সুপ্রিম কোর্টে বিচারকের ওপর ডিম ছোড়ার ঘটনাকে ‘নজিরবিহীন অনভিপ্রেত’ ঘটনা হিসেবে অভিহিত করেছেন প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। সুপ্রিম কোর্টসহ জেলা আদালতে সম্প্রতি ‘যেসব অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি’ সৃষ্টি হয়েছে সেসব ঘটনায় গভীর উদ্বেগও প্রকাশ করেছেন তিনি।
বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে একথা জানানো হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের জনসংযোগ কর্মকর্তা শফিকুল ইসলামের পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে যে নজিরবিহীন অনভিপ্রেত ঘটনাবলী সংঘটিত হয়েছে এবং একই সাথে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টসহ দেশের জেলা আদালতে সাম্প্রতিক সময়ে যেসব অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে- সেসব বিষয় সম্পর্কে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তিনি।”
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর গ্রেপ্তার হয়ে আদালতে যাওয়ার সময় ডিম হামলার শিকার হতে হয়েছে বিগত সরকারের মন্ত্রী-এমপি বেশ কয়েকজনকে; তবে বুধবারই প্রথম ডিম ছোড়ার ওই ঘটনা ঘটে বিচারককে লক্ষ্য করে, সুপ্রিম কোর্টে।
বুধবার দুপুরে বিরতির পর বিচারকাজ চলাকালে বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি কাজী ওয়ালিউল ইসলামের হাই কোর্ট বেঞ্চে এ ঘটনা ঘটে। হৈ হট্টগোলের মধ্যে কয়েকজন আইনজীবীর একটি দল এ ঘটনা ঘটায় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে। এই আইনজীবীরা বিএনপি সমর্থক হিসাবেই পরিচিত।
আট বছর আগে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে নিয়ে এক মন্তব্যের জেরে তারা এই কাণ্ড ঘটান বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিদের গ্রেপ্তার করে পুরান ঢাকার আদালতে নেওয়ার সময় তাদের দিকে ডিম, জুতা ছোড়ার ঘটনা বেশ কয়েকটি ঘটে।
প্রধান বিচারপতির সঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেল, সুপ্রিম কোর্ট বার সভাপতির বৈঠক
বৃহস্পতিবার দুপুরে প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের ছয় বিচারপতির সঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেল, সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি ও সিনিয়র আইনজীবীদের বৈঠক হয়।
বৈঠকের পর বারের সভাপতি এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন সাংবাদিকদের জানান, উচ্চ আদালতে বিচারককে লক্ষ্য করে ডিম ছোড়ার ঘটনার মাধ্যমে সমগ্র বিচার ব্যবস্থার ভাবমূর্তি নষ্ট করা হয়েছে বলে মনে করছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদসহ আপিল বিভাগের অন্যান্য বিচারপতি। আলোচিত ওই ঘটনার সঠিক তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশও দিয়েছেন সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতিরা।
বুধবারের ঘটনায় প্রধান বিচারপতি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জানিয়ে মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, “উনি মনে করেন, এটা শুধু একজন বিচারকের ওপর না, একটি আদালতে না, সমগ্র বিচার ব্যবস্থার ভাবমূর্তি নষ্ট করা হয়েছে। প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের সমস্ত বিচারপতি কঠোর মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। উনারাও চান সঠিক তদন্ত হোক এবং প্রকৃত দোষী-অপরাধীদের ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।”
কোনও বিচারপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে জানিয়ে সুপ্রিম কোর্ট বার সভাপতি বলেন, “প্রধান বিচারপতি বলছেন, উনারা সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল নিয়ে কাজ করছেন। কোনও বিচারপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। ব্যক্তিগতভাবে কেউ দায়িত্ব নেওয়া বা আবেগ প্রকাশ করা, এটা উনি মেনে নেবেন না।”
বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মাহবুব উদ্দিন খোকন আশা প্রকাশ করেন, যেসব বিচারপতি রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত হয়ে ‘ফরমায়েশি’ রায় দিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, “অবশ্যই অনেকের বিরুদ্ধে তালিকা আছে, যারা গত ১৫-১৬ বছর ফরমায়েশি রায় দিয়েছেন, শপথ ভঙ্গ করে যারা বিচারালয়কে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের মতো করতে চেষ্টা করেছেন। এজন্য তাদেরকে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলে দেখবেন।”
হাই কোর্টে বিচারকের বেঞ্চে ডিম ছোড়ার ঘটনা আর চট্টগ্রামে হিন্দু ধর্মীয় নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে নিয়ে সহিংসতার ঘটনার সঙ্গে ‘ধারাবাহিকতা’ রয়েছে বলে মন্তব্য করেন সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি মাহবুব উদ্দিন খোকন।
তিনি বলেন, “এটা সুপ্রিম কোর্টে আতঙ্ক সৃষ্টি করার প্রয়াস। এ ঘটনা শুধু সুপ্রিম কোর্টই না বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার ওপর হুমকি বলে আমি মনে করি।”
সুপ্রিম কোর্ট বার এ ধরনের ঘটনা বরদাশত করবে না জানিয়ে বারের সভাপতি বলেন, “সে যেই দলেরই হোক না কেন, সুপ্রিম কোর্টের ওপর যে ধরনের ঘটনা ঘটানো হয়েছে, এতে দেশের বিচার বিভাগের সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি, এ ঘটনার সঙ্গে পলাতক স্বৈরাচারীদের ইন্ধন থাকতে পারে।”
রবিবারের মধ্যে তদন্ত কমিটি
বুধবারের ঘটনায় প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করে সুপ্রিম কোর্ট বার থেকে আগামী রবিবারের মধ্যে একটি তদন্ত কমিটি করা হবে বলে জানিয়েছেন বারের সভাপতি মাহবুব উদ্দিন খোকন।
তিনি বলেন, “সেখানে সিসিটিভি ছিল, কোর্টে অন্যান্য আইনজীবী ছিলেন। তাদের বক্তব্য নিয়ে এটা কঠিনভাবে দেখা হবে। দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যেসব আইনজীবী এর সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এতে সুপ্রিম কোর্টে তাদের সদস্যপদ বাতিল হতে পারে, এমনকি বার কাউন্সিলের সদনও বাতিল হতে পারে।”
এ ঘটনায় সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন এবং অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় থেকে আলাদা তদন্ত করে জড়িতদের চিহ্নিত করা হবে বলেও জানান খোকন।
বৈঠকে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ও বারের সভাপতি মাহবুব উদ্দিন খোকন, সাবেক সভাপতি ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম সভাপতি জয়নুল আবেদীন, ফোরামের মহাসচিব ব্যারিস্টার কায়সার কামাল, বার কাউন্সিলের এনরোলমেন্ট কমিটির সদস্য রুহুল কুদ্দুস কাজল, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক বদরুদ্দোজা বাদল, দুই অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আরশাদুর রউফ ও অনীক আর হক উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের অন্যান্য বিচারপতির সঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ও মাহবুব উদ্দিন খোকনের সঙ্গে আরেকটি বৈঠক হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী একাধিক বিচারপ্রার্থী ও আইনজীবীরা জানান, বুধবার দুপুরের পরে ওই এজলাসে বিচারকাজ চলছিল। এসময় একদল আইনজীবী এজলাস কক্ষে ঢোকে। তাদের একজন আদালতের ডায়াসের সামনে (বিচারকের মুখোমুখি) গিয়ে বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালকে উদ্দেশ করে বলেন, “আপনি একজন বিচারপতি হয়ে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেছেন। আপনি এখনও যদি ওই চিন্তাভাবনা পোষণ করেন, তাহলে আপনার বিচারকাজ পরিচালনার অধিকার নাই।”
এসময় আরেকজন আইনজীবী বিচারপতি আশরাফুল কামালকে এজলাস থেকে নেমে যেতে বলেন। তখন পেছন থেকে একজন ডিম ছুড়ে মারে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়; তবে তা বিচারপতির গায়ে লাগেনি। বিচারকের আসনের সামনে থাকা ডেস্কে লাগে। এরপর হট্টগোল শুরু হলে দুই বিচারকই এজলাস ছেড়ে চলে যান।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব সংসদে পাস হয়, যা ষোড়শ সংশোধনী হিসেবে পরিচিত। পরে সুপ্রিম কোর্টের ৯ জন আইনজীবীর রিট আবেদনে হাই কোর্ট ২০১৬ সালের ৫ মে এ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করেন।
বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্টের বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়।
ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে একমত ছিলেন বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক। অন্যদিকে বিচারপতি আশরাফুল কামাল ভিন্নমত পোষণ করে রিট আবেদনটি খারিজের পক্ষে মত দিয়েছিলেন।
সেই রায়ের বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল তার পর্যবেক্ষণে বলেছিলেন, “মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বাক বাকুম করে ক্ষমতা নিয়ে নিলেন তথা রাষ্ট্রপতির পদ দখল করলেন। একবারও ভাবলেন না, তিনি একজন সরকারি কর্মচারী। সরকারি কর্মচারী হয়ে কীভাবে তিনি আর্মি রুলস ভঙ্গ করেন? ভাবলেন না তার শপথের কথা। ভাবলেন না তিনি দেশকে রক্ষা করতে প্রয়োজনে মৃত্যুকে বরণ করার শপথ নিয়েছিলেন। ভাবলেন না, তিনি এবং তারা ব্যর্থ হয়েছিলেন দেশের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে রক্ষা করতে। ভাবলেন না, তিনি এবং তারা ব্যর্থ হয়েছেন জাতীয় চার নেতাকে রক্ষা করতে।”
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর খন্দকার মোশতাক আহমেদ ক্ষমতাসীন হয়ে মেজর জেনারেল জিয়াকে সেনাপ্রধান করেছিলেন। তারপর নভেম্বরের অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের মধ্যে ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন জিয়া। পরে তিনি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে বিএনপি গঠন করে রাজনীতিতে নামেন।
ওই রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারপতি কামাল আরও বলেছিলেন, “জনগণ আশ্চর্য হয়ে দেখল, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান দেশের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যাকারী এবং জাতীয় চার নেতার হত্যাকারীদের দোসর হয়ে তাদের রক্তাক্ত হাতের সাথে হাত মিলিয়ে সম্পূর্ণ বেআইনি এবং অসাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতির পদ দখল করল। যাকে এক কথায় বলা যায় বন্দুক ঠেকিয়ে জনগণের প্রতিষ্ঠান দখল।”
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে এবার বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকদের অনেকেই আন্দোলনকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রোষের মুখে পড়ে। ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ হিসাবে চিহ্নিত করে তাদের পদত্যাগের দাবি তোলে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।
চাপের মুখে প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের প্রায় সব বিচারককে পদত্যাগ করতে হয়। এরপর সর্বোচ্চ আদালতের নেতৃত্ব পুরোপুরি বদলে যায়।