Beta
শনিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
Beta
শনিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

ভাষার রাঘববোয়াল ইংরেজি

বিল গেটস-এর ‘এক পৃথিবী এক অভিধান’ সত্যিই কি কেবল এক প্রজন্ম দূরে?

ঈশ্বর ওদের সহায় হোক, একমাত্র ফরাসিরাই জোঁকের মতো তাদের ভাষা ফ্রেঞ্চ নিয়ে পড়ে আছে। মাইক্রোসফট যেদিন ‘এনকর্টা ওয়ার্ল্ড ডিকশনারি’ প্রকাশ করল, সেদিনকার উদ্বোধনী ভাষণে খুব গর্ব করে বিল গেটস বললেন, ‘‘এক পৃথিবী এক অভিধান।’’ এর পর থেকে ফরাসি জোঁকের কামড়টাও ঢিলেঢালা হয়ে পড়েছে।

সাম্রাজ্যের হাতিয়ার ভাষা

৩ আগস্ট ১৪৯২।  ইতালিয়ান অভিযাত্রী ক্রিস্টোফার কলম্বাস তিনটি জাহাজ— সান্তা মারিয়া, পিন্টা এবং নিনা নিয়ে স্পেন থেকে পাল তুললেন নৌকায়। তিনি নতুন পৃথিবীর সন্ধানে বের হয়েছিলেন। জ্ঞাতসারেই হোক কি অজ্ঞাতসারে কলম্বাসকে নিভৃতে নিঃশব্দে অনুসরণ করল সাম্রাজ্যবাদ। সেই সাম্রাজ্যবাদই নতুন করে নাম নিল গ্লোবালাইজেশন, প্রমিত ভাষায় ভুবনায়ন। এটাই সুগম করে দিল ভাষা সাম্রাজ্যবাদের পথ।

তখন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার তৈরিতে মগ্ন স্পেনদেশীয় ভাষাবিজ্ঞানী আন্তোনিও দ্য নেব্রিয়া (১৪৪১-১৫২২)। তিনি এ কাজে স্প্যানিশ ভাষার অন্তরাত্মা আবিষ্কার করা জরুরি মনে করলেন। ভাষার অন্তরাত্মা হচ্ছে ব্যাকরণ। ভাষার দেহ-কাঠামো আছে, ভাষা ব্যবহারের সুনির্দিষ্ট আইনকানুন আছে। ভাষা প্রবহমান। ভাষা খুব সহজে সীমান্ত পাড়ি দিতে পারে। বিনা রক্তপাতে অন্যদেশ দখল করতে পারে। বেশ খেটেখুটে আন্তোনিও তৈরি করলেন স্প্যানিশ ভাষার প্রথম ব্যাকরণ গ্রন্থ ‘Gramatica de la Castellana’; তিনি বইটি রানী ইসাবেলাকে উৎসর্গ করলেন।

‘‘এটি কি কাজে লাগবে?’’ রানী বইটি পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন। সেখানে উপস্থিত বিশপ অব অ্যাভিলা বললেন, ‘Majesty, Language is the instrument of empire’—মহামহীয়ষী রানী, ভাষা হচ্ছে সাম্রাজ্যের হাতিয়ার।

স্পেন ভাষাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে, সাম্রাজ্য বিস্তারে সফল হয়েছে। কিন্তু সাফল্য সবচেয়ে বেশি ইংরেজদের। ইংরেজ রাজত্বে ‘সূর্য অস্ত না যাওয়ার’ মিথ, শুধু মিথ নয় বাস্তবতা ছিল। বিশ্বায়নের হাতিয়ার হিসেবে ইংরেজি পৃথিবী গ্রাস করে নিয়েছে। মুক্তির সম্ভাবনা নেই, বরং অর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকতে জাতিসমূহ আত্মসমর্পণের প্রতিযোগিতায় নেমেছে।

স্প্যানিশ ভাষার প্রথম ব্যাকরণ গ্রন্থ রচনা করে তা রানী ইসাবেলাকে উৎসর্গ করেছিলেন ভাষাবিজ্ঞানী আন্তোনিও দ্য নেব্রিয়া।

বিশ্বায়নের হাতিয়ার ভাষা

বিশ্বায়ন কিংবা ভুবনায়নের তোড়টি প্রবল, সর্বব্যাপী এবং বিশ্বায়নের জন্য অপ্রস্তুত দেশের জন্য তা সর্বগ্রাসীও। বিশ্বায়নের সাংস্কৃতিক গ্রাসটি ভয়াবহ, যদিও শুরুতে বিশ্বায়ন উন্নয়ন অভিধানের বহুল ব্যবহৃত কেবল একটি শব্দ মাত্র—যা মূলত বাণিজ্যিক বাধা অপসারণের লক্ষ্যেই প্রণীত।

১৮৬৭ সালে ম্যাথু আর্নল্ড বেশ সশব্দেই উচ্চারণ করেছেন: আধুনিক সভ্যতার জন্য দরকার একই ধরনের ইংরেজি ভাষাভাষী একটি বিশ্ব। প্রযুক্তি যুগের আইকন বিল গেটস যেমন মাইক্রোসফট কোম্পানির ‘এনকার্টা ওয়ার্ল্ড ডিকশনারি’ চালুর দিন শুনিয়েছে: ‘এক পৃথিবী এক অভিধান’।

২০০০ বছর আগে গোটা ইউরোপে স্টিম রোলার চালিয়ে ল্যাটিন ভাষা যেভাবে ঢুকে পড়েছিল ইংরেজির বেলায়ও তাই ঘটছে। ইংরেজি আমাদের সময়ের ‘লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা’। ইংরেজির এই অভিযাত্রা দেখে ১৯৪৬ সালে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী বলেছিলেন, মনে হচ্ছে মানুষ ইংরেজির মাদকে মাতাল হয়ে গেছে। তিনি অবশ্য সর্বপ্লাবী নিউজ মিডিয়া, হলিউড আর ইন্টারনেটে ইংরেজির দৌরাত্ম্য দেখে যেতে পারেননি।

১৮৬৭ সালে ম্যাথু আর্নল্ড বেশ সশব্দেই উচ্চারণ করেছেন: আধুনিক সভ্যতার জন্য দরকার একই ধরনের ইংরেজি ভাষাভাষী একটি বিশ্ব। প্রযুক্তি যুগের আইকন বিল গেটস যেমন মাইক্রোসফট কোম্পানির ‘এনকার্টা ওয়ার্ল্ড ডিকশনারি’ চালুর দিন শুনিয়েছে: ‘এক পৃথিবী এক অভিধান’।

ভাষার দুনিয়া যেভাবে বদলে যাচ্ছে

যে ছয় হাজার ভাষা আমরা এখন ব্যবহার করছি আশাবাদী পরিসংখ্যান অনুযায়ী চলতি শতকে কেবল এর অর্ধেক সংখ্যক ভাষা টিকে থাকার কথা। মাত্র ১১টি ভাষা পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি মানুষের মাতৃভাষা। এর মধ্যে শীর্ষে ম্যান্ডারিন-চাইনিজ, দ্বিতীয় স্থানে ইংরেজি। হিন্দি ও উর্দু মিলিয়ে ইংরেজির সমান তারপর স্প্যানিশ। গ্রাফচিত্রে বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা বিবেচনায় এই ১১টি ভাষা হচ্ছে টল বিল্ডিং ল্যাঙ্গুয়েজ। এ ভাষাগুলোই পৃথিবীকে দখল করে নিয়েছে। ভাষার টল বিল্ডিং তালিকাটি হচ্ছে : ১. ম্যান্ডারিন-চাইনিজ, ২. ইংরেজি, ৩. হিন্দি/উর্দু, ৪. স্প্যানিশ, ৫. বাংলা, ৬. আরবী, ৭. রাশিয়ান, ৮. পর্তুগীজ, ৯. জাপানিজ, ১০. জার্মান, ১১. ফ্রেঞ্চ।

এই অবস্থানগত চিত্রটি কেবল মাতৃভাষার বিবেচনায়। কিন্তু ভাষা ব্যবহারের হিসেবটি ভিন্ন। সেটি হচ্ছে ভাষা ব্যবহারে দক্ষতার হিসেব। এই তালিকা বুঝিয়ে দেয় ইংরেজি দখল করেছে সাদা হাঙ্গরের অবস্থান। যেখানে মাতৃভাষা ইংরেজি, এমন জনসংখ্যা ম্যান্ডারিন-চাইনিজ ভাষা-ভাষীর অর্ধেকেরও কম, সেখানে ভাষা ব্যবহারে দক্ষতার প্রশ্নে ইংরেজি ব্যবহারকারীর সংখ্যা ম্যান্ডারিন-চাইনিজের প্রায় দ্বিগুণ। দক্ষ ব্যবহারের প্রশ্নে শীর্ষ ১১টি ভাষা: ১. ইংরেজি, ২. ম্যান্ডারিন-চাইনিজ, ৩. হিন্দি/উর্দু, ৪. স্প্যানিশ, ৫. রাশিয়ান, ৬. ইন্দোনেশিয়ান/মালয়েশিয়ান, ৭. আরবী, ৮. পর্তুগীজ, ৯. বাংলা, ১০. জাপানিজ, ১১. ফ্রেঞ্চ।

এই হিসেবটি গোগ্রাসি এক ভাষার অন্য ভাষাকে গিলে খাবার চিত্র তুলে ধরে। ইংরেজির নেটিভ স্পিকার যেখানে ৩৫ কোটি, দক্ষভাবে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করতে পারে এমন লোকের সংখ্যা ১৯০ কোটি। প্রায় দুই বিলিয়ন— দুশ’ কোটি লোক এখন  হ্যারি পটার পড়তে পারেন, শেকসপিয়ার পাঠের চেষ্টা চালাতে পারেন— নিদেন পক্ষে মাইক্রোসফট ম্যানুয়াল তো বটেই।

সর্বগ্রাসী ইংরেজির ‘বিশাল হা’

ইংরেজি এমন সর্বব্যাপী, যেখানে থাকার কথা নয়, সেখানেও ইংরেজি। জার্মান ও ইতালিয়ান স্কুল শিশুরা যখন শিক্ষা সফরে পরস্পরের দেশে যাচ্ছে, কথা বলছে ইংরেজিতে শিক্ষকরা বিরক্ত হচ্ছেন, কিন্তু তাতে কিছু এসে যায় না। ডাচদের এখন বিতর্কের প্রিয় বিষয় উচ্চশিক্ষার বাহন ইংরেজিই হওয়া উচিত। কারণ সব রেফারেন্স গ্রন্থ আর ডক্টরাল থিসিসতো ইংরেজিতেই।

রিচার্ড মরিসন সর্বগ্রাসী ইংরেজির ‘বিশাল হা’ দেখে বলছেন, আমরা আশা করব মানবজাতি একটি সর্বাত্মক অতলান্ত সাগরের মাঝে পড়বে না।

কিন্তু এটাও সত্য বিল গেটস-এর ‘এক পৃথিবী এক অভিধান’ কেবল এক প্রজন্ম দূরে।

পৃথিবীতে সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের মাতৃভাষা ম্যান্ডারিন-চাইনিজ আর ইংরেজি যাদের মাতৃভাষা তাদের সংখ্যা ম্যান্ডারিনভাষীদের অর্ধেকেরও কম। কিন্তু মাতৃভাষা না হলেও ইংরেজি ভাষা দক্ষভাবে ব্যবহার করতে পারেন এমন মানুষের সংখ্যা ম্যান্ডারিনভাষীদের দ্বিগুণেরও বেশি। আর দক্ষ ইংরেজি ব্যবহারকারীর সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।

ইংরেজি হচ্ছে ভাষার এক রাঘববোয়াল। ছোট ছোট ভাষা অবলীলায় খেয়ে ফেলছে। কেনিয়ায় ব্যবহৃত ভাষার সংখ্যা ৪২; ভাষাগুলো চলে যাচ্ছে ইংরেজির পেটে। বয়োজ্যেষ্ঠ কেনিয়ানদের হৃদয়ের ক্রন্দন : আমাদের ভাষা মরে যাচ্ছে—Our languages are dying! কেনিয়া কেবল উদাহরণ হিসেবেই উল্লেখিত হলো, কার্যত ইংরেজির দৌরাত্ম্য যেসব এলাকায়, সেখানে অন্য ভাষার নিরাপত্তা বিধানের কী আর কোনও সুযোগই নেই?

যেখানে মাতৃভাষা ইংরেজি, এমন জনসংখ্যা ম্যান্ডারিন-চাইনিজ ভাষা-ভাষীর অর্ধেকেরও কম, সেখানে ভাষা ব্যবহারে দক্ষতার প্রশ্নে ইংরেজি ব্যবহারকারীর সংখ্যা ম্যান্ডারিন-চাইনিজের প্রায় দ্বিগুণ। দক্ষ ব্যবহারের প্রশ্নে শীর্ষ ১১টি ভাষা: ১. ইংরেজি, ২. ম্যান্ডারিন-চাইনিজ, ৩. হিন্দি/উর্দু, ৪. স্প্যানিশ, ৫. রাশিয়ান, ৬. ইন্দোনেশিয়ান/মালয়েশিয়ান, ৭. আরবী, ৮. পর্তুগীজ, ৯. বাংলা, ১০. জাপানিজ, ১১. ফ্রেঞ্চ।

নিজ বাসভূমে ভাষা-ঘাতক ইংরেজি

ইংরেজি তো নিজ বাসভূমিতেই ভাষা-ঘাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।

একশত বছর আগে স্কটিশ গেইলিক ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা ছিল দুই লাখ। ২০২১-এ সংখ্যাটি সাতান্ন হাজারে নেমে এসেছে যা স্কটিশ পঞ্চান্ন লক্ষ জনসংখ্যার শতকরা এক ভাগের সামান্য বেশি। অথচ এক সময় এটিই ছিল স্কটিশদের মূল ভাষা।

যে কোনও ঝুঁকিপূর্ণ ভাষার জন্য পঞ্চাশ হাজার একটি গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যা। একটি ভাষাকে টিকিয়ে রাখতে হলে কমপক্ষে পঞ্চাশ হাজার মানুষের মুখে সে ভাষা অনর্গল উচ্চারিত হওয়া প্রয়োজন। এই হিসেবটি ভাষা বিশেষজ্ঞদের। এর কম হলে ভাষা টেকসই হয় না। গেইলিক এখন সেই পঞ্চাশ হাজারের সীমান্ত রেখায়। দুর্ভাগ্যজনক আর একটি তথ্য হচ্ছে এই বর্তমান সাতান্ন হাজারের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের বয়স সত্তর বছর পার হয়ে গেছে। কাজেই এ ভাষার ভবিষ্যৎ কী তা বলার জন্য গণক হবার প্রয়োজন নেই। ব্রিটিশ সরকারের সহানুভূতিহীন আচরণের সত্ত্বেও শতাব্দীর পর শতাব্দী টিকে থেকে এখন যখন স্কটল্যান্ডের স্ব-শাসনের সময় এসেছে, দেখা যাবে তাদের নিজস্ব ভাষাটির আর অস্তিত্ব নেই। গেইলিক ভাষার বিদায়ের সাথে সাথে কেলটিক সংস্কৃতির পুরো অধ্যায়টি হারিয়ে যাবে।

স্কটল্যান্ডের এই সংকটটি তীব্র, কিন্তু ব্যতিক্রমধর্মী কিছু নয়। প্রতি এক পক্ষকালে পৃথিবীর কোথাও না কোথাও একটি ভাষার মৃত্যু হচ্ছে। হারিয়ে যাওয়া, মৃত্যুর মুখে পতিত হওয়া ভাষার সংখ্যা অবিশ্বাস্য রকম বৃহদাকার।

বিংশ শতকের মধ্যভাগেই শত শত অস্ট্রেলিয়ান এবং উত্তর আমেরিকান ভাষা আধুনিক শিক্ষা কর্মসূচির পাল্লায় পড়ে একেবারেই হারিয়ে গেছে। এখন করদাতাদের অর্থে মরা ভাষাকে বাঁচিয়ে তোলার উল্টো প্রক্রিয়া চালানোর প্রচারণাও চালানো হচ্ছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের আমলাদের রাজনৈতিকভাবে শুদ্ধ প্রচেষ্টা গ্রহণের পরও ডজন ডজন ইউরোপীয় ভাষার বিলুপ্তি ঘটছে। কেবলমাত্র প্রশাসনিক সুবিধার দোহাই দিয়ে আফ্রিকার সরকারসমূহের শিক্ষিত নীতি প্রণেতাগণ বহু ভাষা জলাঞ্জলি দিয়ে একটি-দু’টি ভাষার ভেতর সকল নাগরিককে বন্দী পাঠক করার পদক্ষেপ নিয়েছেন।

বিলুপ্তি সংকটে থাকা ভাষার মানচিত্র প্রকাশ করেছে ইউনেস্কো।

বিলুপ্তি সংকটে থাকা ভাষার মানচিত্র

ইউনেস্কো প্রকাশ করেছে ‘Atlas of the World’s Voices in Danger of Disappearing’— বিলুপ্তি সংকটে যেসব ভাষা, তার মানচিত্র। ড্যানিয়েল নেটলার ও সুজান রোমেইন লিখেছেন ‘ভ্যানিসিং ল্যাঙ্গুয়েজেজ’, ডেভিড ক্রিস্টাল লিখেছেন ‘ল্যাঙ্গুয়েজ ডেথ’ এবং এন্ড্রু ভ্যালরির বই ‘ল্যাঙ্গুয়েজ ইন ডেঞ্জার’। সবগুলো বইয়ের মোদ্দা কথা— ডেভিড ক্রিস্টাল লিখেছেন, ‘‘সকল মানবিকতার পূর্বশর্ত যদি বৈচিত্র্য হয়ে থাকে তাহলে সবার আগে দরকার ভাষার বৈচিত্র্য রক্ষা করা—মানবিকতার কেন্দ্রে রয়েছে ভাষা।’’

১৮৬৭ সালে ম্যাথু আর্নন্ড বলেছিলেন, ‘‘আমরা যাকে আধুনিক সভ্যতা বলি তার জন্য দরকার একই ধরনের ইংরেজি ভাষাভাষী বিশ্ব।’’ আর তা করতে গেলে খেয়ে ফেলতে হবে পৃথক সব জাতিসত্ত্বা। এন্ড্রু ভ্যালরি বলেছেন, ‘‘যে ভাষা হারিয়ে যায় তা একটি সংস্কৃতিকে নিয়ে চিরতরে বিলুপ্ত হয়।’’ আর তা কেবল একটি সংস্কৃতি মাত্র নয়—

সভ্যতার জ্ঞানভান্ডারের অপূরণীয় একটি অংশ। (রিচার্ড মরিসনের মাইন্ড ইয়োর ল্যাঙ্গুয়েজ  থেকে  আংশিক অনুদিত)

ইংরেজি হয়ে উঠেছে বিংশ শতকের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা

ইংরেজি চালিয়েছে ‘ল্যাক্সিকাস ইনভেশন’—আভিধানিক আক্রমণ। ইংরেজির বিশ্বায়নী উত্থানে জার্মান ও ফরাসীর মতো শক্তিশালী ও রক্ষণশীল ভাষাও আতঙ্কিত আর ম্যান্ডারিন-চাইনিজের মতো আগ্রাসী ভাষাও সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে।

একালের অধ্যায়টি বিশ্বায়নের। ‘গ্লোবাল’ শব্দটির প্রথম ব্যবহার ১৮৯০ সালে মূলত ভ্রমণ ও অভিযাত্রা প্রসঙ্গে, বাণিজ্যিক অর্থে প্রথম ব্যবহৃত হয় ১৯৫৭ সালে। ১৯৬০ সালে মার্শাল ম্যাকলুহান প্রথম ‘গ্লোবাল ভিলেজ’ শব্দ দুটি ব্যবহার করেন—

সেখান থেকে উদ্ভূত গ্লোবালাইজেশন বা বিশ্বায়ন; ইংরেজি অভিধানে অন্তর্ভুক্ত ১৯৬১ সালে। শুরুটা মূলধনের অবাধ প্রবাহ নিয়ে হলেও বিশ্বায়নের পরিধি বাড়তে থাকে, এখন সর্বব্যাপ্ত। আর এই গ্লোবালাইজেশন বা বিশ্বায়নের ভাষা হচ্ছে ইংরেজি।

বিশ্বায়নের তোড়ে ভৌগোলিক সীমান্ত মুছে যাচ্ছে অনেক সার্বভৌম সত্তার। ইংরেজিকে পরিণত করা হয়েছে সর্বগ্রাসী ভাষায়। উলরিখ নেক বিশ্বায়নকে দেখছেন বহুজাতিক স্বার্থের হাতিয়ার হিসেবে, যা ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলোার স্বার্থ। বিশ্বায়ন কেবল বাণিজ্য ও মূলধনের বিশ্ব পরিভ্রমণের অনুশোচনা নয়, ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আগ্রাসন চালানোরও সম্মতি। অসম সম্পর্কের বলি হচ্ছে বিপন্ন জনগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি।

ইংলিশ ওনলি মুভমেন্ট

মার্কিন প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্ট ১৯১৪ সালে জোর দিয়ে বলেছেন যে তার দেশে কেবল একটি ভাষারই ঠাঁই; সে ভাষা ইংরেজি।

আন্দোলনের শুরুটা কিংবা উসকনি দেয়ার কাজটা প্রেসিডেন্ট নিজেই করলেন। রুজভেল্টের ‘ইংলিশ ওনলি’ ঘোষণা অভিবাসীর দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসীদের দুঃস্বপ্নের কারণ হয়ে দাঁড়াল। ১৮০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ফ্রান্সের কাছ থেকে লুইজিয়ানা ক্রয় করে নিল। লুইজিয়ানা কেবল ভূখণ্ড নয়, সঙ্গে আছে ৫০ হাজার ফরাসীভাষী মানুষ। মেক্সিকো-আমেরিকা যুদ্ধের পরিণতি— যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগ দেয় ৭৫ হাজার স্প্যানিশভাষী। সবাই তখন আমেরিকান হবে।

১৮০৩-১৮৪৬ সাল পর্যন্ত চলল ফরাসীভাষীদের আমেরিকান বানানোর চেষ্টা। এক সময় নিশ্চিত হওয়া গেল, মাতৃভাষা ছাড়া অনেকেরই পড়াশোনা সম্ভব নয়। ১৮৪৭ সালে শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি ও ফরাসী করা হলো। ১৮৪৯-এ ক্যালিফোর্নিয়াও ঘোষণা দিল শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি ও স্প্যানিশ। কিন্তু আদিবাসী ইন্ডিয়ানদের বেলায় সর্বত্র ইংরেজিই হবে শিক্ষার একমাত্র ভাষা। ১৮৭৮-এ ক্যালিফোর্নিয়া নতুন আইন করল। অন্য কোনও ভাষা নয়, ইংরেজিই সব কর্মকর্তার জন্য বাধ্যতামূলক।

১৯৮০ সালে ‘ইউএস ইংলিশ’ এবং ‘ইংলিশ ফার্স্ট’— দুটি দল আন্দোলন শুরু করল ইংরেজির আইনি মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এটি প্রান্তবর্তী ও উপেক্ষা করার মতো কোনও আন্দোলন নয়। অভাবনীয় সাড়া পাওয়া গেল রাজ্যগুলোর কাছ থেকে। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে অনেক রাজ্য আইন পাস করে ইংরেজিকে সরকারী ভাষার মর্যাদা দিল।

ইংলিশ ওনলি মুভমেন্টের সাফল্য যা-ই থাক, এটা কি একটি বর্ণবাদী আন্দোলন নয়? যাদের বাস্তুচ্যুত করে ইংরেজি ভাষাভাষীরা আমেরিকা দখল করল, সেই ইন্ডিয়ানদের ভাষারও কোনও মর্যাদা থাকল না।

ব্রিটিশ ইংরেজিই হোক কি আমেরিকান ইংরেজি— গোটা বিশ্বই এখন ইংরেজির….। ইংরেজি এখন আর কোনও ভাষা শুধু নয়, হাতিয়ার ও প্রযুক্তি। বিশ্বের সব স্থানীয় ভাষা ও সংস্কৃতিকে এ জন্য দিতে হচ্ছে অনেক বড় খেসারত।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক।
ইমেইল: momen98765@gmail.com

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত