উপমহাদেশের চলচ্চিত্রে শ্যাম বেনেগাল এক গুরুত্বপূর্ণ নাম। ভারতীয় সিনেমার বিকল্প ধারা বা প্যারালাল সিনেমার অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে ধরা হয় তাকে। তার চলচ্চিত্রগুলো মূলধারার বাণিজ্যিক সিনেমার বাইরে গিয়ে সমাজের বাস্তবতা, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং মানবিক সম্পর্কগুলো গভীরভাবে অন্বেষণ করে। তিনি তার কাজের মাধ্যমে ভারতীয় সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি ও স্তরের জীবনযাত্রার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন।
তার চলচ্চিত্রগুলোতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা, নারীর সংগ্রাম, আর্থ-সামাজিক বৈষম্য এবং মানবিক সম্পর্ক নিয়ে কাজ করা হয়েছে। তার নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘অঙ্কুর’ (১৯৭৪) গ্রামীণ ভারতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরে।
তার চলচ্চিত্রগুলো ভারতের প্যারালাল সিনেমা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নির্মাণ করেছেন অনেক তরুণ নির্মাতা। তার হাত ধরে বড়পর্দায় নজর কেড়েছেন শাবানা আজমি, স্মিতা পাটিল, এবং নাসিরুদ্দিন শাহসহ অনেকেই।
খুব বেশি চলচ্চিত্র যে তিনি নির্মাণ করেছেন তেমনটি নয়, তবে তার চলচ্চিত্র প্রশংসিত হয়েছে বিশ্বময়। বহু জাতীয় পুরস্কার ও আন্তর্জাতিক সম্মাননা অর্জন করেছেন। তার চলচ্চিত্রগুলো কান, বার্লিন, এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেও প্রদর্শিত হয়েছে। তার নির্মিত বারোটি চলচ্চিত্রের মধ্যে দু’টি বায়োপিক। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক চিরস্মরণীয় কিংবদন্তি নেতা সুভাষচন্দ্র বসুকে নিয়ে, অন্যটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে।
২০০৫ সালে সুভাষ বসুকে নিয়ে নির্মিত নেতাজি ‘সুভাষ চন্দ্র বোস: দ্য ফরগোটেন হিরো’ সিনেমাটি হতে পারতো তার জীবনের শেষ কাজ। কিন্তু শুধু ভারতবর্ষ নয়, তার পাশে স্বাধীন হওয়া আরেকটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতার গল্পও হয়তো তিনি বলার দায় অনুভব করেছিলেন। তাই বাংলাদেশ ভারতের যৌথ উদ্যোগে নির্মিত ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণের প্রস্তাবের আহ্বানে ৮৬বছর বয়সেও সাড়া দিয়েছিলেন।
তবে জীবনের শেষ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করতে গিয়ে অনেক সমালোচনা গ্রহণ করতে হয়েছে তাকে। আগের সিনেমাগুলোর তুলনায় মান ও কারিগরি দিক থেকে নিজের নামের প্রতি ততটা সুবিচার করতে পারেননি শ্যাম বেনেগাল।
সোমবার শ্যাম বেনেগাল এর মৃত্যুর পর সকাল সন্ধ্যাকে বরেণ্য এ নির্মাতার নির্মাণ প্রসঙ্গে বলেছেন চলচ্চিত্র সমালোচক বিধান রিবেরু। তিনি বলেন, “শ্যাম বেনেগাল ভারতীয় প্যারালাল সিনেমার এক গুরুত্বপূর্ণ নির্মাতা, নিঃসন্দেহে। তার শুরুর দিককার যেসব চলচ্চিত্র তাতে নিজস্ব সমাজচিন্তার ভাবনা আমরা দেখেছি। কিন্তু প্রয়ানের আগে আমরা জানি শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে তিনি একটি বায়োপিক নির্মাণ করেছিলেন। ২০২৩ সালে মুক্তি পাওয়া ছবিটি আসলে বেনেগালের ছবি বলে মনে হয়নি। ছবিটি আরো ভালো করা যেত বলে আমার মত।”
একই কথা শোনা গেছে ভারতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমেও। ফিল্ম কম্পেনিয়নে চলচ্চিত্র ‘মুজিব’ নিয়ে সমালোচনা করে রাহুল দেশাই লিখেছিলেন, “চলচ্চিত্র সমালোচক হিসেবে এত বড় একজন নির্মাতার এমন সিনেমা দেখাটা হতাশাজনক। ছবির কসপ্লে-লেভেল পারফর্মেন্স, ভিজুয়েল ইফেক্টস, বাজে পরচুলা, উইকিপিডিয়ার-লাইটের মতো কাঠামো, প্রেস-রিলিজের মতো গল্প বলার ধরন, বর্ণনার ধারাবাহিকতার অভাব, ফিল্ম মেকিং-এর বেসিক বিষয়গুলোতে সমস্যা আছে।”
পশ্চিমবঙ্গের শীর্ষ দৈনিক আনন্দ বাজারও ‘মুজিব’-কে সিনেমা হিসেবে ১০ এর মধ্যে ৫ নম্বর দিয়ে লিখেছিল, ‘মুজিবকে জানতে বরং বাংলা সাহিত্যকে জানুন’। গৌতম চক্রবর্তীর লেখা ‘মুজিব’ এর ফিল্ম সমালোচনায় যা বলা হয়েছে তার মোদ্দা কথা হলো, মুজিব এর দৃঢ়তা, তেজস্বীতা বাংলা সাহিত্যির বিভিন্ন লেখাপত্রে যতো দুর্দান্তভাবে পাওয়া যায়, তা শ্যাম বেনেগালের এই সিনেমায় ততোটা নয়।
সেই ধারাবাহিকতায় গান্ধী, আয়রন লেডি, ওপেনহেইমার এবং আ বিউটিফুল মাইন্ড-এর মতো বিশ্বখ্যাত বায়োপিকগুলোর তুলনা দেয়া হয়েছে। গৌতম তার লেখায় বলছেন, এসব বায়োপিকের তুলনায় ‘মুজিব’ খুব পানসে! আর সে কারণে প্রকৃত মুজিবকে জানতে এই লেখক তার পাঠকদের সাহিত্যের দিকেই মনোনিবেশ করার পরামর্শ দিয়েছেন।
চলচ্চিত্রটির ট্রেলার প্রকাশের পরও সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। তবে, শ্যাম বেনেগাল এর উত্তরে চলচ্চিত্রটি দেখার আহ্বান জানিয়েছিলেন। চলচ্চিত্রটি দেখার পর যদিও দর্শকের সমালোচনার মাত্রা কিছুটা কমে এসেছিল। তবে, আইনি প্রতিবাদের মুখোমুখি হতে হয়েছিল চলচ্চিত্রটিকে। আইনি নোটিসে অভিযোগ করা হয়েছিল- চলচ্চিত্রটিতে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার চরিত্র বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
সিনেমায় বঙ্গবন্ধু চরিত্রে অভিনয় করেন আরিফিন শুভ, তার সহধর্মিনী ফজিলাতুন নেছা মুজিবের চরিত্রে অভিনয় করেন নুসরাত ইমরোজ তিশা এবং দিলারা জামান। এ সিনেমার অন্য অভিনেতার হলেন- রাইসুল ইসলাম আসাদ, চঞ্চল চৌধুরী, খায়রুল আলম সবুজ, ফজলুর রহমান বাবু, শহীদুল আলম সাচ্চু, গাজী রাকায়েত, সংগীতা চৌধুরী, প্রার্থনা দীঘি, রিয়াজ আহমেদ, সাব্বির আহমেদ, জায়েদ খান, সায়েম সামাদ, মোস্তাফিজুর রহমান প্রমুখ।
জুলাই গণভ্যুত্থান পরবর্তী রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে নির্মাতা শ্যাম বেনেগালকে নিয়ে দেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনের কাউকেই তেমন শোক প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। নীরব ছিলেন চলচ্চিত্রটির অভিনয়শিল্পীরাও।
কেবল শেখ মুজিবুর রহমানের চরিত্রে অভিনয় করা আরিফিন শুভকে ফেইসবুকে তার একটি ছবি শেয়ার করে স্ট্যাটাস দিতে দেখা গেছে। তিনি লিখেছেন- ‘ওপারে ভালো থাকবেন স্যার…’।
স্মরণ করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা ও নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। তার নির্মিত ‘টেলিভিশন’ চলচ্চিত্রটি অ্যাপসা অ্যাওয়ার্ডে পুরস্কৃত হয়। সে উৎসবে অন্যতম জুরি হিসেবে ছিলেন শ্যাম বেনেগাল। সেই সূত্রেই প্রয়াত এ চলচ্চিত্রকারকে স্মরণ করেন ফারুকী।
দীর্ঘজীবনে চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য সর্বোচ্চ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন শ্যাম। জীবদ্দশায় পেয়েছেন ভারতের সর্বোচ্চ সম্মান পদ্মশ্রী পুরস্কার। তবে, শেষ সিনেমার জন্য সমালোচনার বাইরে উল্লেখযোগ্য কোনও পুরস্কার জোটেনি তার।