রেমিটেন্সের মতো বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের প্রধান উৎস রপ্তানি আয়েও ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) মোট ২ হাজার ৮৯৬ কোটি ৯৫ লাখ (প্রায় ২৯ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছেন বিভিন্ন খাতের রপ্তানিকারকরা।
সদ্য শেষ হওয়া জানুয়ারি মাসে ৪৪৩ কোটি ৬০ লাখ (৪.৪৩ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছেন রপ্তানিকারকরা, যা গত বছরের জানুয়ারির চেয়ে ৫ দশমিক ৭০ শতাংশ বেশি। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে আয়ের অঙ্ক ছিল ৪১৯ কোটি ৭০ লাখ (৪.১৯ বিলিয়ন) ডলার।
এ নিয়ে টানা চার মাস ৪ বিলিয়ন (৪০০ কোটি) ডলারের বেশি রপ্তানি আয় দেশে এসেছে।
মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি আসে যে খাত থেকে, সেই পোশাক শিল্পে শ্রমিক অসন্তোষে কারখানা বন্ধসহ নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও অনিশ্চয়তার মধ্যেও রপ্তানি আয় বাড়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন রপ্তানিকারক ও অর্থনীতিবিদরা। এই ধারা আগামী মাসগুলোতে অব্যাহত থাকবে কি না- তা নিয়ে সংশয়ও প্রকাশ করেছেন তারা।
গত বছরের শেষ ও চলতি অর্থবছরের ষষ্ঠ মাস ডিসেম্বরে ৪৬২ কোটি ৭৫ লাখ (৪.৬২ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিলেন রপ্তানিকারকরা; প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৭ দশমিক ৭২ শতাংশ।
নভেম্বর মাসে রপ্তানির অঙ্ক ছিল ৪১১ কোটি ৯৭ লাখ (৪.১২ বিলিয়ন) ডলার; আগের বছরের নভেম্বরের চেয়ে বেড়েছিল ১৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ। অক্টোবরে আয় হয়েছিল ৪ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার; প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২০ দশমিক ৬৫ শতাংশ।
অর্থবছরের তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে আয় হয়েছিল ৩ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার; বেড়েছিল ৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ। আগস্ট ও জুলাইয়ে আয়ের অঙ্ক ছিল যথাক্রমে ৪ দশমিক শূন্য তিন ও ৩ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার; প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৫ দশমিক ৬১ ও ২ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
সব মিলিয়ে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) রপ্তানি আয় বেড়েছে ১১ দশমিক ৬৮ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এই সাত মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে ২ হাজার ৫৯৩ কোটি ৮৯ লাখ (২৫.৯৪ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ।
সোমবার রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) রপ্তানি আয়ের হালনাগাদ এই তথ্য প্রকাশ করেছে।
রপ্তানিকারকরা অনেক দিন ধরেই অভিযোগ করছিলেন, ইপিবি রপ্তানি আয়ের ফোলানো-ফাঁপানো তথ্য দিচ্ছে। গত বছরের জুলাই মাসে রপ্তানি আয়ের হিসাবে বড় ধরনের গরমিল ধরা পড়ার পর ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে ইপিবি।
এরপর থেকে রপ্তানি আয়ের সংশোধিত বা প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করছে ইপিবি। গরমিল ধরা পরার পর গত বছরের ৯ অক্টোবর চলতি অর্থবছরের তিন মাসের (প্রথম প্রান্তিক, জুলাই-সেপ্টেম্বর) তথ্য একসঙ্গে প্রকাশ করেছিল ইপিবি।
৪ ডিসেম্বর নভেম্বর মাসের তথ্য প্রকাশ করা হয়। ২ জানুয়ারি প্রকাশ করা হয় ডিসেম্বর মাসের তথ্য। সোমবার প্রকাশ করা হয়েছে জানুয়ারি মাসের তথ্য।
পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ১২ শতাংশ
দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত হচ্ছে তৈরি পোশাক; মোট আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি আসে এই খাত থেকে।
ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, জানুয়ারি মাসে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৩ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলার; যা গত বছরের জানুয়ারির চেয়ে ৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ বেশি। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছিল ৩ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার।
আগের মাস ডিসেম্বরে পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছিল ৩ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার; প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে মোট পণ্য রপ্তানির প্রায় ৮১ দশমিক ৩০ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক থেকে। এই সাত মাসে ২৩ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২১ দশমিক ০২ বিলিয়ন ডলার।
হিসাব বলছে, জুলাই-জানুয়ারি সময়ে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ১২ শতাংশ।
এই সাত মাসে নিট পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ১২ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৬২ শতাংশ। ওভেন পোশাক থেকে এসেছে ১০ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলার; বেড়েছে ৪ দশমিক ৫২ শতাংশ।
অন্যান্য খাত
জানুয়ারিতে তৈরি পোশাক ছাড়া অন্য খাতের মধ্যে কৃষি পণ্য রপ্তানি থেকে আয়ে ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এই মাসে বিভিন্ন ধরনের কৃষি পণ্য রপ্তানি থেকে ৭ কোটি ৮৩ লাখ ৩০ হাজার ডলার আয় হয়েছে। গত বছরের জানুয়ারিতে আয়ের অঙ্ক ছিল ৬ কোটি ৪৫ লাখ ৫০ হাজার ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২১ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
সাত মাসের (জুলাই-জানুয়ারি) হিসাবে কৃষি পণ্য থেকে আয় বেড়েছে ১০ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
জানুয়ারিতে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি থেকে আয় কমেছে ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ। তবে সাত মাসের হিসাবে বেড়েছে ৮ দশমিক ০৮ শতাংশ।
জানুয়ারিতে পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে আয় কমেছে ৯ দশমিক ৮৫ শতাংশ; জুলাই-জানুয়ারি সময়ে কমেছে ৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
জানুয়ারিতে হোম টেক্সটাইল রপ্তানি থেকে আয় কমেছে ১ দশমিক ১৭ শতাংশ। তবে সাত মাসের হিসাবে বেড়েছে ৬ দশমিক ২২ শতাংশ।
গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৪৪ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ; যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০২২-২৩) চেয়ে ৪ দশমিক ২২ শতাংশ কম।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে মোট ৫০ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্য ধরেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময় সংঘাতময় পরিস্থিতিতে পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানি ব্যাহত হয়। ৫ অগাস্ট সরকার পতনের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়।
এর মধ্যে গাজীপুর ও ঢাকার সাভারে শ্রমিক অসন্তোষের বেশ কয়েক দিন অনেক পোশাক কারখানা বন্ধ থাকে; উৎপাদন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়। শ্রমিক অসন্তোষের কারণে এখনও পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান এ খাতের কর্মকাণ্ড।
ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর অস্থিরতার মধ্যেও রপ্তানি আয় বাড়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম।
সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “পোশাক রপ্তানির এখন ভরা মৌসুম (পিক সিজন) চলছে। নভেম্বর থেকে জানুয়ারি আমাদের পোশাক রপ্তানির পিক সিজন। সব সময় এই তিন মাস আমাদের রপ্তানি বাড়ে। তারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে রপ্তানি আয়ের তথ্যে।”
“জুলাই-অগাস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে আমাদের ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এরপরও রপ্তানি আয় বাড়ায় আমরা খুশি। তবে আমাদের অর্ডার কিন্তু কমছে। জানি না আগামী মাসগুলোতে কী হবে।”
হাতেম বলেন, “চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিরতার মধ্য দিয়ে গেছে। আমাদের হিসাবে জুলাই মাসের মধ্যে এক সপ্তাহেই পোশাক শিল্পে ক্ষতি হয়েছে ১ বিলিয়ন ডলারের উপরে। আর ব্যাংক বন্ধ থাকায় তো রপ্তানির উপর সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।”
“এই অস্থিরতা-অনিশ্চতা না থাকলে আমাদের রপ্তানি হয়ত আরও বাড়ত। এখন চিন্তার বিষয় হচ্ছে আগামী দিনগুলো কী হবে,” বলেন বিকেএমইএ সভাপতি।
বিশ্ব ব্যাংক ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “নানা বাধা-বিপত্তির মধ্যেও রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা ভালো দিক। সাত মাসের হিসাবে সাড়ে ১১ শতাংশ যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, অর্থবছর শেষে যদি সেটা থাকে তাহলে খুবই ভালো। কিন্তু সেটা থাকবে কি না, সেটাই এখন চিন্তার বিষয়।
“রপ্তানিকারকরা বলছেন, তাদের অর্ডার কমে গেছে। দেশের রাজনীতিতে অস্থিরতা আছে, অনিশ্চয়তা আছে। অর্থনীতিতে ক্রান্তিকাল চলছে। বিনিয়োগ নেই; কর্মসংস্থান নেই। আইনশৃংখলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি; দিন দিন আরও খারাপ হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে তৈরি পোশাকের বায়াররা মুখ ফিরিয়ে নেবে; অন্য দেশে চলে যাবে। তখন কিন্তু রপ্তানি কমে যাবে।”
“আমাদের এখন অর্থনীতির দুটি সূচকই বাঁচিয়ে রেখেছে। একটি প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয়। এই দুটি খাত যদি ধাক্কা খায়, তাহলে কিন্তু আমাদের বিপদ আছে,” বলেন জাহিদ হোসেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, অর্থবছরের সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) এক হাজার ৫৯৬ কোটি ৭১ লাখ (১৩.৭৭ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ অবস্থানকারী প্রবাসীরা; যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৩ দশমিক ১২ শতাংশ বেশি।