প্রায় সপ্তাহ খানেক ধরে বাজারে প্রায় সব ধরনের চালের দাম বাড়তি। এমন পরিস্থিতিতে দাম কমিয়ে ক্রেতাকে স্বস্তি দিতে চালের আমদানি শুল্ক কমানোর কথা জানিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
তবে বেসরকারিভাবে আমদানি বাড়িয়ে বাজারে চালের দাম সহনীয় পর্যায়ে আনার লক্ষ্যে শুল্ক কমানো হলেও বেসরকারি উদ্যোগে চাল আমদানির অনুমতি দিয়ে এখনও কোনও প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়নি।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, চালের আমদানি শুল্ক কমানো হলেও কত টন আমদানি করা যাবে বা আমদানি সবার জন্য উন্মুক্ত নাকি শর্তসাপেক্ষে হবে– এই বিষয়গুলো পরিষ্কার করে প্রজ্ঞাপন না হওয়ায় তারা চাল আমদানি নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছেন। ফলে দাম কমিয়ে আনতে সরকারের প্রচেষ্টার সাফল্য নিয়েও সন্দিহান তারা।
বেসরকারি উদ্যোগে চাল আমদানিতে শুল্কহার কমিয়ে গত ২০ অক্টোবর প্রজ্ঞাপন জারি করে এনবিআর। এতে চালের ওপর বিদ্যমান আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ এবং নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করার কথা জানানো হয়।
এছাড়া চাল আমদানিতে এখন যে ৫ শতাংশ আগাম কর দিতে হয়, তাও সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়েছে। অর্থাৎ আগে যেখানে সবমিলিয়ে শুল্ক ছিল ৫৫ শতাংশ, এখন সেটি কমিয়ে ২০ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে।
প্রজ্ঞাপনের পর রাজস্ব বোর্ডের এক পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছিল, শুল্ক কমানোর ফলে আমদানি পর্যায়ে প্রতি কেজি চালের দাম ১৪ টাকা ৪০ পয়সা কমবে। ফলে চাল আমদানি করে বাজারে দাম কমিয়ে আনার বড় সুযোগ তৈরি হয়েছে।
আগস্টে দেশের ১১টি জেলার ভয়াবহ বন্যার প্রভাবে ১০.৮৭ লাখ টন চালের উৎপাদন নষ্ট হয়েছে বলে প্রতিবেদন দিয়েছে সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়। সেই ধকল সামাল দিতে সরকারিভাবে ৪ লাখ টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। কিন্তু বেসরকারি উদ্যোগে কত চাল আমদানির প্রয়োজন, সেটির সিদ্ধান্ত না আসায় শুল্ক কমানোর পরও বেসরকারি উদ্যোগে চাল আমদানি নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।
বেসরকারি উদ্যোগে চাল আমদানির প্রজ্ঞাপন না পাওয়ায় ব্যবসায়ীরা দ্বন্দ্বে আছেন জানিয়ে চট্টগ্রামের চাক্তাই চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওমর আজম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বেসরকারি উদ্যোগে চাল আমদানির এখন অনুমতি নেই। গতবছর সরকার বাজারের চাহিদা অনুযায়ী কিছু শর্ত বেঁধে দিয়ে চাল আমদানির প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল। তখন সবার জন্য আমদানি উম্মুক্ত করা হয়নি। এখন বেসরকারি উদ্যোগে চাল আমদানি উম্মুক্ত নাকি শর্তসাপেক্ষে হবে সেই প্রজ্ঞাপনই তো খাদ্য মন্ত্রণালয় দেয়নি। তাহলে আমরা বুঝব কীভাবে আমদানি করে কত টন চাল দেশে আনা হবে।”
তিনি মনে করেন, শর্তসাপেক্ষে না দিয়ে চাল আমদানি ছোট-বড় সবার জন্য উম্মুক্ত করে দেওয়া উচিত। তাহলে বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়বে এবং দাম কমানোর চেষ্টায় সুফল মিলবে।
জানতে চাইলে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সরবরাহ ও সংগ্রহ অনুবিভাগের প্রধান অতিরিক্ত সচিব হাবিবুর রহমান হোছাইনী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সরকার শুল্কহার কমিয়েছে– সেই খবর ব্যবসায়ীরা পেয়েছেন। ফলে সেই শুল্ক মেনে আমদানি করতে আবেদন করলে আমরা অনুমতি দেবে।”
কীভাবে কোন প্রক্রিয়ায় কত টন চাল আমদানি হবে তার প্রজ্ঞাপন কিংবা সিদ্ধান্ত না আসার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “প্রজ্ঞাপন কেন লাগবে। আবেদন করুক, আমরা দেখব কত টনের আবেদন হয়েছে। বেশি হলে আর দেব না।”
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের আরেক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, রাজস্ব বোর্ড থেকে শুল্ক কমানো হয়েছে, কিন্তু বেসরকারি খাতে আমদানির সিদ্ধান্ত এখনও চূড়ান্ত হয়নি। আগের মতো শর্তসাপেক্ষে বেসরকারি খাতে আমদানির অনুমতি দেওয়া হবে নাকি উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে সে বিষয়ে এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি।
শিল্পগ্রুপগুলোর ‘কৌশল’ বন্ধের দাবি
২০২৩-২৪ এবং ২০২৪-২৫ এই দুই অর্থবছরে দেশে সরকারি-বেসরকারি কোনও পর্যায়েই চাল আমদানি হয়নি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ১০ লাখ ৫৬ হাজার টন চাল আমদানি হয়েছিল। এরপর থেকে চাল আমদানি আর হয়নি। দেশে তখন চালের উদ্বৃত্ত উৎপাদন হওয়ায় আমদানির প্রয়োজন হয়নি।
উৎপাদন বেশি হলেও গত দুইবছর থেকেই চালের দাম বাড়তে থাকে, সরকারিভাবে খোলাবাজারে (ওএমএস)-সহ বিভিন্নভাবে সরকার চাল বিক্রি করেও দাম নাগালে আনতে পারেনি। মূলত বড় করপোরেট শিল্পগ্রুপগুলো চালের মজুদ করতে থাকায় দাম কোনোভাবেই নাগালে আনতে পারেনি বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। ফলে মানুষকে চাল কিনতে হয়েছে চড়া দামে। সেই ধারাবাহিকতা এখনও চলছে। গত সপ্তাহ থেকেই চালের দাম ফের বেড়েছে। সব ধরনের চালের দাম প্রতি বস্তায় (৫০ কেজি) পাইকারিতেই ১০০-১৫০ টাকা বেড়েছে।
চট্টগ্রামভিত্তিক পাহাড়তলী চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বাজারে নতুন মৌসুমের চাল আসা শুরু হয়েছে। এর মধ্যেই দাম নতুন করে বেড়েছে। অথচ সরকার চালের আমদানি শুল্ক কমিয়েছে। এরই মধ্যে দাম বাড়া মানে আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।”
তিনি মনে করেন, নতুন চাল আসুক, উদ্বৃত্ত উৎপাদন হোক কিংবা আমদানি উম্মুক্ত করে দিক– চালের দাম কমানোর চেষ্টায় সুফল মিলবে না যদি শিল্পগ্রুপগুলোর চাল মজুদের ‘কৌশল’ বন্ধ করা না হয়।
নিজাম বলেন, “শিল্পগ্রুপগুলোর নিজেদের সবার চালকল নেই। কিন্তু তারা কৃষকদের কাছ থেকে চাল কিনে চালকল মালিকদের কাছে মজুদ রাখে। পরে সুবিধাজনক উপায়ে সেগুলো সংগ্রহ করে নিজেদের গুদামে এনে নিজেদের নাম দিয়ে প্যাকেটজাত করে বাজারে বিক্রি করে। এতে করে উৎপাদিত, আমদানিকৃত বিশাল অংশের চাল তাদের মজুদে থেকে যাচ্ছে। সেই কৌশল বন্ধ করা না গেলে বাজারে মিলবে বলে আমার অন্তত মনে হয় না।”
শুল্ক কমানোয় ভারত থেকে আমদানির সুযোগ
বিশ্বে সবচেয়ে বেশি চাল রপ্তানিকারক দেশ ভারত। বিশ্ববাজারের প্রায় ৪০ শতাংশ চাল রপ্তানি করে দেশটি। নিজেদের খাদ্যমজুদ দৃঢ় রেখে বাজার সহনীয় রাখতে অন্তত দুবছর চাল রপ্তানি ভারত বন্ধ রেখেছিল। গত সপ্তাহে তারা আবার চাল রপ্তানির অনুমতি দিয়েছে, একইসঙ্গে কমিয়েছে শুল্ক।
গত মাসে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার আধা সেদ্ধ চালের রপ্তানি শুল্ক ১০ শতাংশে কমিয়ে আনে। এখন সেই ১০ শতাংশ শুল্কও পুরোপুরি প্রত্যাহার করা হয়েছে। অর্থাৎ ভারত থেকে আধা সেদ্ধ চাল রপ্তানিতে এখন কোনও শুল্ক নেই। গত সেপ্টেম্বরে ভারত সরকার বাসমতি ছাড়া বাকি চাল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। তবে সরকার চালের ন্যূনতম রপ্তানিমূল্য প্রতি টন ৪৯০ ডলার নির্ধারণ করে দিয়েছে।
বাংলাদেশ চাল আমদানিতে সবসময়ই অগ্রাধিকার দিয়ে আসছে ভারতকে। বাংলাদেশ এবং ভারত দুইদেশেই শুল্কহার কমানোর ফলে বেসরকারি উদ্যোগে চাল আমদানির একটি বড় সুযোগ তৈরি হয়েছে।
চাল ব্যবসায়ী ওমর আজম মনে করেন, শুল্ক কমানোর পর বাংলাদেশে অনেক কম দামে চাল আনা সম্ভব হবে। ভারত থেকে স্থলপথ এবং নৌপথে ছোট জাহাজে চাল আমদানি খুব সহজ। সময় সাশ্রয়ী এবং পরিবহন খরচ অনেক কম। ফলে বাংলাদেশে এখন যে বাজার দর তার চেয়ে কম দামে ভারত থেকে চাল আমদানি করা সম্ভব। এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে ঋণপত্র খোলা এবং ডলারের বিনিময়মূল্য স্থিতিশীল রাখতে হবে।
হিলি স্থলবন্দরের চাল আমদানিকারক শহীদুল ইসলাম বলছেন, ন্যূনতম রপ্তানিমূল্য ৪৯০ ডলার হলেও দুদেশের শুল্ক কমানোর কারণে চাল কম দামে আমদানি করা যাবে। দেশের বাজারে ন্যূনতম ৫০-৫৫ টাকায় চাল আনা যাবে। কিন্তু আমদানিতে শর্তযুক্ত হলে সেই সুফল মিলবে না।
বাজারে স্থিতিশীলতা আনার জন্য দেশে যতটুকু চাল দরকার, তা আমদানির জন্য উম্মুক্ত করে দেওয়ার পক্ষে এই আমদানিকারক।