পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টিতে বাংলাদেশে এই পর্যন্ত অনুষ্ঠিত সবচেয়ে অবাধ নির্বাচনটি পরিচালনায় যিনি ছিলেন, সেই বিচারপতি এম এ রউফ আর নেই।
১৯৯১ সালে নির্দলীয় সরকারের সময়ে তার নির্বাচন পরিচালনায় সাফল্য দলীয় সরকারের সময়ে হারিয়ে গেলে সিইসির দায়িত্ব থেকে সরে এসেছিলেন তিনি।
প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদ ছেড়ে বিচারাঙ্গনে ফিরে এসেছিলেন তিনি। হাই কোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগে দায়িত্ব পালন শেষে ছিলেন অবসরে।
রবিবার সকালে ঢাকার মগবাজারে বেসরকারি একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বিচারপতি রউফের মৃত্যু হয়। তার বয়স হয়েছিল ৯১ বছর।
তিনি দুই ছেলে, এক মেয়ে রেখে গেছেন। তার এক ছেলে মোহাম্মদ আরশাদুর রউফ অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্বে রয়েছেন।
এম এ রউফের জন্ম ১৯৩৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পর গত শতকের ষাটের দশকে আইনজীবী হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। ১৯৮২ সালে বিচারক হিসাবে যোগ দেন হাই কোর্টে।
নব্বইয়ের গণআন্দোলনে এইচ এম এরশাদের সরকারের পতন ঘটলে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মো. সাহাবুদ্দীন অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়ে নির্বাচন পরিচালনার ভার দিয়েছিলেন সহকর্মী রউফকে।
বিচারপতি সুলতান হোসেন খানের উত্তরসূরি হিসাবে সিইসি পদে শপথ নেন বিচারপতি রউফ। তিনি হন বাংলাদেশের পঞ্চম সিইসি। ১৯৯০ সালের ২৫ ডিসেম্বর থেকে ১৯৯৫ সাল ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি হয়েছিল পঞ্চম সংসদ নির্বাচন। নির্দলীয় সরকারের অধীনে সেই নির্বাচন কুড়িয়েছিল দেশে-বিদেশে প্রশংসা, তার ভাগিদার হয়েছিলেন সিইসি রউফ।
সেই নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করে বিএনপি; আওয়ামী লীগ সংসদে বিরোধী দলের আসন নিয়েছিল।
সেবার ভোটে মাগুরা-২ আসনে (শালিখা ও মহম্মদপুর) সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা মো. আসাদুজ্জামান। তিনি মারা যাওয়ায় মাগুরা-২ আসনে উপ-নির্বাচনের আয়োজন হয় ১৯৯৪ সালের ২০ মার্চ।
আওয়ামী লীগ প্রার্থী করেছিল আসাদুজ্জামানের ছেলে শফিকুজ্জামান বাচ্চুকে। ক্ষমতাসীন বিএনপির প্রার্থী হন জি কিউ গ্রুপ অব কোম্পানিজের মালিক কাজী সালিমুল হক কামালকে। এই কোম্পানির বল পয়েন্ট কলম ছিল ইকোনো, সেই কারণে তিনি ‘ইকোনো কামাল’ নামে ছিলেন পরিচিত।
সেই উপ-নির্বাচনে জাল ভোট আর কেন্দ্র দখলের মহড়া ছিল ব্যাপকভাবে আলোচিত।
তিন কেন্দ্রে ভোট স্থগিত হওয়ার পাশাপাশি ব্যাপক সন্ত্রাস ও কারচুপির অভিযোগের খবর এসেছিল পরদিনের আজকের কাগজে। ইত্তেফাকের শিরোনাম ছিল- মাগুরার উপ-নির্বাচনে সহিংসতা ও ভোট ডাকাতির অভিযোগ।
ওই নির্বাচন ঘিরে বিরোধী দলের অভিযোগে ভিত্তি দিয়েছিল তৎকালীন সিইসি বিচারপতি আব্দুর রউফের নির্বাচনী এলাকা থেকে আকস্মিক চলে আসা।
ভোটের আগের দিন ১৯ মার্চ সকালে মাগুরায় গিয়েছিলেন তিনি; কথা ছিল ভোট শেষ করেই তিনি আসবেন। কিন্তু পরিবেশ দেখে বিরক্ত হয়ে ভোটের আগের রাতেই তিনি ঢাকা ফিরে আসেন।
ফেরার পর বিচারপতি রউফ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “আমি মাগুরায় নির্বাচনের দিন থাকতে গিয়েছিলাম। কিন্তু গিয়ে দেখলাম, সেখানে অনেক মন্ত্রী আছেন, বিরোধীদলীয় নেত্রী আছেন, একশর ওপর এমপি আছেন। আমি আর থাকার প্রয়োজন বোধ করিনি। তাই চলে এসেছি।”
বিচারপতি রউফ সেদিন আর কোনও কথা বলেননি; শুধু বলেছিলেন, “নির্বাচন শেষ হলে কথা বলব।”
পরে সিইসি হিসাবে নিজের মেয়াদের আট মাস বাকি থাকতেই নির্বাচন কমিশন থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে আসেন বিচারাঙ্গনে।
মাগুরার সেই উপ-নির্বাচনই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আসার পথ করে দেয় বাংলাদেশে। যে নির্বাচন ব্যবস্থায় এখনও ঘুরপাক খাচ্ছে রাজনীতি।
১৯৯৪ সালে মাগুরার উপ-নির্বাচনের পরপরই আওয়ামী লীগ নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে আন্দোলনে নামে। অপরাপর রাজনেতিক দলও তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। তারা সবাই সংসদ থেকে পদত্যাগ করে।
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হলেও প্রবল আন্দোলনের চাপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি সংবিধানে সংযোজন করতে বাধ্য হয় বিএনপি সরকার।
এরপর তিনটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হলেও ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর তা সংবিধান থেকে বাদ দেয়। তারপর অনুষ্ঠিত তিনটি নির্বাচনই গ্রহণযোগ্যতার নিরিখে পড়ে প্রশ্নের মধ্যে।
গত বছর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধান সংস্কারের যে উদ্যোগ নিয়েছে, তাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি আবার ফেরানো হচ্ছে।
এদিকে বিচারপতি রউফ ১৯৯৪ সালে ইসি থেকে হাই কোর্ট বিভাগে ফেরার পরের বছরই পদোন্নতি পেয়ে আপিল বিভাগের বিচারক হন। ১৯৯৯ সালে যান অবসরে।
এরপর ফারইস্ট ইসলামিক লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি এবং প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের শরিয়াহ উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করেন তিনি। শিশু-কিশোর সংগঠন ‘ফুলকুঁড়ি আসর’র কেন্দ্রীয় সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন।
পরিবারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঢাকার আনুষ্ঠানিকতা সেরে ময়মনসিংহে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে।