“এবার ইংল্যান্ড শিরোপা না জিতলে সত্যি আমি অবাক হব।”- কাতার বিশ্বকাপের আগে কথাটা বলেছিলেন গ্যারি লিনেকার। শুধু এই সাবেক ইংলিশ স্ট্রাইকার নন, আরও অনেকেই ২০২২ বিশ্বকাপে ফেভারিট মেনেছিলেন ইংল্যান্ডকে। তবে ঘটেছে ভিন্ন। শিরোপা দূরে থাক, কোয়ার্টার ফাইনালের চৌকাঠ পর্যন্ত পেরোতে পারেনি ইংলিশরা।
হতাশা ঝেরে এখন ২০২৪ ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপে চোখ রেখেছে থ্রি লায়ন্স। আবারও ফেভারিট তালিকায় ওপরের দিকে তাদের অবস্থান। কিন্তু এবারও আছে আশঙ্কার চোখরাঙানি। দলীয় পারফরম্যান্স নিয়ে নয়, দুশ্চিন্তা ঘনীভূত হচ্ছে কোচের ‘দুর্বলচিত্ত’ সিদ্ধান্ত ঘিরে!
প্রিমিয়ার লিগ বিশ্বের সবচেয়ে জমজমাট ঘরোয়া প্রতিযোগিতা। প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাপকাঠিতে সব লিগকে ছাড়িয়ে। শক্তিশালী ঘরোয়া ফুটবলেরও বড় ভূমিকা রেখেছে ইংল্যান্ডকে শিরোপার দাবিদার করে তুলতে। অভিজ্ঞতার সঙ্গে তারুণ্যের মিশেলে বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর স্কোয়াড তাদের। লিগে এই ফুটবলাররাই দুর্দান্ত খেলছেন, নিজেদের পজিশনে অনেকে সেরা। অথচ ইংল্যান্ডের জার্সি পরলেই তারা হয়ে যাচ্ছেন সাদামাটা। এ-এক অদ্ভুত ব্যাপার।
শেষ দুটি প্রীতি ম্যাচের দিকে তাকালেও দেখা যাচ্ছে, ক্লাব ফুটবলের ইংলিশ তারকারা ‘ফেল’ মেরেছেন জাতীয় দলে। ওয়েম্বলিতে আনকোড়া ব্রাজিলের কাছে হারার পর ইংল্যান্ড কোনও রকমে হার এড়িয়েছে বেলজিয়ামের বিপক্ষে। সমস্যা কি তাহলে জাতীয় দলের দুর্বল কোচিং মস্তিষ্ক?
সমস্যা কোথায়?
দারুণ সব খেলোয়াড় নিয়ে সাজানো ইংল্যান্ডের স্কোয়াড। ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সে অনেকেই ব্যবধান গড়ে দেওয়ার সামর্থ্য রাখেন। তবে দল হিসেবে তাদের পারফরম্যান্সে ধারাবাহিকতার অভাব। আর এখানেই কাঠগড়ায় তুলতে হচ্ছে কোচ গ্যারেথ সাউথগেটকে। তার অধীনে ২০২০ ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপ, যেটি করোনাভাইরাসের কারণে আয়োজিত হয়েছে এক বছর পর, সেই টুর্নামেন্টে ফাইনাল খেলেছিল ইংল্যান্ড। বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নও উজ্জ্বল হয়ে ধরা দিয়েছিল। এরপরও সাউথগেটের খেলোয়াড় ব্যবহারের দুর্বল মস্তিষ্ক বিপাকে ফেলছে থ্রি লায়ন্সকে।
শনিবার (২৩ মার্চ) ওয়েম্বলিতে ২১ ম্যাচ পর হেরেছে ইংল্যান্ড। ব্রাজিলের বিপক্ষে ১-০ গোলের হারের ম্যাচে মূল একাদশের অনেকেই ছিলেন না। সে তো ব্রাজিলেরও ছিল না। বরং সেলেসাওদের অবস্থা বেশি খারাপ ছিল। নতুন কোচ দোরিভাল জুনিয়রের প্রথম পরীক্ষায় অভিষেক হয়েছে পাঁচ খেলোয়াড়ের। এর ওপর লাতিন আমেরিকার দলটি এসেছিল বিশ্বকাপ বাছাইয়ের টানা তিন হারের ধাক্কা নিয়ে। অথচ ওয়েম্বলিতে নতুন কোচের অধীনে নতুন দিনের গান শুনিয়ে গেছে ব্রাজিল।
ওই ওয়েম্বলিতে চার দিন পর আবারও হতাশা নিয়ে মাঠ ছেড়েছে ইংল্যান্ড। এবার হারতে হয়নি, তবে বেলজিয়ামের বিপক্ষে শেষ মুহূর্তের গোলে সমতায় ফেরার দৃশ্য ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপের আগে দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছে। এজন্য কি কোচ সাউথগেটের অতিরক্ষণাত্মক সিদ্ধান্তই দায়ী? ম্যাচের পরিস্থিতি বুঝে কখনও কখনও সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে হয়, বিশ্ব ফুটবলে বড় বড় সব কোচই যেটি নিয়ে থাকেন। এই জায়গায় সাউথগেট ‘ঝুঁকিহীন’ ফুটবলে গতানুগতিক ধারায় চলতে বেশি পছন্দ করছেন।
বড় দল হলেই ব্যাকফুটে ইংল্যান্ড
নিঃসন্দেহে মার্চের ফিফা উইন্ডোতে শক্তিশালী দুই প্রতিপক্ষকে সামলাতে হয়েছে ইংলিশদের। ব্রাজিল ও বেলজিয়াম দুই দলই আছে ফিফা র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষ দশে। ইংল্যান্ড তিন নম্বরে; চারে বেলজিয়াম, পাঁচে ব্রাজিল। শীর্ষ দশে থাকা অন্য দলগুলো হলো- আর্জেন্টিনা, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, পর্তুগাল, স্পেন, ইতালি ও ক্রোয়েশিয়া।
শীর্ষে দশে নেই জার্মানি। তাদের অবস্থান ১৬ নম্বরে। এরপরও সাফল্যের মাপকাঠিতে তাদের শীর্ষ দলের তালিকায় রাখতে হবে। তাহলে এই যে শীর্ষ দলগুলোর কথা বলা হচ্ছে, এদের বিপক্ষে ইংল্যান্ডের পারফরম্যান্স আমলে নিলেই সাউথগেটের সাফল্যের হিসাব-নিকাশ করা সহজ হয়ে যায়।
ইংলিশ কোচ এখনও আর্জেন্টিনা ও পর্তুগালের বিপক্ষে ডাগ আউটে দাঁড়াননি। তবে বাকি আট দলের বিপক্ষে খেলা ২৭ ম্যাচে জয় তার মাত্র ৬টি! হেরেছে ১২টি, আর ড্র ৯টিতে। বড় দলগুলোর বিপক্ষে সাউথগেটের আমলনামা মোটেও তার ৬২.৬ শতাংশ সাফল্যের সঙ্গে যায় না। ইংল্যান্ডের ফুটবল ইতিহাসের দ্বিতীয় সফল কোচের জায়গাটাও অনুজ্জ্বল মনে হয় তাতে।
তুলনামূলক কম শক্তিশালী দলের বিপক্ষে সাউথগেটের ইংল্যান্ড দাপট দেখিয়েছে। বড় প্রতিযোগিতার বাছাই পর্ব পেরোতেও তাই বেগ পেতে হয় না। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে, যেখানে ট্যাকটিকাল ও ম্যান-ম্যানেজমেন্টের ব্যাপার চলে আসে, তখনই ভেঙে পড়েন তিনি।
গেম প্লানিংয়ে দুর্বলতা
ব্রাজিলের ম্যাচের কথাই ধরা যাক। হতাশার সন্ধ্যা কাটিয়ে ৬৭ মিনিটে মাঠ ছাড়েন জুড বেলিংহাম। রিয়াল মাদ্রিদের বেলিংহামের ছিঁটেফোটাও পাওয়া যায়নি। তবে তার মানের খেলোয়াড় যেকোনও পরিস্থতিতে যে ম্যাচের চিত্র পাল্টে দিতে পারেন, সেটির প্রমাণ পরের ম্যাচেই তিনি দিয়েছেন বেলজিয়ামের বিপক্ষে ইনজুরি টাইমে গোল করে।
এরপরও ধরে নেওয়া হলো, পারফরম্যান্সের মাপকাঠিতে সেরা জায়গায় ছিলেন না বলেই বেলিংহামকে তুলে নিয়েছিলেন সাউথগেট। কিন্তু হ্যারি ম্যাগুয়ের ও বেন চিলওয়েলের বদলির বেলাতে তিনি সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। যদিও লাইক-ফর-লাইক বদলি নামিয়ে হাঁটলেন সতর্কতার সঙ্গে। অথচ ম্যাচের ওই পরিস্থিতিতে তার হাতে ছিলেন জেমস ম্যাডিসন, মার্কাস রাশফোর্ড ও ইভান টনির মতো খেলোয়াড়, যারা প্রতিপক্ষের রক্ষণ ভেঙে কাঙ্ক্ষিত গোল এনে দিতে পারেন।
সাউথগেটের গতানুগতিক ধারার ট্যাকটিকসের উদাহরণ আছে আরও। ২০১৮ বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে সেমিফাইনাল, ইতালির বিপক্ষে ২০২০ ইউরোর ফাইনাল ও ফ্রান্সের বিপক্ষে ২০২২ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল- কোনও ম্যাচেই তিনি ৭০ মিনিট পর্যন্ত খেলোয়াড় বদল করেননি। যখন কিনা প্রতিপক্ষ ম্যাচের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিজেদের কাছে নিয়ে নিয়েছে।
গত বিশ্বকাপে ফ্রান্সের বিপক্ষে ২-১ গোলের হারে ম্যাচে রাশফোর্ডকে তিনি মাঠে নামিয়েছিলেন ৮৫তম মিনিটে। জ্যাক গ্রিলিশ খেলেছিলেন মাত্র তিন মিনিট। বড় টুর্নামেন্ট, বিশেষ করে শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচে কোচকে বড় সিদ্ধান্ত নিতে দেখা যায়। তার কোনও বদলিতে ম্যাচের চরিত্র বদলে গেছে, এমন নজির খুব নেই। এসবেই কোচের ট্যাকটিক্যাল দক্ষতার প্রমাণ মেলে। এই জায়গায় সাউথগেট অতিমাত্রায় রক্ষণশীল।
বেলিংহাম থাকার পরও মাঝমাঠে সমস্যা
রিয়াল মাদ্রিদ তো বটেই, বিশ্ব ফুটবলের অন্যতম সেরা মিডফিল্ডার বেলিংহাম। গোল করাতে ও করতে- দুটোতেই পারদর্শী তিনি। এমন ‘সোনার ছেলে’ দলে পেয়েও ঠিকঠাক কাজে লাগাতে পারছেন না সাউথগেট। রিয়ালে কোচ কার্লো আনচেলত্তি যেমন বেলিংহামকে মাঠে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন, সাউথগেটও একই পদ্ধতিতে ব্যবহারের চেষ্টা করছেন।
রিয়ালের সঙ্গে মেলাতে গিয়ে বরং ক্ষতিই করছেন ইংলিশ কোচ! কারণ রিয়াল স্বাধীনতা দিয়ে বেলিংহামের কাছ থেকে সেরাটা বের করে মাঝমাঠ ও আক্রমণভাগে সেতুবন্ধন তৈরি করছে। দুই উইংকে করেছে আরও ক্ষুরধার। কিন্তু সাউথগেট বেলিংহামে নির্ভরতা বাড়াতে গিয়ে অকার্যকর করে দিয়েছেন ফিল ফডেনকে। স্বভাবগত ফুটবলের বাইরে গিয়ে ফডেনকে খেলতে হচ্ছে বেলিংহামের আশেপাশে। এই ম্যানসিটি তারকা ব্রাজিল ম্যাচে পেনাল্টি এরিয়ায় একবারও বলে পা ছোঁয়াননি!
অথচ ইংল্যান্ডের মাঝমাঠে ফডেনের উপস্থিতির প্রয়োজনই নেই। কারণ বেলিংহামের সঙ্গে মাঝমাঠে রয়েছেন আরেকজন পরীক্ষিত মিডফিল্ডার ডেকলান রাইস। এরপরও ওয়াইড মিডফিল্ড বা উইংয়ে অভ্যস্ত ফোডেনকে শেষ দুই ম্যাচে খেলিয়েছেন বেলিংহামের পেছনে। তাই ম্যানসিটির ম্যাজিক হারিয়ে ফেলেছিলেন এই ইংলিশ তারকা।
সবশেষে
ব্রাজিল ও বেলজিয়ামের ম্যাচের ফল কিংবা পারফরম্যান্সে অবশ্যই অস্বস্তি আছে ইংল্যান্ডের। কারণ ইউরোর আগে প্রস্তুতির সবচেয়ে বড় মঞ্চ ছিল এই ম্যাচ দুটি। তবে ট্যাকটিক্যালি অনেক পরিবর্তনই হয়তো আসবে মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের মঞ্চে। চোট সমস্যা না থাকলে জার্মানির প্রতিযোগিতায় তখন দলের গুরুত্বপূর্ণ সব তারকাকে পাবেন সাউথগেট।
তারকা সমারোহ হয়তো হবে। কিন্তু সাফল্যের জন্য তারকার ব্যবহারও জানতে হয়। সেটা যথার্থ না হলে সাউথগেটের ইংল্যান্ডকে ব্যর্থতার সরণিতেই হাঁটতে হবে।