ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সরকার পতনের পর অস্থিরতার মধ্যে ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দুজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের গেস্ট রুমে এক যুবককে চোর সন্দেহে পিটিয়ে মারা হয়। তার নাম তোফাজ্জল।
অন্যদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রক্টর অফিসে হত্যাকাণ্ডের শিকার যুবক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা। তার নাম শামীম মোল্লা।
উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘মব জাস্টিস’র এই ঘটনা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা উঠেছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভও করেছে এক দল শিক্ষার্থী।
ফজলুল হক হলের ঘটনা নিয়ে প্রত্যক্ষদর্শীরা সাংবাদিকদের জানান, হলে শিক্ষার্থীদের কিছু মোবাইল ফোন চুরি হয়েছিল। বুধবার সন্ধ্যায় হলের শিক্ষার্থীরা তোফাজ্জলকে চোর সন্দেহে আটক করে।
তোফাজ্জলকে প্রথমে গেস্টরুমে নিয়ে যায় শিক্ষার্থীরা। সেখানে তাকে রাত ১০টা পর্যন্ত দফায় দফায় মারধর করা হয়। পরে ক্যান্টিনে বসিয়ে ভাতও খাওয়ানো হয়। এরপর পুনরায় মারধর চলে।
এরপর হলের হাউস টিউটররা গিয়ে প্রক্টরিয়াল টিমের সদস্যদেরসহ তোফাজ্জলকে শাহবাগ থানায় নিয়ে গিয়েছিল।
শাহবাগ থানার ওসি শাহাবুদ্দিন শাহীন ডেইলি স্টারকে বলেন, “রাত পৌনে ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিমের সদস্যরা তাকে নিয়ে আসে। আমরা তাকে আগে হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলি।”
অচেতন তোফাজ্জলকে রাত ১২টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায় কয়েকজন শিক্ষার্থী। চিকিৎসক দেখে তাকে মৃত ঘোষণা করলে ওই শিক্ষার্থীরা লাশ রেখেই চলে আসে।
নিহত তোফাজ্জলের বাড়ি বরগুনার পাথরঘাটার কাঠালতলী ইউনিয়নে। তিনি মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন ছিলেন বলে বিভিন্নজন জানিয়েছে।
মধ্যরাতে শিক্ষার্থীদের পিটুনিতে ওই যুবকের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে সোশাল মিডিয়ায় ব্যাপক সমালোচনা ওঠে। বিচারবহির্ভূত এই হত্যাকাণ্ডের বিচার ও দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে পোস্ট দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই অনেক শিক্ষার্থী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ ডেইলি স্টারকে বলেন, পিটিয়ে মারার এই ঘটনা তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে হলের প্রভোস্টকে বলা হয়েছে। শাহবাগ থানায় মামলাও করা হবে।
তিনি আরও বলেন, “ক্যাম্পাসের মধ্যে এ ধরনের ঘটনা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যাবে না। কেউ চুরি করতে আসলেও তাকে পিটিয়ে হত্যার অধিকার কারও নেই। ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ দেখে দায়ীদের শনাক্তের চেষ্টা করা হচ্ছে।”
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নিহত শামীম মোল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ৩৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক। শামীমের বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করেন বলে তিনি ক্যাম্পাসের কাছেই বাড়িতে থাকতেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলার সময় গত ১৫ জুলাই আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় শামীমও জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজিসহ আরও অভিযোগ ছিল।
ওই আন্দোলনে সরকার পতনের পর মন্ত্রী-এমপি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের মতো ছাত্রলীগের নেতারাও গা ঢাকা দিয়ে আছে।
এরমধ্যে বুধবার বিকালে শামীমকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জয় বাংলা ফটক এলাকায় পেয়ে ব্যাপক মারধর করে একদল শিক্ষার্থী। পরে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির হাতে তুলে দেওয়া হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শামীমকে আশুলিয়া থানা পুলিশের কাছে তুলে দিয়েছিল। সেখান থেকে তাকে সাভারের গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করে।
অভিযোগ রয়েছে, প্রক্টর অফিসে নেওয়ার পর শামীমকে আরেক দফা পেটানো হয়েছিল।
বিচারবহির্ভূত এই হত্যাকাণ্ডের পর রাতেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তারা প্রক্টর অফিসে গিয়ে বিভিন্ন দেয়াল লিখনও করে।
শামীম মোল্লা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সবাইকে শনাক্ত করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের দাবিতে ‘জাহাঙ্গীরনগর বাঁচাও আন্দোলন’ ব্যানারে বৃহস্পতিবার বিক্ষোভের কর্মসূচিও দেওয়া হয়েছে।
ছাত্র-গণআন্দোলনে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গত ৮ আগস্ট দায়িত্ব নিয়ে আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল।
কিন্তু তারপরও বিভিন্ন স্থানে এমন ঘটনা ঘটছে। ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগরের আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাবেক এক ছাত্রলীগ নেতাকে হত্যা করা হয়। তিনি পঙ্গু ছিলেন।