Beta
বুধবার, ৩ জুলাই, ২০২৪
Beta
বুধবার, ৩ জুলাই, ২০২৪

রাসেলস ভাইপার আতঙ্কে মারা হচ্ছে নির্বিষ সাপও

সাপ না মারার বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরিতে কাজ করে আসছে বাংলাদেশ স্নেক রেসকিউ টিম।
সাপ না মারার বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরিতে কাজ করে আসছে বাংলাদেশ স্নেক রেসকিউ টিম।
Picture of জাকিয়া আহমেদ

জাকিয়া আহমেদ

দেশজুড়ে রাসেলস ভাইপার আতঙ্কের মধ্যে পিটিয়ে মারা হচ্ছে নির্বিষ সাপও; অথচ পরিবেশের ভারসাম্যের জন্য এই প্রাণীটিরও প্রয়োজন রয়েছে। তাছাড়া দেশের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনেও এই সাপ পিটিয়ে মারা নিষিদ্ধ।

গত ২৩ জুন চট্টগ্রামের চন্দনাইশের পাহাড়ি এলাকা ধোপাছড়ি ইউনিয়নের চিরিংঘাটা এলাকায় রাসেলস ভাইপার সন্দেহে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয় চারটি সাপ। পরে বনবিভাগের দোহাজারী রেঞ্জের রেঞ্জার মো. রেজাউল করিম জানান, সেগুলো আসলে নির্বিষ ঢোঁড়া সাপ।

মেরে ফেলা সাপগুলোর নাম বাফ ডোরাকাটা কিলব্যাক (দাগি ঢোঁড়া)। এগুলো বিষহীন কলুব্রিড সাপের প্রজাতি এবং পুরো এশিয়া জুড়েই রয়েছে।

একইদিন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মিউনিসিপ্যাল মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সকালে ঘরগিন্নি নামের এক সাপকে পিটিয়ে মারা হয়। অথচ এই সাপ একেবারেই নির্বিষ। এরও আগে চট্টগ্রামেরই লোহাগাড়ায় একটি অজগরকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়।

কয়েকদিন আগে কক্সবাজারের রামুতে রাসেলস ভাইপার সন্দেহে মারার পর পুড়িয়ে ফেলা হয় একটি সাপ। কিন্তু পরে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের কর্মকর্তারা গিয়ে দেখেন সাপটি রাসেলস ভাইপার নয়, বার্মিজ পাইথন।

বরেন্দ্রভূমির সাপ রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়ার বিস্তার বাড়লেও চট্টগ্রামে এখনও এই সাপের দেখা পাওয়া যায়নি বলে গবেষকরা জানিয়েছেন। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে স্থাপিত ভেনম রিসার্চ সেন্টারও চট্টগ্রাম অঞ্চলে রাসেলস ভাইপার পায়নি।

রাজশাহী অঞ্চল থেকে পদ্মা তীরের বিভিন্ন জেলায় রাসেলস ভাইপার সাপের দেখা মিললেও সারাদেশে এই সাপ ছড়িয়েছে, এমন তথ্য না মিললেও সাপ মারা হচ্ছে বিভিন্ন জেলায়ই।

সোমবার নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ায় রাসেলস ভাইপার সন্দেহে দুটি সাপ পিটিয়ে মারে এলাকাবাসী। এর আগে গত বৃহস্পতিবারও সেখানে আরেকটি সাপ পিটিয়ে মারা হয়।

রাসেলস ভাইপার নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে বনবিভাগের হটলাইনে ঘণ্টায় প্রায় ৫০টিরও বেশি ফোন কল আসছে। বনবিভাগ বলছে, প্রতিদিন যেসব সাপ মারা হচ্ছে, তার শতকরা ৮০ ভাগই নির্বিষ।

জাতীয় হেল্পলাইন ৩৩৩ এ কল করা হলে সজীব নামের একজন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, সাপ নিয়ে অনেক ফোন তারা পাচ্ছেন। ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, বরিশাল ও রাজশাহী বিভাগের কিছু এলাকা থেকে বেশি ফোন আসছে। সাপ নিয়ে এত ফোনকল এর আগে তারা কখনও পাননি।

দেশের যে কোনও স্থানে কোনও সাপ দেখা গেলেই মানুষ ফোন করছে। আবার কেউ সাপ মেরে তার ছবি কীভাবে পাঠাবেন, তাও জানতে চাইছে।

বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিচালক ছানাউল্যাহ পাটোয়ারী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “মিনিটে মিনিটে কল আসছে, ফোনে কথা বলতে বলতে আরও কল অপেক্ষায় থাকছে-এমন পরিস্থিতি হয়েছে। ভালো লাগছে যে মানুষ সচেতন। কিন্তু বেশিরভাগ মেরে ফেলা সাপই যাচাই করে দেখা গেছে নির্বিষ।”

রাসেলস ভাইপার মনে করে অজগর, শঙ্খিনি, ঘরগিন্নির মতো সাপও মারা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “কেবল রাসেলস ভাইপার না, কোনও সাপই যেন না মারা হয়, সেজন্য কথা বলছি, কাউন্সেলিং করছি।

“তাদেরকে বলছি, কোনও সাপই নিজে আক্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত অন্যকে আক্রান্ত করে না। মানুষ সচেতন হলেও সাপ মারাটা বন্ধ করতে হবে আমাদের, সেটা কীভাবে করা যায়, সে নিয়েই কাজ করছি আমরা এখন।”

চট্টগ্রামের ভেনম রিসার্চ সেন্টারের সহকারী গবেষক আব্দুল আউয়াল সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “দেশজুড়ে যেভাবে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে, তার আঁচ লেগেছে এখানেও। সাধারণ মানুষ সাপ চেনে কম। আতঙ্কে মানুষ সব সাপকেই রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া মনে করছে। যার ফলে বিষধর কিংবা নির্বিষ সাপ নির্বিশেষে মারা পড়ছে।”

রাসেলস ভাইপার নিয়ে আতঙ্ক দেখা দেওয়ায় সচেতনতামূলক নির্দেশনা এরই মধ্যে দিয়েছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। সেখানে বলা হয়েছে, তালিকাভুক্ত বন্যপ্রাণী হিসাবে রাসেলস ভাইপার মারাও বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনে নিষিদ্ধ।

সাপ না মারার আহ্বান জানিয়ে নির্দেশনায় বলা হয়, “রাসেলস ভাইপার ইঁদুর খেয়ে যেমন ফসল রক্ষা করে, তেমনি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই সাপের বিষ হতে অনেক জীবন রক্ষাকারী ঔষধ তৈরি হয়। সাপ মারা দণ্ডনীয় অপরাধ, সাপ মারা হতে বিরত থাকুন।”

সাপ মারার সূদূরপ্রসারী প্রভাব তুলে ধরে গবেষক আউয়াল বলেন, “ফুড চেইনে সাপ অনেক প্রাণীকে নিধন করে। যেমন ইঁদুর। যদি অতিরিক্ত সাপ মেরে ফেলা হয়, সেক্ষেত্রে ইঁদুরের সংখ্যা অনেক বাড়বে।

“ইঁদুর যখন বাড়বে, তখন শস্যজাতীয় যত খাবার রয়েছে, তার উৎপাদন কমে যাবে। ইঁদুরবাহিত রোগের প্রকোপের আশঙ্কা তৈরি হবে। এর ফলে যেসব জায়গায় শক্ত মাটি রয়েছে, ইঁদুর যেহেতু শক্ত মাটিতে বাসা করে, সেহেতু সেসব মাটি ধসেরও আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।”

সাপ পিটিয়ে মেরে ফেলারোধে সরকারের ভুমিকা কী হতে পারে- প্রশ্নে তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে সকল উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এবং জেলা সদর ও মেডিকেল কলেজগুলোয় সাপে কাটার চিকিৎসার অ্যান্টিভেনম মজুদ রয়েছে। এই চিকিৎসা বিনামূল্যে দেওয়া হয়। সেই বিষয়টি নিয়ে এখন সরকারি উদ্যোগে ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে।

“সাপে কাটলে ভিকটিমকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে এবং সাপেকাটা রোগীর চিকিৎসার বিষয়টা সার্বক্ষণিক মনিটরিং এর আওতায় আনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত