২০২২ সালে কাতার বিশ্বকাপের সময় তার বয়স ছিল ১৬ বছর। ওই বয়সেই তাকে কাতার নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন রোনালদো। মানে ব্রাজিলের দ্য ফেনোমেনন। ওদিকে বার্সেলোনা কোচ জাভি খুব করে দলে চেয়েছিলেন এই কিশোরকে। ধরতে গেলে, এখনও বাগানের কুঁড়ি, ফুল হয়ে প্রস্ফুটিত হয়নি। এরপরও এই কিশোরকে ঘিরে কেন এত উন্মাদনা, সেটি হয়তো বুঝতে বাকি নেই ওয়েম্বলির ম্যাচের পর।
যাকে নিয়ে এত আলোচনা, তিনি ব্রাজিলের নতুন সেনসেশন এনদ্রিক। বয়স তার একটু বেড়েছে। এখন চলছে ১৭। তাতে পারফরম্যান্সের ধারও বেড়েছে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ শেষে যাকে বর্ণনা করা যায় এভাবে- গোলে শট নিতে তিনি অপেক্ষায় থাকতে রাজি নন। ক্যালেন্ডার-বয়স কিংবা কৈশোর পেরোতে হবে, এমন ধারা তিনি মানেন না। ভবিষ্যতের ফুটবলে রাজ করার ঘোষণা ওয়েম্বলিতেই দিয়ে রেখেছেন রোনালদো-নেইমারের উত্তরসূরি।
ইউরোপে এনদ্রিকের ঘোষণা
৭১ মিনিটে রোদ্রিগোর বদলি হয়ে নামার আগে টাচলাইনে যখন জার্সি ও বুট পরে নামার অপেক্ষায় এনদ্রিক, খানিক সময়ের জন্য মনে হলো কোনও স্কুলপড়ুয়া কেউ বুঝি স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে! শারীরিক গড়ন ছোটখাটো, উচ্চতা ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি। কিন্তু মাঠে নামার পর পায়ের জাদুতে যে দ্যুতি ছড়ালেন, হার মানল ইংল্যান্ডের অভিজ্ঞ রক্ষণভাগ।
প্রতিভার জানান তিনি দিয়েছিলেন মাত্র ১৫ বছর বয়সে। লাতিন আমেরিকার মর্যাদাপূর্ণ প্রতিযোগিতা অনূর্ধ্ব-২০ চ্যাম্পিয়নশিপ দিয়ে নজরে পড়ে যায় ফুটবল দুনিয়ার। ধরা পড়েন ইউরোপিয়ান জায়ান্টদের রাডারেও। অবশ্য সিনিয়র পর্যায়ের ফুটবল শুরু তার জন্মস্থান ব্রাজিলেই। ১৬তম জন্মদিনের দুই মাস পর তার পেশাদারি ফুটবল শুরু পালমেইরাস দিয়ে। বছর শেষে তার গলায় ওঠে চ্যাম্পিয়নশিপের মেডেল। সঙ্গে আরেকটি অর্জন যোগ হয়- রেকর্ড ট্রান্সফারে নাম লেখান স্প্যানিশ জায়ান্ট রিয়াল মাদ্রিদে।
ওয়েম্বলির ম্যাচটি তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের প্রথম নয়। গত বছরের নভেম্বরে কলম্বিয়ার বিপক্ষে বিশ্বকাপ বাছাই ম্যাচে ডাগ আউট থেকে উঠে শুরু করেন ব্রাজিল-অধ্যায়। পাঁচ দিন পর আর্জেন্টিনার বিপক্ষেও বদলি হয়ে মাঠে নামেন তিনি। তবে ইউরোপের মাটিতে ইউরোপিয়ান পরাশক্তি ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মাঠে নামা ছিল ‘বিশেষ কিছু’। সেই উপলক্ষ গোলে রাঙিয়ে জানান দিলেন, ইউরোপিয়ান ফুটবলে দাপট দেখাতেই আসছেন তিনি।
স্ট্রাইকার সমস্যার সমাধান
ওয়েম্বলিতে তার গোলটি হয়তো দর্শনীয় কিছু নয়। ভিনিসিয়ুস জুনিয়রের শট ইংলিশ গোলকিপার জর্ডান পিকফোর্ডের গায়ে লেগে প্রতিহত হলে ফাঁকা জালে বল জড়িয়ে দেন এনদ্রিক। তবে এই গোলে ফুটে উঠেছে তার আকাঙ্ক্ষা, প্রতিভার বিচ্ছুরণ ও ভুল না করার মানসিকতা। যাতে দেখা গেল ফুটবল বিশ্বের নতুন একটি ইতিহাসের পূর্বরূপ।
ফুটবল দুনিয়ার জন্য যাই হোক, ব্রাজিলের জন্য অবশ্যই। অনেকদিন হলো ব্রাজিলের সত্যিকার অর্থে কোনও বিশ্বমানের স্ট্রাইকার নেই। রিচার্লিসন এখন এই পজিশনে দারুণ কিছু গোল পেয়েছেন। তবে তিনি স্বভাবগত উইঙ্গার। গাব্রিয়েল জেসুসের ক্ষেত্রেও একই সত্য। আর্সেনাল ফরোয়ার্ড তার জাতীয় দলের ক্যারিয়ারে ভালো সময় কাটিয়েছেন রাইট উইংয়ে খেলে। ওয়েম্বলির ম্যাচ শেষে এনদ্রিকের আলোকিত পারফরম্যান্স স্ট্রাইকিংয়ে নতুন আশা জাগাচ্ছে সেলেসাওদের।
ব্রাজিলের নতুন আশা
অল্প বয়সে প্রতিভার জানান দেওয়া খেলোয়াড়ের সংখ্যা কম নয় ব্রাজিলে। ঝরে পড়ার সংখ্যাও নেহাত কম নয়। এখানে উদাহরণ হিসেবে আসবে জ্যঁ চেরা কিংবা লুনিনহার নাম। বয়সভিত্তিক ফুটবলে হইহই ফেলে দিয়েও সিনিয়র পর্যায়ে ডুবেছেন ব্যর্থতার অতলে। সেই জায়গায় ১৭ বছর বয়সী এনদ্রিক এখনই তাদের চেয়ে এগিয়ে। পালমেইরাসের জার্সিতে কাঁপিয়ে এবার জাতীয় দলেও দিয়েছেন আগামনী বার্তা।
তাই বলে এনদ্রিক-ম্যানিয়ায় ডুবে যাওয়াটাও হবে ভুল বার্তা। তার বয়সে নেইমার যেভাবে আলোড়ন তুলেছিলেন, এনদ্রিক সেই ধাঁচের নন। ইউটিউব হাইলাইটে হইচই ফেলে দেওয়ার মতোও কিছু করেননি। তবে ভবিষ্যতের আলোকে পরিপূর্ণ ফুটবলার হওয়ার প্রতিশ্রুতি আছে তার পা ও মাথায়।
রিয়াল মাদ্রিদ সেটি ধরতে পেরেছে। সেকারণে ৭০ মিলিয়ন ইউরোতে ঘরে তুলেছে তাকে। কাকার রেকর্ড ভেঙে রিয়ালের সবচেয়ে দামি ব্রাজিলিয়ান এখন তিনি। ১৮ বছর পূর্ণ হলে সামনের জুনে যোগ সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে যোগ দেবেন ব্রাজিলের তাগুয়াতিঙ্গায় জন্ম নেওয়া এনদ্রিক।
রোনালদো তার আদর্শ
৫ ফুট ৮ ইঞ্চি উচ্চতা হলেও এই বাঁ পায়ের খেলোয়াড় দক্ষতা ও শারীরিক শক্তিতে প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদের হার মানাচ্ছেন। যে কারণে তার মাঝে ফেনোমেনন রোনালদোর ছায়া দেখছেন অনেকে। কেউ কেউ ব্রাজিলের ‘নতুন রোনালদো’ নামেও ডাকছেন তাকে। যদিও স্বদেশি রোনালদো তাকে টানে না, তার ধ্যানজ্ঞানে আরেক রোনালদো, পর্তুগালের ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো। এক সাক্ষাৎকারে ব্রাজিলিয়ান তরুণ বলেছিলেন, “ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো বিস্ময়কর। আমি তার পথে হাঁটতে চাই।”
কেন পর্তুগিজ যুবরাজ তার আদর্শ, সেটির কারণ রোনালদোর জয়ের ক্ষুধা ও ফিটনেস, “পারফরম্যান্সে উন্নতি করে যাব। একই সঙ্গে সবসময় নজর থাকবে যেন ইনজুরিতে না পড়ি। এই জায়গায় আমি অবশ্যই ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোকে সামনে আনব। তার কী ফিটনেস।”
সবশেষে
পেশাদার ক্যারিয়ারের শুরুতেই ফিটনেস নিয়ে কতটা সতর্ক এনদ্রিক। হারিয়ে যেতে যে তিনি আসেননি। ফুটবল শৈলীতে ইতিহাসের অংশ হওয়ার স্বপ্ন তার। যিনি বসতে চান সাফল্যের সর্বোচ্চ শৃঙ্গে। ব্রাজিল এমন এক হীরের সন্ধানেই তো ছিল বহুদিন।