্ঠ বিচক্ষণ মানুষ ছাড়া সুবিচার মেলে না আসলে। ফিরিয়ে নিতে হবে ম্যাজিস্ট্রেট, সহকারী জজ, সিনিয়র সহকারী জজ আদালত সব উপজেলায়। জেলার বাইরে সুবিধাজনক জায়গায় কয়েকটি উপজেলার জন্য যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ, অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত নতুন করে বাড়াতে হবে। হাইকোর্ট বেঞ্চ সম্প্রসারণ করতে হবে বিভাগীয় শহরে। সংবিধানের ১০০ অনুচ্ছেদ মেনে সার্কিট বা অস্থায়ী, যে-নামেই হোক। আইনজীবীদের সবার কাছেই মামলা থাকবে পর্যাপ্ত। কতিপয় চেম্বারের মামলা উপচানো কমবে। কতিপয়ের স্বার্থে এসব আদালত তুলে আনার অপবাদ (!) মিথ্যে প্রমাণ হবে। আইনজীবীর ব্যক্তিগত কারণে সময় নেওয়াও কমবে।
সিআরপিসির ৩৮৬ ধারা সংশোধন
অর্থ কোথায় পাওয়া যাবে! প্রতিটি আদালতে বিচারক-কর্মচারীর বেতনভাতা আর আনুষঙ্গিকে যত ব্যয় তার প্রায় দ্বিগুণ আয় কোর্টফি থেকে। দুর্নীতি-মানিলন্ডারিং মামলায় হাজার-লাখ টাকা জরিমানা, আর শতকোটি টাকার সম্পদ বাজেয়াপ্ত হয়। কোর্টফির আয়, জরিমানা-বাজেয়াপ্তির অর্থ-সম্পদ ব্যয় হওয়া উচিত আদালতের মান ও বিচারের গতি বাড়াতেই। ‘সিআরপিসি’-র ৩৮৬ ধারায় সংশোধনী এনে ক্রোক-নিলাম-বিক্রির ক্ষমতাটুকুও দণ্ডদাতা আদালতকে দিলে জরিমানা-বাজেয়াপ্তি আদায়ে গতি আসে।
কগনিজ্যান্স সম্পর্কিত সংশোধন
ফৌজদারি মামলায় ‘কগনিজ্যান্স’ বড় বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আদালতে ফৌজদারি ঢোকার সেটাই পথ। সে-পথে কড়া পাহারা দরকার, যেন মেরিটবিহীন হয়রানির অচল মামলা ঢুকতে না পারে। একাজে থাকতে হবে আরও অভিজ্ঞ বিচক্ষণ বিচারক। তাই, প্রথম-দ্বিতীয় শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের বদলে কগনিজ্যান্সের কাজটা কেবল চিফ জুডিসিয়াল-চিফ মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেটদের দিয়েই করাতে হবে [‘সিআরপিসি’-র ৬(৩) ধারামতে এখন তারা প্রথম শ্রেণিরও উচ্চশ্রেণিতে]। যেমনটা দায়রা বিচার্য মামলা আগে যায় দায়রা জজের কাছে, তিনি গ্রহণ করলে বিচারে পাঠান অতিরিক্ত ও যুগ্ম জজের কাছে। তবে, আগে ম্যাজিস্ট্রেটের কগনিজ্যান্স, পরে আবার দায়রা জজের কগনিজ্যান্সের বদলে সরাসরি দায়রা জজেরই কগনিজ্যান্স, শুরু থেকেই মামলাটা দায়রায় থাকার ব্যবস্থা করা দরকার। ট্রাইব্যুনাল ও বিশেষ ধরনের আদালতের আমলযোগ্য ফৌজদারি মামলাও তদন্তকালে আমলি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে রাখা চলছে আইন ছাড়া পুরাতন স্বভাবে। সেগুলো তো শুরু থেকেই সে-সব ট্রাইব্যুনাল ও বিশেষ আদালতেই থাকার কথা। অর্থহীন এসব ধাপ কমালে কাল কাটানোর অনেক ধাপ কমে, সময় বাঁচে।
তদারকি-তত্ত্বাবধান
যতই পাকা বন্দোবস্ত হোক না কেন, চার আনারও সাধ মিটবে না ঠিকমতো দেখভাল না করলে। দামি যন্ত্রপাতির অত্যাধুনিক কারখানাও অচল হয় নিয়মিত ‘সুপারভিশন’ না থাকলে। নষ্ট ‘পার্টস’ আর দুষ্ট গরু শনাক্ত করে সারাতে হয়, সরাতে হয়। করিয়ে না নিলে কাজ করে না কেউই। কর্তা আর কর্মীতে ফারাক এই। অধস্তন আদালতগুলোর বিচারকদের নিজ নিজ আদালতের এবং নিজ অধস্তনগুলোর জেলা ও দায়রা জজের তদারকি-তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব। নিজেরসহ সব আদালতের তদারকি-তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব সুপ্রিম কোর্টের। কায়দা-কৌশল দেওয়া আছে ‘সিভিল রুলস অ্যান্ড অর্ডারস’, ‘ক্রিমিনাল রুলস অ্যান্ড অর্ডারস’-এ। আছে হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগের কোর্ট রুলস। সেগুলো মানা হচ্ছে কিনা সেই তদারকি ও কাজ করিয়ে নেবার কর্তা সুপ্রিম কোর্ট।
অধস্তন সব আদালত থেকে বিচারাধীন মামলার কতগুলো কত মাসের, কত বছরের পুরাতন, অতিবিলম্বের কী কারণ সব তথ্যই সুপ্রিম কোর্টে আসে বার্ষিক, ত্রৈমাসিক স্টেটমেন্টে। বছরে কোন আদালতে, কোন বেঞ্চে শতকরা কতভাগ নিষ্পত্তি, কতভাগ দায়ের, কতভাগ পেন্ডিং, কত বছরের পুরাতন কতটি কার কাছে থাকল, পুরো হিসাব থাকতে হবে সুপ্রিম কোর্টের বার্ষিক রিপোর্টে। আসল খবরদারি করতে লাগে খুঁটিনাটি সব খবরাদি। মোটা দাগের হিসাবে ধরা যায় না আসল দাগী কে!
বিচার বিভাগ সংস্কারের খসড়া রূপরেখা-২
বিচার বিলম্বকারী বিচারক ও আইনজীবীর তালিকা প্রকাশ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৯০ সালের ‘সিভিল জাস্টিস রিফর্ম অ্যাক্ট’-এ অভিনব নিয়ম করেছে। ফেডারেল জজ-ম্যাজিস্ট্রেটদের যারা মামলা নিষ্পত্তিতে অতিবিলম্ব করেন তাদের নাম জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়। সাক্ষী বা শুনানি শুরুর ৬ মাসে, মামলা দাখিলের তিন বছরের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে না পারলে সেই বিচারককেই তা জানাতে হয় ‘অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিস অব দি ইউনাইটেড স্টেটস কোর্টস’-এর পরিচালকের কাছে। পরিচালক সেগুলোর রিপোর্ট ৬ মাস পর-পর প্রকাশ করে। কানাডায় সাধারণ দেওয়ানি মামলা সর্বোচ্চ ৬ মাসে নিষ্পত্তি করা নিয়ম। ৫টা মামলায় এই সীমা লঙ্ঘন করায় বিভাগীয় ব্যবস্থায় ‘ওয়ার্নিং’ খেয়ে বিচারকের পদত্যাগের নজিরও আছে।
এমনই করা উচিত আমাদের এখানে বিচারক ও আইনজীবীর জন্য। শনাক্ত হোক সত্যিকারের বিলম্বকারী, আরামকারী। ঢালাও দোষের ভাগী হয় না খেটে-মরা বেচারি।
অধস্তন-ঊর্ধ্বতন, বিচারক-সহায়ক সবাইকেই রাখতে হবে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের নজরে। দায়মুক্তিতে রাখা যাবে না কাউকেই। ঢালাও দোষের সার্কুলার নয়– ধরতে হবে, সারতে হবে, সরাতে হবে, আসল নষ্ট, আসল দুষ্টকে। কেবল অভিযোগ পেলেই নয়, গন্ধ পেলে, ধোঁয়া দেখলেই নিজ গরজে খবর নেবে, বিহিত করবে। সব আদালতে কড়া তদারকি আর সত্যিকারের দেখভালের তত্ত্বাবধানই হলো বিচার-বিলম্বের একপাশের পাষাণকপাট সরাবার আসল চাবিকাঠি। ঘোরাতে হবে সবল হাতে।
মামলা যত কম আসে, বিচার শেষের আগে আপিল-রিভিশন-রিট যত কম হয় ততই কম জট বাধে। সেগুলো আদৌ চলে কিনা তার বাছবিচার শুরুতেই করে নেবার, অচলগুলো বাদ দেবার বিধান আছে কার্যবিধিগুলোতে। সেগুলো বোধবুদ্ধি দিয়ে বিচারক-আইনজীবী মেনে চললে নর্দমায় আবর্জনা ফেলার মনানন্দে আদালতে ফেলা হাবিজাবি মামলা-আপিল রিভিশন-রিটে বিচারস্রোত আবদ্ধ হতো না।
বিচার বিভাগ সংস্কারের খসড়া রূপরেখা-৩
মামলার আগেই বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি
মামলায় ঢুকিয়ে মক্কেলকে আদালত, আর আদালতকে মক্কেল দেখানো শেষে আপোশ-নিষ্পত্তির বিকল্প পথের প্যাঁচে ঘোরাবার বদলে দরকার এমন ব্যবস্থা;– ‘‘বিরোধ নিয়ে মক্কেল এলে তাকে শুনে, কাগজপত্র দেখে আইনজীবী ‘মেরিট’ দেখলে দাবি মেনে নিতে নোটিশ দেবেন অপরপক্ষকে। অপরপক্ষ আরেক আইনজীবীর কাছে গেলে তিনিও শুনে, কাগজপত্র দেখে প্রথমপক্ষের আইনজীবীর সাথে মিটমাটে বসবেন নিজ নিজ মক্কেল নিয়ে। আপসরফার উদ্যোগটা গোড়াতেই নেবেন দু-পক্ষের আইনজীবী। সময়সীমা থাকবে নির্দিষ্ট, ফিসের হারটাও। মিটে গেলে সোলেনামায় বিরোধ নিষ্পত্তি। না মিটলে তার কারণ বিস্তারে একটি স্মারক তৈরি করবেন দু-পক্ষ। সেই স্মারক নিয়ে আদালতে যাবেন সংক্ষুব্ধ-পক্ষ। বিচারে যে-পক্ষ হারবেন তার হবে মামলার দাবির সমান জরিমানা গোঁয়ার্তুমি করে অপরপক্ষকে হয়রানির মামলায় ফেলার দায়ে।’’
সিআরপিসির ১৯৫ ও ৪৭৬ ধারা সংশোধন
এক বিরোধে মামলা হয় কয়েকটা। পারিবারিক বিরোধ বাধলে মামলা হয় আগে যৌতুকের, পরে নারী নির্যাতনের, চুরির, শেষে হয় পারিবারিক। দেওয়ানির বিরোধ লাগলে মামলা হয় আগে চাঁদাবাজির, পরে দেওয়ানি। একখানা চেকেই হয় প্রতারণা, জালিয়াতি, এনআই অ্যাক্ট, অর্থঋণ। বাদী-বিবাদী, আসামি-ফরিয়াদি একই লোক, বিচারকও একই জন, আইনজীবীও একই। বিচার হয় একই এজলাসে, শুধু পৃথক নথি টেনে। আজকে যে-বিচারক ম্যাজিস্ট্রেসিতে কালকে তিনি দেওয়ানিতে। মামলার সংখ্যা কমাতে এক বিরোধে একটাই মামলা, দেওয়ানি-ফৌজদারি প্রতিকার একই বিচারে, এমন ব্যবস্থাই করতে হবে। দেওয়ানির ডিক্রি হলে জারির প্রক্রিয়াটা নিতে হবে সেই আদালতকেই, নিজের রায়-ডিক্রির মান বাঁচাতে। নইলে বিচার থাকে অসমাপ্ত। সে ব্যবস্থাটাও করতে হবে। মিথ্যা মামলা, আর জাল কাগজ প্রমাণ হয় যে আদালতে তাকে ফৌজদারির নালিশকারী হবার যে ঘোরপ্যাঁচ লাগানো আছে কার্যবিধির ১৯৫ ও ৪৭৬ ধারায় সেটা ছুটিয়ে সেই আদালতকেই দণ্ডদাতা করা দরকার। তারই এক রায়ে মিথ্যা-জালিয়াতিরও সাজাটা হয়ে গেলে আরেক মামলা লাগে না, মিথ্যা মামলাও কমে।
(বুধ ও বৃহষ্পতিবার দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্বে সমাপ্য)
লেখক: কলামিস্ট, প্রবন্ধকার ও গ্রন্থকার; অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা জজ ও দুদকের সাবেক মহাপরিচালক।
ইমেইল: [email protected]