Beta
মঙ্গলবার, ২ জুলাই, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ২ জুলাই, ২০২৪

সাক্ষাৎকার

অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ কিছু গোষ্ঠীর কাছে

সেলিম জাহান

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, শিক্ষক ও লেখক সেলিম জাহান মনে করেন, দারিদ্র্যের আপাতন কমলেও বাংলাদেশে আয়-সম্পদ ও সুযোগের বৈষম্য ক্রমাগত বাড়ছে এবং ঢাকা শহরে হাঁটলেই বৈষম্যের ফাঁকটা যে কত বড় সেটা দেখা যায়। অর্থনৈতিক বৈষম্যের পাশাপাশি সমাজে শিক্ষা-সংস্কৃতি-রাজনীতির বিভাজন কমিয়ে আনা এবং মানবসম্পদের বিকাশের মধ্য দিয়ে সমতাভিত্তিক বাংলাদেশ নির্মাণের নানা অন্তরায় নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগের ভূতপূর্ব পরিচালক সেলিম জাহানের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সকাল সন্ধ্যার জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক আহমেদ মুনীরুদ্দিন

অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ কিছু গোষ্ঠীর কাছে

সেলিম জাহান

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, শিক্ষক ও লেখক সেলিম জাহান মনে করেন, দারিদ্র্যের আপাতন কমলেও বাংলাদেশে আয়-সম্পদ ও সুযোগের বৈষম্য ক্রমাগত বাড়ছে এবং ঢাকা শহরে হাঁটলেই বৈষম্যের ফাঁকটা যে কত বড় সেটা দেখা যায়। অর্থনৈতিক বৈষম্যের পাশাপাশি সমাজে শিক্ষা-সংস্কৃতি-রাজনীতির বিভাজন কমিয়ে আনা এবং মানবসম্পদের বিকাশের মধ্য দিয়ে সমতাভিত্তিক বাংলাদেশ নির্মাণের নানা অন্তরায় নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগের ভূতপূর্ব পরিচালক সেলিম জাহানের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সকাল সন্ধ্যার জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক আহমেদ মুনীরুদ্দিন

সকাল সন্ধ্যা: আপনি দীর্ঘদিন ধরে মানব উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ নিয়ে বৈশ্বিক পরিসরে কাজ করেছেন। সে অভিজ্ঞতা থেকে দারিদ্র্য দূরীকরণ ও মানব উন্নয়নে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থানকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন? এক্ষেত্রে বাংলাদেশের কতটা অগ্রগতি হলো?

সেলিম জাহান: প্রথমত, মানব উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য দূরীকরণে বৈশ্বিক পরিসরে কাজ করার আগে এক্ষেত্রে আমার কাজের শুরুটা কিন্তু বাংলাদেশেই হয়েছিল। আশির দশকে আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করি তখন আমার গবেষণা এবং পরিকল্পনা কমিশনে আমার কাজ এই মানব উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ নিয়েই ছিল। বলা চলে এইসব গবেষণায় হাতেখড়ি আমার বাংলাদেশে— ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদিতে। এটা ঠিক যে প্রথম দিক থেকেই উল্লিখিত দুটো বিষয় নিয়েই আমি কাজ করেছি এবং আমার প্রেক্ষিত ছিল বাংলাদেশ, তারপর আমি বৈশ্বিক পরিসরে যাই।

দ্বিতীয়ত, যখন আমি মানব উন্নয়ন ও দারিদ্র্যদূরীকরণ নিয়ে বৈশ্বিক পর্যায়ে কাজ শুরু করলাম সেটা আমাকে এ বিষয়ে একটা বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিত দিয়েছে। আমি আফ্রিকাতে কাজ করেছি, ল্যাতিন আমেরিকায় কাজ করেছি। আমার মনে হয় সেই বৈশ্বিক প্রেক্ষিতটা আমাকে বাংলাদেশের বিষয়গুলো বোঝার ক্ষেত্রে আরও সহায়তা করেছে, এই অর্থে যে, বাংলাদেশ নিয়ে যখন কাজ করেছি তখন মনোযোগটা বাংলাদেশের মধ্যেই ছিল, তুলনামূলক বিচার করার সুযোগটা কম ছিল। কিন্তু যখন আপনি বৈশ্বিক পরিসরে কাজ করেন, বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের বাস্তবতা ও অভিজ্ঞতার সঙ্গে তুলনা করেন, তখন আপনি দেশের পরিস্থিতিটা আরও অনেক ভালোভাবে বুঝতে পারেন।

তৃতীয় যে কথা, যা আপনার মূল প্রশ্ন, বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থানের মূল্যায়ন। আমি বিষয়টিকে দুটো দিক থেকে দেখি— একটা দারিদ্র্য দূরীকরণের দিক থেকে, আরেকটি মানব উন্নয়নের দিক থেকে। এটা অস্বীকার করার কোনও উপায় নাই যে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের আপাতন গত ৩০ বছরে অনেক কমেছে। যেমন ১৯৯০ সালে যেখানে দারিদ্র্যের আপাতন ছিল ৫৮ শতাংশ, আমরা সেটাকে এখন ২১ শতাংশে কমিয়ে নিয়ে এসেছি। আমরা যদি চরম দারিদ্র্যের কথা বলি সেটা ১৪ শতাংশে নিয়ে এসেছি।

কিন্তু তারপরও কথা থেকে যায়— এখনো বঞ্চনা আছে। আজকে এখনও পর্যন্ত ৩ কোটি ৪০ লাখ মানুষ বাংলাদেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। আমরা যদি প্রান্তিক অঞ্চলগুলোতে যাই, যেমন চরাঞ্চল বা দেশের দক্ষিণে উপকূলে কিংবা উত্তরবঙ্গের মঙ্গা-এলাকায়— সেসব জায়গায় দারিদ্র্যের আপাতন এখনও বেশি রয়ে গেছে। বঞ্চনার দিক থেকে আমরা দেখতে পাই যে, এখনও বাংলাদেশে দু’হাজার লোকের জন্য একজন ডাক্তার, আড়াইহাজার লোকের জন্য একজন নার্স। অর্থাৎ উন্নয়ন হওয়া সত্ত্বেও, দারিদ্র্য দূরীকরণে সাফল্য সত্ত্বেও আমার মনে হয় যে, বঞ্চনার একটা জায়গা রয়েই গেছে।

আমরা দেখছি যে দেশে অসমতা বা বৈষম্য ক্রমাগত বেড়ে চলেছে এবং এটা দেখার জন্য বা বোঝার জন্য আপনার অর্থনীতিবিদ হওয়ার প্রয়োজন নেই— খালি চোখেই এটা দেখা যাচ্ছে। আপনি যদি ঢাকা শহরে হাঁটেন তাহলেই দেখবেন যে বৈষম্যের যে প্রকার আর বৈষম্যের যে ফাঁকটা সেটা কত বড়। অনেকেই বলেন যে আয়ের বৈষম্য বেড়েছে, সম্পদের বৈষম্য বেড়েছে। নিশ্চয়ই। কিন্তু আমি এগুলোকে বলি ফলাফলের বৈষম্য। এখন সবচেয়ে বড় বৈষম্য হলো সুযোগের বৈষম্য।

এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলা জরুরি যে, দারিদ্র্যের আপাতন কমেছে মানেই যে বাংলাদেশে অসমতা বা বৈষম্য কমেছে তা কিন্তু নয়। বরং আমরা দেখছি যে দেশে অসমতা বা বৈষম্য ক্রমাগত বেড়ে চলেছে এবং এটা দেখার জন্য বা বোঝার জন্য আপনার অর্থনীতিবিদ হওয়ার প্রয়োজন নেই— খালি চোখেই এটা দেখা যাচ্ছে। আপনি যদি ঢাকা শহরে হাঁটেন তাহলেই দেখবেন যে বৈষম্যের যে প্রকার আর বৈষম্যের যে ফাঁকটা সেটা কত বড়। অনেকেই বলেন যে আয়ের বৈষম্য বেড়েছে, সম্পদের বৈষম্য বেড়েছে। নিশ্চয়ই। কিন্তু আমি এগুলোকে বলি ফলাফলের বৈষম্য। এখন সবচেয়ে বড় বৈষম্য হলো সুযোগের বৈষম্য।

শিক্ষাক্ষেত্রের আলোচনায় সুযোগের বৈষম্যটা স্পষ্টভাবে বোঝা যায়— আজকে আমরা বাংলাদেশে যে ত্রিধারার বা ত্রিমুখী শিক্ষাব্যবস্থা দেখছি— বিত্তবানদের জন্য ইংরেজিমাধ্যম শিক্ষা, আরেকটা হচ্ছে সাধারণের জন্য সরকারি শিক্ষা যেটা বাংলামাধ্যমে চলছে এবং আরেকটা হচ্ছে ধর্মীয় শিক্ষা বা মাদ্রাসার শিক্ষা। বিত্তবানদের ইংরেজিমাধ্যম শিক্ষায় যে সুযোগ আছে সেটা সরকারি বাংলামাধ্যমে নেই। আজকে ঢাকার ইংরেজিমাধ্যম স্কুলে একটা ছেলে বা মেয়ে যে সুযোগ পাচ্ছে নেত্রকোণার একটা স্কুলের ছেলে-মেয়েরা সে সুযোগ পাচ্ছে না।

শিক্ষার ক্ষেত্রে সুযোগের যে বৈষম্য দেখা যাচ্ছে স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও তেমনি একইরকম সুযোগের বৈষম্যের কথা বলা যায়। এখানেও সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা আছে, বেসরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা আছে। সরকারি যে স্বাস্থ্যব্যবস্থা আছে যেখানে সেবা খুব অপ্রতুল, সম্পদ খুব অপ্রতুল। দরিদ্র ও সাধারণ মানুষরা সেখানে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তুলনামূলকভাবে সক্ষমরা বেসরকারি খাতের চিকিৎসা নিচ্ছেন। আবার একইসঙ্গে বিত্তবানদের জন্য দেশের বাইরে গিয়ে চিকিৎসা নেওয়ার ব্যবস্থা আছে। বিত্তবানরা সিঙ্গাপুর বা ব্যাংককে স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারছেন। সুতরাং আমি মনে করি যে, দারিদ্র্যের আপাতন কমলেও আয় ও সম্পদের বৈষম্য যেমন বাড়ছে তেমনি সুযোগের বৈষম্যও বেড়ে চলেছে, ফলে বঞ্চনার প্রশ্নটি থেকেই যাচ্ছে।

সকাল সন্ধ্যা: দারিদ্র্য দূরীকরণে সাফল্য সত্ত্বেও সমাজে বৈষম্যে বাড়তে থাকার বিষয়টি আপনি ব্যাখ্যা করলেন। এবার দেশে মানব উন্নয়ন পরিস্থিতি নিয়ে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই।

সেলিম জাহান: মানব উন্নয়নের ক্ষেত্রে সামাজিক সূচকে আমাদের যে অর্জন সেটা শুধু বাংলাদেশের প্রেক্ষিতেই নয়, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গেও যদি তুলনা করি তাহলেও দেখা যাবে মানব উন্নয়নে বাংলাদেশের অগ্রগতি অনেক। আজকে বাংলাদেশের প্রত্যাশিত গড় আয়ু ৭৩ বছর, ভারতে এটা ৭০ বছর, পাকিস্তানে ৬৭ বছর। পাঁচ বছরের নিচে শিশুমৃত্যুর হার আমরা ২১-এ নামিয়ে আনতে পেরেছি, ভারতে এটা ৩৪ আর পাকিস্তানে ৬৫। সুতরাং মানব উন্নয়নের ক্ষেত্রেও আমাদের অর্জন অনেকখানি। কিন্তু মানব সম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রে কিন্তু অনেক রকমের বাধা এখনও রয়ে গেছে।

সকাল সন্ধ্যা: এই যে দারিদ্র্যের আপাতন কমার সাফল্য সত্ত্বেও সমাজে বৈষম্যে বাড়ছে, মানব উন্নয়নে অনেক অর্জন সত্ত্বেও অনেক বাধা থেকে যাচ্ছে; আমাদের দেশে এখনও এমন বৈষম্য বাড়তে থাকার কারণগুলো কী বা এমন সব বাধা কেন দূর করা যাচ্ছে না? আপনি কী মনে করেন?

সেলিম জাহান: আসলে একটা দেশে বৈষম্য তখনই বাড়ে যখন উন্নয়ন প্রক্রিয়াটা সুষমভাবে বন্টিত না হয়, উন্নয়নের সুফল যদি সুষমভাবে বন্টিত না হয় এবং উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় প্রবৃদ্ধির যে সংঘটন সেটা যদি পক্ষপাতদুষ্ট থাকে। ধরুন, আপনি প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর চেষ্টা করছেন, সেটা বিভিন্নভাবে হতে পারে— হতে পারে আপনি কৃষিতে বিনিয়োগ করে কৃষিতে কর্মনিয়োজন করে প্রবৃদ্ধি অর্জনের চেষ্টা করছেন। আবার শ্রমঘন একটা প্রযুক্তি যদি আপনি ব্যবহার করেন তাহলে সেখানে প্রবৃদ্ধি বাড়বে এবং শ্রমিকরা তার সুফল ভোগ করবে। আবার যদি আপনি মনে করেন আমি প্রবৃদ্ধি বাড়াতে চাই তথ্যপ্রযুক্তি খাতের প্রসারের মাধ্যমে, তাহলে আমরা জানি তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার বাড়ে পুঁজিঘন একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে, আর তখন কিন্তু দেখা যাবে এর সুফল চলে যাবে ধনিকশ্রেণির হতে। অর্থাৎ, আপনি কোন পথে প্রবৃদ্ধি সংঘটনের দিকে যাচ্ছেন সেকারণেও বৈষম্য বেড়ে যেতে পারে।

এখন এই সম্পদ যদি ধনিকশ্রেণির হাতেই কুক্ষিগত থাকে, বিপুল সম্পদ যদি বিদেশে পাচার হয়ে যায়, তাহলে দরিদ্রশ্রেণির মানুষদের জন্য ঋণসুবিধা বলুন, সম্পদের সুযোগ বলুন সেটা তো ভীষণ সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে, অর্থাৎ গরিব মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে। এই বঞ্চনার কারণেই দেখা যাচ্ছে বৈষম্য বেড়ে যাচ্ছে, সমাজে অসাম্য বেড়ে যাচ্ছে।

দ্বিতীয় কথা হলো, ধরুন যে প্রবৃদ্ধি বাড়ল, এখন আপনি সেটা কীভাবে বন্টন করবেন বা এর সুফল কারা কীভাবে ভোগ করবে সেজন্য নীতিমালা প্রয়োজন। যেমন আমরা যে কর নীতি অনুসরণ করছি সেটা কি ধনিকশ্রেণিকে সুবিধা দিচ্ছে না কি দরিদ্রশ্রেণিকে সুবিধা দিচ্ছে? আপনি ঋণ সুবিধা দিচ্ছেন, এখন দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে যারা ধনিকশ্রেণি তারা ঋণ নিচ্ছে কিন্তু ফেরত দিচ্ছে না, আবার ধনিকশ্রেণি বিদেশে সম্পদ পাচার করছে এবং সেটা বিপুল পরিমাণে, যেখানে ব্যক্তিপর্যায়েই পাঁচ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হচ্ছে। মনে রাখতে হবে যে সম্পদের সীমাবদ্ধতা আছে। এখন এই সম্পদ যদি ধনিকশ্রেণির হাতেই কুক্ষিগত থাকে, বিপুল সম্পদ যদি বিদেশে পাচার হয়ে যায়, তাহলে দরিদ্রশ্রেণির মানুষদের জন্য ঋণসুবিধা বলুন, সম্পদের সুযোগ বলুন সেটা তো ভীষণ সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে, অর্থাৎ গরিব মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে। এই বঞ্চনার কারণেই দেখা যাচ্ছে বৈষম্য বেড়ে যাচ্ছে, সমাজে অসাম্য বেড়ে যাচ্ছে।

তৃতীয় বিষয়টি হলো, যে কথা এখন আমরা প্রায়ই বলে থাকি— অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া বলি, অর্থনৈতিক উৎপাদন বা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বলি এই বিষয়গুলো কিছু গোষ্ঠীর হাতে কুক্ষিগত হয়ে আছে এবং এই গোষ্ঠীগুলোই কিন্তু পুরো অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াটাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। সেটা আপনি মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রেও দেখতে পাবেন, সেটা আপনি উৎপাদনের ক্ষেত্রেও দেখতে পাবেন এবং সেটা আপনি সেবাখাতের ক্ষেত্রেও দেখতে পাবেন। 

বর্তমান বাস্তবতায় আমরা প্রবৃদ্ধির যে প্রক্রিয়া সেটাকে পক্ষপাতদুষ্ট করে ফেলেছি, আমাদের নীতিমালায় ধনিকশ্রেণিকে একধরনের সহায়তা আমরা দিচ্ছি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বন্টনের প্রক্রিয়ায় ধনিকশ্রেণি সেই সুফলটা ভোগ করছে আর দরিদ্ররা বঞ্চিত হচ্ছে, ফলে বৈষম্যও বাড়ছে।

আমরা দেখতে পাচ্ছি যারা নীতিনির্ধারক যারা আইনপ্রণেতা তাদের বেশিরভাগই আসলে ব্যবসায়ী। আপনি জাতীয় সংসদের দিকে তাকালেই দেখতে পাবেন ৬৫ বা ৬৬ শতাংশ সংসদ সদস্যই ব্যবসায়ী, তারা ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্র থেকে রাজনীতিতে এসেছেন, শিল্পপতি থেকে সংসদ সদস্য হয়েছেন। অথচ, ১৯৭৩ সালের সংসদে সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র ছিল, সেই সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যই রাজনীতি থেকে এসেছেন— শ্রমিক আন্দোলন থেকে, শিক্ষকতা থেকে, আইনজীবীদের মধ্য থেকে, চিকৎসকদের মধ্য থেকে তারা সংসদ সদস্য হয়েছেন। কিন্তু এক্ষেত্রে বর্তমান বাস্তবতায় আমরা প্রবৃদ্ধির যে প্রক্রিয়া সেটাকে পক্ষপাতদুষ্ট করে ফেলেছি, আমাদের নীতিমালায় ধনিকশ্রেণিকে একধরনের সহায়তা আমরা দিচ্ছি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বন্টনের প্রক্রিয়ায় ধনিকশ্রেণি সেই সুফলটা ভোগ করছে আর দরিদ্ররা বঞ্চিত হচ্ছে, ফলে বৈষম্যও বাড়ছে।

সকাল সন্ধ্যা: আমরা জানি বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনে, একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামের অগ্রযাত্রায় অন্যতম প্রধান যুক্তি ছিল বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, পশ্চিম পাকিস্তানে সম্পদ পাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো তথা সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়। কিন্তু এখন স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে একদিকে ‘উন্নয়ন বিস্ময়’ বলে অভিহিত করা হচ্ছে অন্যদিকে সেখানে আবারও ক্রমাগত বৈষম্য বৃদ্ধি এবং বিদেশে সম্পদ পাচারের উল্টোযাত্রা দেখা যাচ্ছে। এর নেপথ্যে কী একটা রাজনৈতিক ব্যর্থতা দায়ী বলে মনে করেন? এই পরিস্থিতিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

সেলিম জাহান: এটা অনস্বীকার্য যে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের একটা মূল চালিকাশক্তি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্বপাকিস্তানের বৈষম্য। এই বৈষম্য যে কেবল অর্থনৈতিক ছিল তা নয়, বৈষম্য সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও ছিল, বৈষম্য রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও ছিল। আর সেই বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যই বাংলাদেশের জন্ম। সেই পথেই মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা একটা স্বাধীন রাষ্ট্র লাভ করেছি, যেখানে আমরা বৈষম্য কমিয়ে এনে সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে পারব। বাহাত্তরের সংবিধান দেখেন এবং স্বাধীন বাংলাদেশের চার মূলনীতি দেখেন— বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা আমাদের চার মূলনীতি। এর মধ্যে আমরা এখন গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের কথা আলোচনা করতে পারি, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা এখন নাই বা বললাম।

দেখুন, গণতন্ত্রের কথা যখন বলা হয়েছে তখন কিন্তু কেবল রাজনৈতিক গণতন্ত্রের কথা বলা হয়নি—অর্থনৈতিক গণতন্ত্র এবং সাংস্কৃতিক গণতন্ত্রের কথাই আমরা বলেছি— গণতন্ত্রের ব্যপ্ত ও বৃহত্তর সংজ্ঞার মধ্যেই সেগুলো ছিল। ফলে গণতন্ত্র মানে কেবল ভোটাধিকার ও সরকার গঠন নয়, গণতন্ত্র মানে সম্পদ সুষমভাবে বন্টন হবে, উন্নয়নের সুফল সুষমভাবে বন্টন হবে; সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে জাতি-গোষ্ঠী-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেকের কণ্ঠ সেখানে আমরা শুনতে পাব—এটাই হলো গণতন্ত্র। এখন সমাজতন্ত্রের কথা বলা যাক। বাহাত্তরে প্রচুর আলোচনা-তর্ক-বিতর্ক হয়েছে যে সমাজতন্ত্র বলতে আমরা কি বুঝব— এটা কি চৈনিক সমাজতন্ত্র নাকি রুশ সমাজতন্ত্র? কিন্তু বঙ্গবন্ধু যে অর্থে সমাজতন্ত্র কথাটা গ্রহণ করেছিলেন সেটা ছিল সামাজিক ন্যায্যতার অর্থে সমাজতন্ত্র, যেটাকে আমরা ইংরেজীতে সোশ্যাল জাস্টিস বলি। অর্থাৎ কাউকে অন্যায্যভাবে অর্থনৈতিক সুফল ভোগ করতে দেওয়া যাবে না, কোনও শ্রেণি বা গোষ্ঠীকে অন্যায্যভাবে বঞ্চিত করা যাবে না।

এখানে আরেকটা কথা উল্লেখ করা ও বোঝা জরুরি, বঙ্গবন্ধু সাতই মার্চের ভাষণ যে কথাটা দিয়ে শেষ করেছিলেন— ‘‘এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।’’ বোঝা দরকার তিনি কেন ‘স্বাধীনতা’ ও ‘মুক্তি’ আলাদা আলাদা দুটো শব্দ ব্যবহার করেছিলেন। এটা শুধু ভাষাগত বিষয় নয়, পুরো বিষয়টিকে তিনি দুটো প্রেক্ষিত থেকে দেখেছিলেন। স্বাধীনতা— অর্থাৎ শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করলেই কিন্তু অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি আসেনা। মুক্তি ব্যাপারটি স্বাধীনতার চেয়ে বড়, মুক্তির পরিসর আরও ব্যপ্ত। একাত্তরে আমরা যে রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করেছি সেটা আমাদের মুক্তির জন্য আবশ্যকীয় শর্ত কিন্তু পর্যাপ্ত শর্ত নয়, সেটা পর্যাপ্ত হবে তখনই যখন আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, আমাদের অর্থনৈতিক সংঘটন, আমাদের অর্থনৈতিক চাওয়া পাওয়া সেসব যখন সাধারণ দরিদ্র মানুষের অভিমুখে ধাবিত হবে। এ কারণেই তিনি ‘স্বাধীনতা’ ও ‘মুক্তি’ দুটো শব্দই উচ্চারণ করেছিলেন।

এখন আমরা আলোচনা করতে পারি যে, একাত্তরের রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশ আবারও কেন উল্টোপথে হাঁটা শুরু করল— বৈষম্য দূর না করে বৈষম্য বাড়ানোর দিকে গেল, কেন সম্পদ ও উন্নয়নের সুষম বন্টন না করে সম্পদ পাচারের পথে গেল। এই উল্টোযাত্রা শুরু হয়েছিল পঁচাত্তরে, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে, জেল হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে, একের পর এক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। সেময় ধর্মনিরপেক্ষতার মূলনীতি বাদ দিয়ে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা হয়েছে, বাংলাদেশের সমাজে ও রাষ্ট্রে একটা ইসলামীকরণ করা হয়েছে। পুঁজিবাদকে সামনে আনা হয়েছে, নতুন করে পুঁজিপতিদের ক্ষমতায়ন করা হয়েছে। অনেকেরেই মনে থাকবে, একজন রাষ্ট্রপতি বলেছিলেন— ‘‘মানি ইজ নো প্রবলেম’’; তিনি আরও বলেছিলেন,‘‘আই উইল মেইক পলিটিকস ডিফিকাল্ট ফর পলিটিশিয়ানস।’’

এভাবে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের গতিপথ পাল্টে গেল, গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্র-ধর্মনিরপেক্ষতার দিকে যাত্রা থেকে বাংলাদেশ সরে গেল এবং মনে রাখবেন তখনই কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নিবিড় হতে শুরু করল। সেই সঙ্গে একটা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার দিকে আমরা গেলাম, কতগুলো গোষ্ঠীকে আমরা সুযোগ দিতে শুরু করলাম, এই গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে যারা একাত্তরে বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছিল সেই সব মানুষেরাও ছিল। এই দিকে যখন আমরা যেতে শুরু করলাম তখন কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই আমরা বেপথু হতে শুরু করলাম। সমাজতন্ত্রের কথা কেউ মনে রাখেনি, সামাজিক ন্যায্যতার কথা কেউ মনে রাখেনি। ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে আমরা ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে গ্রহণ করেছি। এই যে পরিবর্তন এটা কি শুধু অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া, এটা কি শুধু বৈশ্বিক প্রক্রিয়া? নাহ, এর পেছনে রাজনীতি কাজ করেছে। শেষ পর্যন্ত একটা দেশের অগ্রযাত্রা কোন দিকে হবে, কোন পথে হবে সেটার দিক নির্ধারিত হয় রাষ্ট্রের কাছ থেকে। আমি মনে করি যে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর থেকে যে ব্যাপারটি ঘটেছিল, আমাদের বেপথু হওয়ার যে রাজনীতি— একটা ষড়যন্ত্রের যে রাজনীতি শুরু হয়েছিল সেটাই কিন্তু পরবর্তীকালের বাংলাদেশের অনেক নিয়তি নির্ধারণ করে দিয়েছিল।

এখন পর্যন্ত আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, সামাজিক ন্যায্যতার প্রশ্নটি, বৈষম্য দূর করার প্রশ্নটি পেছনে পড়ে আছে এবং আমরা প্রবৃদ্ধি নিয়ে খুব মাতামাতি করছি। আপনি যেটা বলছিলেন যে বাংলাদেশকে তো ‘উন্নয়ন বিস্ময়’ বলা হচ্ছে। হ্যাঁ বিস্ময়কর তো অনেক দিক থেকেই— প্রবৃদ্ধির দিক থেকে, তারপর সামাজিক সূচকগুলোর দিক থেকে। আপনি যদি ভৌত-অবকাঠামোর কথা বলেন, অবশ্যই এক্ষেত্রে অনেক কিছুই করেছি আমরা। কিন্তু আমরা তো এটা সুষমভাবে করতে পারিনি। অর্থনীতির বলয়ের মধ্যেও যা যা আমাদের অর্জন সেসবের বন্টন আমরা সুষমভাবে করতে পারিনি। যে কারণে আমরা প্রান্তিক মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারিনি। আমরা দারিদ্র্যের আপাতন কমিয়ে আনতে পেরেছি, কিন্তু ৩ কোটি ৪০ লাখ মানুষ যদি দারিদ্রসীমার নিচে থাকে সেখানে তো এটা স্পষ্ট যে তাদের কাছে আমরা পৌঁছাতে পারিনি।

আমরা যদি অর্থনৈতিক অগ্রগতি থেকে আরেকটু সামনে যাই এবং প্রশ্ন করি যে, উন্নয়নের মাপকাঠি কি? উন্নয়ন তো শুধু কতটা সম্পদ আমরা অর্জন করেছি, আমরা কতটা আয় করেছি তা নয়। উন্নয়নের মাপকাঠি হচ্ছে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটা আছে কি না, মানুষের কণ্ঠস্বরের স্বাধীনতা আছে কি না— দেশের যেসব নীতিমালা গ্রহণ করা হচ্ছে সেখানে সাধারণ মানুষ কোনও প্রভাব রাখতে পারছেন কি না। এই ক্ষেত্রগুলোতে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে অনেক রকমের ঘাটতি আমাদের আছে।

আজকে আমরা বাংলাদেশের দিকে তাকালে দেখতে পাই— আমরা সবার কথা ভাবছি না, আমরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গেছি। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশের সব আন্দোলন, সব অর্জন হয়েছিল যুথবদ্ধতার মধ্য দিয়ে— যৌথভাবে। তখন আপনি কি সিলেটের নাকি বরিশালের, আপনি নারী কি পুরুষ, আপনি হিন্দু কি মুসলমান এসব বড় প্রশ্ন ছিল না। আমরা সব লড়াই একসাথে মিলে করেছি। কিন্তু আজকে বাংলাদেশে আত্মকেন্দ্রিকতা অসম্ভব বেড়ে গেছে, আজকে আত্মপ্রচার বেড়েছে, আজকে আত্মস্বার্থ বেড়েছে। এখন চারদিকে আমি-সংস্কৃতি, আমরা-সংস্কৃতি নেই। এই পরিস্থিতি যখন হয় তখন সুশাসনের একটা অভাব দেখা দেয়, সেখানে সম্পদ কুক্ষিগত করার প্রবণতা বেড়ে যায়। আজকে যদি আমরা সমাজে সাফল্যের মাপকাঠি দেখি দুটো জিনিস আমরা দেখতে পাই— একটা হচ্ছে ক্ষমতা আরেকটা হচ্ছে অর্থ এবং এই দুটো আবার পরষ্পর পরষ্পরের সঙ্গে খুব সুনিবিড়ভাবে গ্রথিত। এমনটা যখন আমার সাফল্যের মাপকাঠি হবে তখন অন্যান্য বিষয়গুলোকে আমি আর মূল্য দিব না, আমি আমার ক্ষমতা দেখাব আমি আমার অর্থ দেখাব। এই প্রক্রিয়ার হাত ধরেই কিন্তু বাংলাদেশের সমাজে ও সংস্কৃতিতে সন্ত্রাস এসেছে সহিংসতা এসেছে। কারণ আমরা তো আর অন্যকিছুকে গুরুত্ব দিচ্ছি না।

সকাল সন্ধ্যা: আপনি আয় ও সম্পদের বৈষম্যের চেয়েও সুযোগের বৈষম্যকে বড় বৈষম্য হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সুযোগের বৈষম্য যে কতটা প্রকট সেটাও আপনি বলছেন। এই সুযোগের বৈষম্য নিঃসন্দেহে প্রবলভাবে শ্রেণিবৈষম্যে বিভাজিত একটা সমাজের প্রতিচ্ছবি। তেমনি আমরা দেখছি যে সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয়চিন্তার ক্ষেত্রেও আমাদের সমাজ প্রবলভাবে বিভাজিত হয়ে পড়েছে এবং এই বিভাজন রেখাটা ক্রমশ আরও প্রকট হচ্ছে। অথচ, আপনি বলছিলেন যে স্বাধীনতাপূর্ব সময় থেকে স্বাধীনতার পরও বাংলাদেশে ঐক্যবদ্ধ একটা সামাজিক চৈতন্যের বিকাশ ঘটেছিল। আমরা যদি মানবসম্পদ উন্নয়নের বিবেচনায় বিষয়টিকে বিশ্লেষণ করি এবং সমাজে বিদ্যমান তিন ধারার শিক্ষাব্যবস্থার প্রভাব নিরূপণের চেষ্টা করি তাহলে আমরা কী দেখতে পাই? আমরা কি এটা বলতে পারি যে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন সত্ত্বেও আমাদের সমাজে কাঙ্ক্ষিত মানবিক প্রগতি অর্জিত না হওয়ার পেছনে এই বিভাজনের রাজনীতি অনেকাংশে দায়ী? তা সেটা সুযোগ-বৈষম্যের বিভাজন হোক কিংবা শিক্ষা-সংস্কৃতি-ধর্মীয় বিভাজনই হোক? এ বিষয়ে আপনার কাছ থেকে শুনতে চাই এবং আগামীদিনে সমতাভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ বা করণীয় নিয়ে জানতে চাই।

সেলিম জাহান: এটা খুব সুন্দর প্রশ্ন এবং খুব সুন্দরভাবে আপনি এটা ব্যাখ্যা করেছেন। প্রথম কথা হলো, বিভাজন কেবল অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকেও বিভাজন হচ্ছে। অর্থনৈতিক দিক থেকে যে কথাটা আমরা বললাম যে সুযোগের বৈষম্য আছে, সাংস্কৃতিক দিক থেকে যদি বলি যে বাঙালি সংস্কৃতি এবং ইসলামী সংস্কৃতির একটা বিভাজন আমরা দেখতে পাচ্ছি। এখন কথা হলো যে বিভাজন কিভাবে হচ্ছে? এটা কি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় বিভাজন হয়— এমনি এমনি হচ্ছে? না। মনে রাখতে হবে বিভাজন যেমন প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় হয় না, ঐক্যও তেমনি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় হয় না। বিভাজনই হোক বা ঐক্য, সেটার জন্য প্রচেষ্টার প্রয়োজন হয়, একটা মানসিকতা তৈরি করার প্রয়োজন হয়।

আমাদের সমাজে বিভাজন কেন হচ্ছে? কারণ বিভাজন টিকিয়ে রেখে কিংবা বিভাজন বর্ধিত করে একটা গোষ্ঠী এখান থেকে সুযোগ পাচ্ছে।

প্রথমত, অর্থনীতির দিক থেকে দেখলে ধনিকশ্রেণির প্রতিনিধিরা যত বেশি বৈষম্য তৈরি করতে পারবেন, যত বেশি সম্পদ কুক্ষিগত করতে পারবেন তাদের লাভ বা মুনাফা তত বেশি হবে। খুব সাধারণ উদাহরণ হচ্ছে— তৈরিপোশাক শিল্প। আমরা প্রত্যেকেই জানি যে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পোশাকশিল্পের কতখানি গুরুত্ব তৈরি হয়েছে। রপ্তানি আয়ের সিংহভাগই প্রায় এককভাবে সেখান থেকে আসে। কিন্তু আপনি লক্ষ্য করেছেন গত পাঁচ-দশ বছরে যখনই শ্রমিকের বেতন এক হাজার বা দুহাজার টাকা বাড়ানোর কথা উঠেছে তখনই পোশাকশিল্পের মালিকরা বলেছেন যে তাহলে পোশাকশিল্প ছারখার হয়ে যাবে। বুঝতেই পারা যাচ্ছে একটা গোষ্ঠী এমন বিভাজন রেখে বৈষম্য জিইয়ে রেখে বিপুলভাবে লাভবান হচ্ছে।

অর্থনৈতিক দিক থেকে যে কথাটা আমরা বললাম যে সুযোগের বৈষম্য আছে, সাংস্কৃতিক দিক থেকে যদি বলি যে বাঙালি সংস্কৃতি এবং ইসলামী সংস্কৃতির একটা বিভাজন আমরা দেখতে পাচ্ছি। এখন কথা হলো যে বিভাজন কিভাবে হচ্ছে? এটা কি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় বিভাজন হয়— এমনি এমনি হচ্ছে? না। মনে রাখতে হবে বিভাজন যেমন প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় হয় না, ঐক্যও তেমনি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় হয় না। বিভাজনই হোক বা ঐক্য, সেটার জন্য প্রচেষ্টার প্রয়োজন হয়, একটা মানসিকতা তৈরি করার প্রয়োজন হয়।

দ্বিতীয়ত, আমরা যদি ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিভাজনের দিকে দেখি— বিশেষত ধর্মীয় সংস্কৃতি বনাম উদারপন্থী সংস্কৃতি; তাহলে দেখতে পাব যে এক্ষেত্রেও কিন্তু ধর্মীয় সংস্কৃতির কথা বলে একটা বিভাজন টিকিয়ে রেখে বা বর্ধিত করে একটা গোষ্ঠী এখান থেকেও লাভবান হচ্ছে। অনেকেই আশা করেছেন এবং করেন যে যতই আমাদের ধর্মীয় সংস্কৃতি মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক হবে ততই যেন আমরা সেখান থেকে আরও বেশি সম্পদ আনতে পারব। আবার মানসিকতার দিক থেকে, মূল্যবোধের দিক থেকে, চেতনার দিক থেকে আমরা ধর্মের দিকে অনেক বেশি ঝুঁকে পড়েছি। যদি জিজ্ঞেস করেন এটা কেন হলো? বিবিধ কারণ আছে, এর কোনও একটা একরৈখিক উত্তর দেওয়া যাবে না। আমি এটাকে দেখি এভাবে যে— আমাদের প্রত্যেকেরই বিবিধ সত্তা আছে— আমাদের বহুমাত্রিক আত্মসত্তা আছে, নিত্যদিনই সেসবের মধ্যে দিয়ে আমাদের যেতে হয়। যেমন আপনি সাংবাদিকতা করেন, আপনি চারুকলায় লেখাপড়া করেছেন শিল্পী হিসেবে আপনার প্রশিক্ষণ আছে, আবার পরিবারের মধ্যে আপনার নানান ভূমিকা আছে। এখন আপনি যদি কোনও একটি সত্তার দিকে ঝুঁকে পড়েন, আপনি যদি মনে করেন যে আমি সাংবাদিক এটাই আমার পরিচয় হবে, কোনও অসুবিধা নেই। কিন্তু যদি কোনও একটি আত্মপরিচয়কে নিয়ে আপনি চরম শ্রেষ্ঠত্বের অবস্থান নেন তখনই দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। আত্মসত্তা নিয়ে এমন চরম শ্রেষ্ঠত্বের অবস্থান নিলে— আমিই শ্রেষ্ঠ, বাকি সব নিকৃষ্ট এমন একটি অবস্হান নিলে— তখনই সমস্যা তৈরি হয়।  যদি এটা আমরা ধর্মের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করি যে, আমি খৃষ্টান, এটাই আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়, আমার ধর্মের চেয়ে আর কোনও ধর্মই শ্রেষ্ঠ নয়— বাকি যত ধর্মীয় গোষ্ঠী আছে তারা কোনওভাবেই আসল ধর্মীয় গোষ্ঠী নয়— তারা বিধাতার কাছে গ্রহণযোগ্য নয় আমার কাছেও গ্রহণযোগ্য নয়, তখন তো একটা দ্বন্দ্ব আসবেই। একই কথা সবার ক্ষেত্রেই। এমনটা ভাবলে সংকট সৃষ্টি হবে। একটা বিভাজন আসবে। এমন যে কোনও সাংস্কৃতিক চরম শ্রেষ্ঠত্বের অবস্থান, ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্বের চরম অবস্থানে যখন আমরা যাব তখন দ্বন্দ্ব অনিবার্য।

এখন আপনি হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কথা বলছেন— আমাদের ইতিহাস তো সাংস্কৃতিক ঐক্যের ইতিহাস, ধর্মীয় ঐক্যের ইতিহাস। ধর্ম ব্যাপারটি আমাদের যার যার বিশ্বাস ও চর্চার বিষয় ছিল। নিজ নিজ ধর্মীয় আচার-উৎসবের মতোই আমাদের পাড়া-প্রতিবেশি যারা ছিল অন্য ধর্মের, আমরা সবাই তো তাদের উৎসবে গেছি, তারা আমাদের উৎসবে এসেছে, এমন একটা সামাজিক-সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের মধ্য দিয়েই তো আমরা বড়ো হয়ে উঠেছি। ধর্মীয় বিভাজনের এমন সংকট কিন্তু তখন তৈরি হয়নি।

সকাল সন্ধ্যা: বাঙালি তো ঐতিহাসিকভাব একটা শঙ্কর জাতি, পৃথিবীর বৃহত্তম শঙ্কর জাতিসত্তাগুলোর একটা বাঙালি। এই শঙ্করায়ণ যেমন নৃতাত্ত্বিক, তেমনি ভাষাগত, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, সবরকমভাবেই এই শঙ্করায়ণ ঘটেছে। কিন্তু এর বিপরীতে আজকে আমরা যেমন ধর্মীয় সংস্কৃতির উত্থান দেখছি সেটা কিন্তু একরৈখিক। আজকে অনেকে যেমন একটা ইসলামীসংস্কৃতির কথা বলছেন সেটা কি আমাদের ঐতিহ্য? বাংলাদেশ যেমন বহু সুফী-দরবেশ-বাউল-ফকিরের দেশ তেমনি বহু কবি-দার্শনিক-চিন্তকের দেশ যারা সব ধর্মের মানুষের মধ্যে ঐক্যের কথা বলেছেন, উদার মানবতাবাদের কথা বলেছেন। ইতিহাসেও আমরা দেখি যে বাংলায় বহু ধর্মের মেলবন্ধন ঘটেছে। এক ধর্ম অন্য ধর্মকে প্রভাবিত করেছে। এভাবে ধর্মীয় সহনশীলতা তৈরি হয়েছে এবং পারষ্পরিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। ইসলামের সাম্যবাদী দর্শন এখানে অন্য ধর্মগুলোকে ঋদ্ধ করেছে। ধর্মীয় বিশ্বাস আর সংস্কৃতি তো এক কথা নয়— এছাড়া ইসলামী সংস্কৃতি বলতে সারা পৃথিবীতে তো কোনও একক সংস্কৃতি নেই। পারস্য বা ভারত বা বাংলার বা দূরপ্রাচ্যের মুসলিম সবারই যার যার স্থানীয় বা জাতিগত সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় সংস্কৃতির একটা মেলবন্ধনের মধ্য দিয়ে যার যার সংস্কৃতি। একইভাবে আজকে আমরা সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয় ক্ষেত্রের একরৈখিকতা বা একদেশদর্শিতার মতোই রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও একটা একরৈখিকতার বিস্তার দেখতে পাচ্ছি, যা আমাদের সমাজকে আরও বিভাজিত করছে। এখান থেকে উত্তরণের উপায় কী?

সেলিম জাহান: আপনি একটা কথা বলেছেন যেটা আমার খুব ভালো লেগেছে। একটা হলো ধর্মবিশ্বাস আরেকটা হচ্ছে ধর্মীয়সংস্কৃতি। ধর্মবিশ্বাস তো প্রত্যেকের যার যার নিজের বিষয়, ব্যক্তিগত। আপনার ধর্মবিশ্বাস একরকম, আপনি বিধাতাকে একভাবে দেখেন, আমার ধর্মবিশ্বাস আরেকরকম, আমি বিধাতাকে আরেকভাবে দেখি। এটা নিয়ে কোনও দ্বন্দ্ব নেই কারণ এটা আমরা তুলনা করছি না। ফলে ধর্মবিশ্বাসটা আমাদের অত্যন্ত ব্যক্তিগত, অত্যন্ত ভেতরের। ধর্মীয় সংস্কৃতির কথা যখন আসে তখন আমরা দেখি, এটা প্রবাহমান, স্থির নয়, এটা একেক দেশে একেক সময় একেকভাবে রূপ পায়, একে অন্যের কাছ থেকে নেয়।

যেটা এখন মূল প্রশ্ন যে, আজকে আমরা যে বিভাজন দেখতে পাচ্ছি এখান থেকে উত্তরণের উপায় কী? আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি এই বিভাজন থেকে উত্তরণ পাঁচবছর দশবছরে ঘটবে না। কারণ এত বেশি বিভাজিত আমরা হয়েছি এত বেশি মেরুকরণ আমাদের হয়েছে যে আপনার আমার প্রজন্মের মধ্যে দিয়ে এর উত্তরণ ঘটবে না। আমি যদি খুব খারাপভাবে বলি তাহলে বিষয়টা হলো— আমরা নষ্ট হয়ে গেছি।

ফলে আপনাকে লক্ষ্য নিতে একটা নতুন প্রজন্ম তৈরি করার। আর সেজন্য আপনাকে কাজ করতে হবে শিক্ষাক্ষেত্রে। কিন্তু আজকে পাঠ্যপুস্তকগুলোতে এমন সব উদাহরণ ব্যবহার করা হচ্ছে, আবার এমন সব কবিতা, এমন সব বিষয় বাদ দেওয়া হয়েছে যাতে এটা স্পষ্ট যে, বিজ্ঞানমনস্কতা থেকে আমরা কত দূরে সরে গেছি এবং ধর্মীয় সংকীর্ণতাকে আমরা কতটা প্রতিষ্ঠিত করেছি। মুশকিল হয়েছে যে, আমরা শিক্ষা নিয়ে অনেক কথা বলছি, শিক্ষাক্রমে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছি কিন্তু আসল কথটার কাছে যেন আমরা পৌঁছাতে পারছি না। আমরা সৃজনশীল শিক্ষার কথা বলছি, আমরা শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নে বাইরের দেশগুলোর কথা বলছি, কিন্তু শিক্ষার যেটা মূল ভিত্তি তার কথা বলছি না। শিক্ষা সেটা গণিত হতে পারে, ভাষা হতে পারে, বিজ্ঞান হতে পারে কিন্তু আসল কথাটা হলো মূল্যবোধ তৈরি করা। শিক্ষার দর্শন কিন্তু সেটাই, মূল্যবোধ তৈরি করা। এসব কারণে আমি মনে করি যে একটা প্রজন্মকে ধরতে হবে, একটা প্রজন্মকে তৈরি করতে হবে।

শুধু শিক্ষাক্রম নিয়ে ভাবলেই হবে না, সামাজিক ভিত্তির কথাও আমাদের ভাবতে হবে। আজকে যারা ধর্মীয় অজুহাত দিয়ে বিভাজন তৈরি করছে, মৌলবাদের দিকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করছে, সন্ত্রাস-সহিংসতা করছে তাদের তো প্রতিহত করতে হবে। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে কেবল সামাজিক আন্দোলনে এই প্রতিরোধ হবে না, একে রাজনৈতিক লড়াইয়ের অংশ করতে হবে। কারণ যতক্ষণ পর্যন্ত না রাজনৈতিক সমর্থন এবং অংশীদারত্ব পাওয়া না যাবে ততক্ষণ সেই প্রতিরোধ সফল হবে না।

শিক্ষা দিয়ে একটা প্রজন্মকে তৈরি করতে হলে একেবারে শিশুদের, যাদের বয়স পাঁচ-ছয় বছর তাদের নিয়ে কাজটা শুরু করতে হবে। তবে, সেজন্য পাঠ্যক্রম সংস্কার করতে হবে, বিভাজনের বদলে ঐক্যের ভিত্তি তৈরি করতে হবে। যা শিশুদের সংকীর্ণ করে সেসব বাদ দিতে হবে যা তাদের ঋদ্ধ করবে, উন্নত মূল্যবোধ তৈরি করবে সেসব অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। একইভাবে, এখনও যে তিনটি ধারার শিক্ষা আমরা দিয়ে যাচ্ছি সেটাকে একটা সমসত্তা বিশিষ্ট শিক্ষাক্রমে নিয়ে আসতে হবে। এরমধ্যে যে যে ধর্মের তার সে ধর্মের পাঠের ব্যবস্থা থাকতে পারে কিন্তু মনে রাখতে হবে ধর্মীয় শিক্ষার সর্বোৎকৃষ্ট জায়গা হচ্ছে পরিবার। পিতামাতার কাছ থেকে আমরা ধর্মীয় শিক্ষা নিব।

আরেকটা বিষয় হলো, শুধু শিক্ষাক্রম নিয়ে ভাবলেই হবে না, সামাজিক ভিত্তির কথাও আমাদের ভাবতে হবে। আজকে যারা ধর্মীয় অজুহাত দিয়ে বিভাজন তৈরি করছে, মৌলবাদের দিকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করছে, সন্ত্রাস-সহিংসতা করছে তাদের তো প্রতিহত করতে হবে। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে কেবল সামাজিক আন্দোলনে এই প্রতিরোধ হবে না, একে রাজনৈতিক লড়াইয়ের অংশ করতে হবে। কারণ যতক্ষণ পর্যন্ত না রাজনৈতিক সমর্থন এবং অংশীদারত্ব পাওয়া না যাবে ততক্ষণ সেই প্রতিরোধ সফল হবে না। একটা উদাহরণ দিই, একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচার করা তাদের নির্মূল করার দাবিটিকে শহীদজননী জাহানারা ইমাম সামাজিক আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে একটা পর্যায় পর্যন্ত নিয়ে গেলেন। তারপর তিনি বুঝতে পেরেছেন যে, রাজনৈতিক প্রক্রিয়া যদি এটাকে গ্রহণ না করে, রাষ্ট্র যদি এটাকে গ্রহণ না করে তাহলে সামাজিক আন্দোলন দিয়ে তো বিচার করা যাবে না, শাস্তি নিশ্চিত করা যাবে না। তখন রাজনৈতিক সমর্থনের মধ্যে দিয়ে এই প্রক্রিয়া এগিয়ে গেছে, রাষ্ট্র আইন করেছে, বিচারের প্রক্রিয়ায় গেছে, শাস্তি হয়েছে। ফলে মনে রাখতে হবে এটা শক্ত কাজ এবং বহু দিনের কাজ।

সকাল সন্ধ্যা: মানবসম্পদের বিবেচনা থেকে আরেকটি প্রশ্ন দিয়ে শেষ করতে চাই। আমরা দেশে বিপুল সংখ্যক শিক্ষিত বেকারের কথা জানি এবং একইসাথে আমরা কর্মসংস্থানের দাবির কথা জানি। অন্যদিকে আমরা রপ্তানি খাতের বহুমুখীকরণের কথা শুনি এককভাবে তৈরিপোশাকশিল্পের ওপর নির্ভরতা কমানোর কথা শুনি। কিন্তু কর্মসংস্থানের প্রশ্নে কর্মনির্ধারণের বিষয়টি কি অনালোচিত থেকে যায়? আমরা দেখছি আমাদের শ্রমশক্তির একটা বড় অংশ প্রবাসে অদক্ষ শ্রম বিক্রি করছে এবং দেশে তৈরিপোশাকশিল্পে শ্রম বিক্রি করছে। কিন্তু এরাই আবার আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের শীর্ষ দুই উৎস হিসেবে কাজ করছে। কিন্তু এক্ষেত্রে আমাদের কর্মসংস্থান নীতিটা আসলে কি? অর্থাৎ, আমাদের তরুণ জনগোষ্ঠীকে আমরা কিভাবে দক্ষ কর্মশক্তি হিসেবে তৈরি করব এবং কাদের কোন খাতে কিভাবে কর্মে নিয়োজিত করব এই পরিকল্পনার ঘাটতি এই বেকারত্ব বা কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলছে কি না বা এই সমস্যাটা নীতিনির্ধারণী দুর্বলতা থেকে হচ্ছে কি না?  

সেলিম জাহান: আমি চার পাঁচটি বিষয়ে কথাটা বলতে চাই। প্রথম কথা হলো, যারা মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে বেরিয়ে আসছে বা স্নাতক ডিগ্রি নিচ্ছে তাদের আমরা কী জাতীয় শিক্ষা দিচ্ছি? সনদ দিয়ে তো বের করে দিচ্ছি কিন্তা তারা কী শিখেছে? শিক্ষার মাধ্যমে এমন পর্যায়ের দক্ষতা তাদের দিতে হবে যা তারা কর্মজীবনে কাজে লাগাতে পারে। কোনও পক্ষপাত ছাড়াই বাস্তবতা বোঝার জন্য একটা উদাহরণ দিই। ধরুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে ছেলেটি বা মেয়েটি ইসলামের ইতিহাস থেকে পাশ করে বের হচ্ছে, শ্রমবাজারে তার কী চাহিদা আছে? কর্মক্ষেত্রে এই শিক্ষা তার কী কাজে লাগছে? এভাবে মাধ্যমিক বা উচ্চশিক্ষা বা কারিগরী বা মাদ্রাসা শিক্ষা যেটাই হোক না কেন প্রতিটি ক্ষেত্রেই আপনাকে ভাবতে হবে যে শ্রমবাজারের সঙ্গে এর সম্পর্কটা কি, কোন বিষয়ের কতটা চাহিদা আছে। বাস্তবতার নিরীখেই আপনার শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের নীতি নির্ধারণ করতে হবে।

দ্বিতীয় কথা হলো, সবাইকে উচ্চশিক্ষা নিতে হবে এটা আমি সমর্থন করি না। উচ্চশিক্ষার জন্য যে প্রস্তুতি এবং যে মন-মানসিকতা দরকার সেটা সবার মধ্যে থাকবে না এটাই স্বাভাবিক। ফলে, একটা পর্যায়ের পর শিক্ষার্থীরা তাদের যোগ্যতা, প্রস্তুতি ও বাজার চাহিদার ভিত্তিতে পেশাগত দক্ষতা অর্জনের শিক্ষার দিকে যাবে আর তাদের মধ্যে একটা অংশ উচ্চশিক্ষার দিকে যাবে।

তৃতীয় কথা হলো, আমরা কৃষিখাতের কথা বলি, কিন্তু এখনও পর্যন্ত কৃষিখাতের শ্রমে যারা নিয়োজিত আছে তারা কিন্তু পূর্বপ্রজন্মের। নতুন প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের কি কৃষিখাতে আনা যায় না? তার মানে আমি কি এটাই বলতে চাচ্ছি যে, তাদের সবাইকে লাঙ্গল-জোয়াল নিয়ে জমি চাষ করতে হবে? মোটেই তা না। কৃষিখাতে আরও অনেক কাজ করার সুযোগ আছে। তেমনি কৃষিজাত পণ্য প্রক্রিয়াকরণ, মৎসখাতের আধুনিকায়ন, সমুদ্রসম্পদ আহরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ এমন বহু সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র আমাদের আছে যেখানে মূল্যসংযোজনের অনেক সুযোগ আছে এবং যেখানে আমরা তরুণ-তরুণীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে এসব ক্ষেত্রে কর্মে নিয়োজিত করতে পারি। একইভাবে আমি বিশ্বাস করি, নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে আসা মেধাবী তরুণ-তরুণীদের আমরা ভালো উদ্যোক্তা বানানোর উদ্যোগ নিতে পারি।

খেয়াল করতে হবে আগামী দিনগুলোতে বিশ্বব্যাপী কোনও কোনও খাতে শ্রমের বাজার বর্ধিত হবে কোনও কোনও খাতে তা সঙ্কুচিত হয়ে যাবে। প্রযুক্তি ও বাজারের পরিবর্তনের কারণে বহু নতুন নতুন চাকরি আবির্ভূত হবে এবং বহু প্রথাগত চাকরি হারিয়ে যাবে। ফলে আগামী বিশ্বের সম্ভ্যাব্য শ্রমবাজার এবং সেই বাজারের শ্রমচাহিদা, সেখানে কী ধরনের দক্ষতাসম্পন্ন শ্রমিক লাগবে সেসব নিয়ে আমরা কি কোনও গবেষণা বা মূল্যায়ন করেছি? অথচ এটা আমাদের রাষ্ট্রীয়ভাবেই করা প্রয়োজন।

চতুর্থ বিষয় হলো, আমাদের মনে রাখতে হবে আমাদের দেশটা প্রায় আঠারো কোটি মানুষের দেশ। ফলে আমাদের নিজেদের বাজারটাই অনেক বড়। ফলে কর্ম নিয়োজনের প্রশ্নে সবসময় যে বহির্মুখী হয়ে থাকব তা কিন্তু নয়, নিজেদের বিশাল বাজারের জন্যই আমরা প্রয়োজনীয় দক্ষশ্রমশক্তি গড়ে তোলার লক্ষ্য নির্ধারণ করতে পারি। প্রবাসে অদক্ষ শ্রমিক রপ্তানি থেকে আমাদের আয় হচ্ছে, তারা অনেক ত্যাগ করছেন সেজন্য তাদের আমি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। কিন্তু মনে রাখতে হবে এই অদক্ষ শ্রমিকশ্রেণির মূল্যসংযোজন অনেক কম। খেয়াল করতে হবে আগামী দিনগুলোতে বিশ্বব্যাপী কোনও কোনও খাতে শ্রমের বাজার বর্ধিত হবে কোনও কোনও খাতে তা সঙ্কুচিত হয়ে যাবে। প্রযুক্তি ও বাজারের পরিবর্তনের কারণে বহু নতুন নতুন চাকরি আবির্ভূত হবে এবং বহু প্রথাগত চাকরি হারিয়ে যাবে। ফলে আগামী বিশ্বের সম্ভ্যাব্য শ্রমবাজার এবং সেই বাজারের শ্রমচাহিদা, সেখানে কী ধরনের দক্ষতাসম্পন্ন শ্রমিক লাগবে সেসব নিয়ে আমরা কি কোনও গবেষণা বা মূল্যায়ন করেছি? অথচ এটা আমাদের রাষ্ট্রীয়ভাবেই করা প্রয়োজন। এটা বুঝতে পারতে হবে যে, আগামীদিনে আমাদের তরুণ-তরুণীরা যে কেবল নিজেদের দেশের মধ্যেই প্রতিযোগিতা করবে তা নয়, তাদের বৈশ্বিকবাজারের মধ্যে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে হবে। সেজন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও দক্ষতা দিয়ে তাদের গড়ে তোলার কাজটা কি আমরা করছি?

পঞ্চম বা শেষ কথাটি হচ্ছে, শিক্ষাব্যবস্থাকে এরকম বিভাজিত রেখে আপনি সবার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারবেন না। মাদ্রাসাকেন্দ্রিক ধর্মীয় শিক্ষা থেকে প্রতিবছর যে বিপুলসংখ্যক তরুণ-তরুণী পাশ করে আসছে তাদের আমরা কোথায় শ্রমে নিয়োজিত করছি? তাদের কোথায় কাজ দেবেন? এই বিশাল শ্রমশক্তির ভবিষ্যৎ কী হবে? ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে কেবল শিক্ষা দিলেই তো হবে না কোন শিক্ষা উৎপাদনশীল খাতে নিয়োজিত হবে এবং কোন শিক্ষা অনুৎপাদনশীল খাতে নিয়োজিত হবে সেই বিবেচনা মাথায় রেখেই আপনাকে শিক্ষাক্রম এবং শিক্ষাকাঠামো পুনর্বিন্যাস করতে হবে। নইলে কর্ম নিয়োজনের ক্ষেত্রে এই সংকটগুলো থেকেই যাবে। মনে রাখতে হবে, শিক্ষা কর্মসংস্থান বা কর্ম নিয়োজনের বিষয়টি কেবলই অর্থনৈতিক বিষয় নয়, এর একটি সামাজিক মাত্রিকতা আছে, সাংস্কৃতিক মাত্রিকতা আছে এবং একটা পর্যায়ে গিয়ে এটার একটা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক মাত্রিকতা আছে। কারণ তরুণ সমাজ যদি দিনের পর দিন বেকার থাকে, তরুণ সমাজ যদি কাজ খুঁজে না পায়, সমাজ বা রাষ্ট্র যদি তাদের কাজ দিতে না পারে, তাহলে সামাজিক ঐক্য তো নষ্ট হবেই বরং সহিংসতা আসবে, সন্ত্রাস আসবে। পৃথিবীর নানান দেশে আমরা দেখেছি এমন বেকার ও অনুৎপাদনশীল তরুণ সমাজ রাজনৈতিক বিস্ফোরক হিসেবে কাজ করে। ফলে এই বিষয়গুলোকে অনেক ভিশনারিভাবে দেখতে হবে, অনেক সূদূরপ্রসারীভাবে বিবেচনা করতে হবে।

শিক্ষাব্যবস্থাকে এরকম বিভাজিত রেখে আপনি সবার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারবেন না। মাদ্রাসাকেন্দ্রিক ধর্মীয় শিক্ষা থেকে প্রতিবছর যে বিপুলসংখ্যক তরুণ-তরুণী পাশ করে আসছে তাদের আমরা কোথায় শ্রমে নিয়োজিত করছি? তাদের কোথায় কাজ দেবেন? এই বিশাল শ্রমশক্তির ভবিষ্যৎ কী হবে? ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে কেবল শিক্ষা দিলেই তো হবে না কোন শিক্ষা উৎপাদনশীল খাতে নিয়োজিত হবে এবং কোন শিক্ষা অনুৎপাদনশীল খাতে নিয়োজিত হবে সেই বিবেচনা মাথায় রেখেই আপনাকে শিক্ষাক্রম এবং শিক্ষাকাঠামো পুনর্বিন্যাস করতে হবে।

এ বিষয়ে শেষ কথাটি হলো, আমরা সবাই মনে করি যে সরকারি কর্মসংস্থানই একমাত্র গন্তব্য, বিসিএস দিয়ে প্রশাসন ক্যাডারে বা এমন কয়েকটি ক্যাডারে যাওয়ার জন্য যে আকাঙ্ক্ষা, যে আকুলতা আমরা দেখতে পাই এই মানসিকতা পাল্টাতে হবে। ধরুন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বেরুনো কোনও তরুণ-তরুণীকে আমি আজ পর্যন্ত বলতে শুনিনি যে সে সাংবাদিকতা করতে চায়, বা আমি কারোর কাছ থেকে শুনিনি যে সে শিক্ষকতায় যেতে চায়, আমি শুনিনি। কেন এমন হলো,  সবাই কেন বিসিএস-ই দিতে চায়? এই অবস্থা কেন তৈরি হলো? আমরা কি আগামী বছরগুলোতে শুধু প্রশাসকই তৈরি করব? দেশে প্রশাসক ছাড়া আর কিছুই থাকবে না? এই অবস্থা তৈরি হচ্ছে কারণ বিসিএস দিয়ে সরকারি প্রশাসনে ঢোকার পর, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার স্তর থেকেই দেখুন— সুযোগ সুবিধা অনেক বেশি, ক্ষমতা অসম্ভব; আর এই সুযোগ ও ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে অর্থবিত্ত অর্জনের সুযোগটাও অসম্ভব বেশি। সুতরাং শুরুর দিকে যে কথা বলছিলাম— অর্থ ও ক্ষমতার যে সংমিশ্রণ— অর্থ ও ক্ষমতাই যে সমাজে সাফল্যের মাপকাঠি সেখানে তো এমনটাই হওয়ার কথা, এখানেও তাই হয়েছে।

সকাল সন্ধ্যা: এটাকে প্রশ্নও বলতে পারেন, জিজ্ঞাসা বা কৌতুহলও বলতে পারেন। আপনি বলছিলেন যে যেকোনও চিন্তা বা সামাজিক আন্দোলনকে যদি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় নিয়ে যাওয়া না যায় তাহলে তার ক্ষমতায়নটা হয় না। সেদিক থেকেই জানতে চাই, আপনাকে অর্থমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দিলে কী করবেন?  

সেলিম জাহান: হা হা হা! ভালো প্রশ্ন! প্রথমত আমাকে প্রস্তাব দেওয়া হবে না বলেই মনে করি। সুতরাং বিষয়টিকে অন্য দিক থেকে বলতে পারি। আমি এর কতগুলো মাত্রিকতা দেখি। অনেকে মনে করতে পারেন যে, অর্থমন্ত্রীর কাজ বোধহয় কেবল তার যোগ্যতা, তার জ্ঞান, তার কর্মদক্ষতার ওপর নির্ভর করে। কিন্তু বাংলাদেশ তো বটেই যেকোনও দেশে, আপনি যদি কাজ করতে চান তাহলে সেটা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্য দিয়ে করতে হবে। আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে মনে করি যে, কাঠামোগত যে সংস্কার সেটা কাঠামোর ভেতর থেকেই করতে হবে। বাইরে থেকে আমরা যতই গলাবাজি করি না কেন, যতই চেঁচাই না কেন তাতে কাজ হবে না। দ্বিতীয় বিষয় হলো একজন খুবই যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী করা হলো, তিনি কি কার্যকর হবেন? হবেন না। তিনি কার্যকর হবেন না এই কারণে যে, তাঁর  একটা সমর্থনের জায়গা থাকতে হবে, সংসদে সমর্থন থাকতে হবে, সরকারে সমর্থন থাকতে হবে, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে এই সমর্থন থাকতে হবে।

আজকে যদি অর্থনীতি সম্পর্কে জ্ঞানসম্পন্ন, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও সৎ তিরিশ জন রাজনীতিক জাতীয় সংসদে থাকতেন এবং তারা প্রয়োজনীয় সমর্থন দিতেন তাহলে এমনকি একজন টেকনোক্র্যাট অর্থমন্ত্রীও অনেক কাজ করতে পারতেন। কিন্তু রাজনীতি তো সবসময় সুন্দর ও স্বাভাবিক নয়, স্বচ্ছ্বও নয়; ফলে একজন প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি অর্থমন্ত্রী হলেও এই রাজনীতি তো তাকে গিলে খাবে। আপনি সংস্কৃতির কথা বলেছেন, সাংস্কৃতিক শিক্ষার কথা বলেছেন। আজকে যদি শিক্ষা-সংস্কৃতির উন্নয়ন নিয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ পঞ্চাশ জন জনপ্রতিনিধি জাতীয় সংসদে থাকতেন তাহলে কিন্তু দেশে শিক্ষা-সংস্কৃতির এই দশা হতো না, কারণ ওই পঞ্চাশ জনের একটা কণ্ঠস্বর আমরা শুনতে পেতাম। অতএব, অর্থমন্ত্রী হওয়ার আগে কিছু পূর্বশর্ত আছে— সেই শর্তগুলো পূরণ না হলো কাঠামোগত কোনও সত্যিকারের পরিবর্তন সম্ভব হবে না।

সকাল সন্ধ্যা: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
সেলিম জাহান: আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত