অধ্যাপক মো. আনিসুর রহমান আর নেই; মুক্তিসংগ্রামী এই অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন।
ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রবিবার দুপুরে আনিসুর রহমানের মৃত্যু হয় বলে জানিয়েছেন তার ঘনিষ্ঠজন রুহিন হোসেন প্রিন্স।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক প্রিন্স ফেইসবুকে শোক জানিয়ে লিখেছেন, “আমরা শোকাহত। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনিসুর রহমান স্যার আর নেই। আজ ৫ জানুয়ারি ২০২৫, দুপুরে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। স্যারের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।”
আনিসুর রহমানের বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। তার দুই মেয়ের দুজনই যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন।
রুহিন হোসেন প্রিন্স সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য মঙ্গলবার বেলা ১১টা থেকে ১২টা পর্যন্ত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাখা হবে আনিসুর রহমানের মরদেহ।
শহীদ মিনার থেকে কফিন নেওয়া হবে সেগুনবাগিচা জামে মসজিদে। সেখানে জানাজার পর নেত্রকোনায় নিয়ে গ্রামের বাড়িতে সমাহিত করা হবে আনিসুর রহমানকে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে যাত্রা শুরুর পথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও রাষ্ট্রীয় কোনও স্বীকৃতি ছাড়াই বিদায় নিতে হলো তাকে।
অধ্যাপক আনিসুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার পর পড়িয়েছিলেনও। তিনি পিএইচডি ডিগ্রি নিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও ইসলামাবাদ ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করেন তিনি।
অধ্যাপনার পাশাপাশি রবীন্দ্র সঙ্গীতশিল্পী হিসাবেও নাম কুড়িয়েছেলেন তিনি; যুক্ত ছিলেন ছায়ানটের সঙ্গে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় হল ছাত্র সংসদের ভিপিও ছিলেন তিনি।
ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা তৈরির ভিত্তি তৈরিতে যে কয়জন অর্থনীতিবিদ ঝুঁকি নিয়ে সহায়তা করেছিলেন, তাদের একজন আনিসুর রহমান।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কোয়ার্টারে ছিলেন তিনি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তার অনেক সহকর্মীকে হত্যা করলেও তিনি লুকিয়ে থেকে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন।
পরে সহকর্মী অধ্যাপক রেহমান সোবহানকে নিয়ে কুমিল্লা হয়ে ত্রিপুরায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে ভূমিকা রাখেন আনিসুর রহমান। তারা দুজনই পরে ভারত থেকে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সংগঠনে কাজ করেন। সেই সময়ের ঘটনাবলি আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘পথে যা পেয়েছি’তে লিখে গিয়েছিলেন আনিসুর রহমান।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ফিরে দেশ গঠনে সক্রিয় হয়েছিলেন আনিসুর রহমান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনে অর্থনীতিবিদ নুরুল ইসলামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন তিন অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান, আনিসুর রহমান ও মোশাররফ হোসেন।
১৯৭৫ সালে গবেষণার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইয়ে ছিলেন আনিসুর রহমান; আগস্ট ট্রাজেডির পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তখন আর দেশে ফেরেননি তিনি।
এই সময়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করেন তিনি। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থায় (আইএলও) দীর্ঘদিন তিনি কাজ করেন।
অর্থনীতিবিদ হিসাবে ব্যতিক্রমী চরিত্রের ছিলেন আনিসুর রহমান। অংশীদারী গবেষণা এবং আত্মনির্ভর অংশীদারী উন্নয়নের দর্শন ও পদ্ধতিগত প্রশ্নে তার অবদান গুরুত্বের সঙ্গে দেখেন হালের অর্থনীতির গবেষকরা।
তার সরাসরি ছাত্র ঢাকা বিশ্বদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এম এম আকাশ লিখেছিলেন, “অধ্যাপক মো. আনিসুর রহমানকে আমরা শিক্ষক হিসাবে পাই। প্রথম দিনের ক্লাসে তিনি আমাদের বলেছিলেন, তোমাদের কোনও টেক্সট বই নেই। তোমরা মাইক্রো ইকোনমিক্স শিখবে কৃষকদের কাছ থেকে। আর যদি টেক্সট বইয়ের দরকার হয়, এই বলে আমাদের বিখ্যাত কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাম ঘরানার বিশিষ্ট ও জনপ্রিয় অর্থনীতিবিদ জোয়ান রবিনসন এবং ইটওয়েলের লেখা একটি বইয়ের নাম জানিয়ে দেন।
“স্যার একদিন বলেন, ‘ধরা যাক, একটা লোক পানিতে ডুবে যাচ্ছে। সাঁতার জানেন না। তাকে উদ্ধার করতে তুমি ঝাঁপিয়ে পড়লে। তারপর তার চুলের মুঠি ধরে তাকে ঘুষি মেরে অজ্ঞান করে ঠেলে তাকে তীরে তুললে। লোকটা বেঁচে গেল। এটাকে কি উন্নয়ন বলা যাবে? এক অর্থে উন্নয়ন, কারণ তিনি মারা যাননি। কিন্তু ওই লোকটাকে যদি জিজ্ঞেস করা হতো, আপনি কি এভাবে বাঁচতে চেয়েছিলেন? তিনি হয়ত বলবেন, ঠিক এভাবে নয়। অন্য একটা পথও তো ছিল। এটাকে এভাবে বলতে পারি, ধরা যাক, তুমি উদ্ধারের জন্য তার কাছে সাঁতরে গেলে। তাকে বললে, আমার এই হাতটা ধরেন এবং আমার সঙ্গে সঙ্গে তীরে চলেন। আমরা একসঙ্গে যাব। এটাই কিন্তু বেশি গ্রহণযোগ্য।”
১৯৭৭ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থায় যোগ দেওয়ার পর গ্রামীণ উন্নয়নে জনগণের অংশগ্রহণের ওপর একটি বিশ্বব্যাপী কর্মসূচি প্রণয়ন করেন। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এই কর্মসূচি চালানোর পর ১৯৯১ সালে তিনি দেশে ফেরেন। তখন বাংলাদেশেও সামরিক শাসনের অবসান ঘটে।
আনিসুর রহমানের প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- ‘উন্নয়ন জিজ্ঞাসা’, ‘অপহৃত বাংলাদেশ’, ‘পিপলস্ সেলফ্ ডেভেলপমেন্ট’, ‘অসীমের স্পন্দ-রবীন্দ্রসংগীত বোধ ও সাধনা’, ‘যে আগুন জ্বলেছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ’, ‘সংগস্ অব্ টাগোর, ফিলসফি, সিলেক্টেড ট্রানস্লেশনস পেইন্টিংস’, ‘পার্টিসিপেশন অব দি রুরাল পুয়োর ইন ডেভেলপমেন্ট’, ‘মাই স্টোরি অব ১৯৭১’, ‘একুশে ও স্বাধীনতা: বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং সমাজবাস্তবতা’ ইত্যাদি।
আনিসুর রহমানের জন্ম ১৯৩৩ সালে ময়মনসিংহ জেলায়; তখন তার বাবা মোহাম্মদ হাফিজুর রহমানের কর্মস্থল ছিল সেখানে। হাফিজুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন, পরে সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন।