চায়ের টং থেকে শুরু করে পাড়ার মুদি দোকান, কাঁচাবাজার কিংবা বিপনি বিতানের আলো ঝলমলে শোরুম; অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকেই নির্বিঘ্নে কাজ চালিয়ে যেতে চাঁদা দিতে হয়। সরকার, সময়, ক্ষমতা; যারই বদল হোক না কেন, ব্যবসায়ীদের চাঁদা দানে পরিবর্তন আসে না। স্রেফ ধরন বদলায়, মানুষ বদলায়, চাঁদার সীমা বাড়ে।
অনেকটা এভাবেই চাঁদা দেওয়ার অভিজ্ঞতার কথা জানাচ্ছিলেন ঢাকার মোহাম্মদপুরের এক ব্যবসায়ী। তিনি জানালেন, নিজের মালিকানাধীন দোকান থেকেও নিয়মিত চাঁদা দিতে হয় তাকে। ৫ আগস্টের আগে একজনকে দিতেন, এখন অন্যজনকে দিচ্ছেন।
ওই ব্যবসায়ী বলেন, “আন্দোলনের পর শুধু চাঁদাবাজ বদলাইছে, চাঁদাবাজি বন্ধ হয় নাই।”
প্রায় একই ধরনের কথা বললেন মোহাম্মদপুর কাঁচাবাজারের ব্যবসায়ীরাও। তাদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এই বাজার থেকে প্রতিদিন ৬ হাজার টাকা চাঁদা তোলে একটি চক্র।
কাকে চাঁদা দিতে হয় সেই প্রশ্নের জবাবে এক ব্যবসায়ী বলেন, “আগে চাঁদা নিত কাউন্সিলর আসিফের লোকজন। ৫ আগস্টের পর মাসখানিক চাঁদাবাজি বন্ধ ছিল। এরপর থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসী হেলালের কথা বলে চাঁদা নেওয়া শুরু করে বিএনপির লোকজন।
“এই বাজারের চাঁদার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে গত ২৪ সেপ্টেম্বর প্রতিপক্ষের হামলায় মোহাম্মদপুর থানার ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি মান্নান হোসেন শাহীন ও একই ওয়ার্ডের লাউতলা ইউনিটের নেতা মো. রিয়াজ গুরুতর আহতও হন।”
স্থানীয়দের অভিযোগ, শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর বিএনপির নেতা-কর্মীরা জোটবদ্ধ হয়ে মোহাম্মদপুরের বাস স্ট্যান্ড, মার্কেট, ফুটপাথ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক চাঁদাবাজি শুরু করে। এখন ব্যবসায়ীদের ভয় দেখাতে শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হেলালের নাম ব্যবহার করা হচ্ছে।
গত ২৪ সেপ্টেম্বরে হামলার আগে ৬ই সেপ্টেম্বর মান্নান হোসেন শাহীনের নেতৃত্বে ডট ইন্টারনেটের লালমাটিয়ার অফিসে চাঁদা দাবি করতে গিয়ে হুমায়ূন নামে প্রতিষ্ঠানটির এক কর্মচারীকে মারধর করা হয়। সেই ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়ে।
৩৩ নং ওয়ার্ডের কাঁটাসুর এলাকার বাসিন্দা তাজুল ইসলাম বলেন, “গত কিছুদিন ধরে মোহাম্মপুরে ছিনতাইকারী আর ডাকাত নিয়ে সবাই সরব। পুলিশ-র্যাবও কয়েক’শ মানুষকে গ্রেপ্তার করেছে। কিন্তু সবার চোখের সামনে চাঁদাবাজি চললেও সবাই নীরব। মোহাম্মদপুরের ফুটপাত, রাস্তাঘাট, বাজার সবখানেই আগের মতোই চাঁদাবাজি চলছে। চাঁদাবাজরা রাস্তার মধ্যেও দোকান বসিয়ে দিয়েছে। এতে পুরো এলাকায় সারাদিন যানজট লেগেই থাকে।”
মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে তাজুল ইসলামের অভিযোগের সত্যতা মেলে।
বাসস্ট্যান্ড থেকে বেঁড়িবাধ সড়কের অর্ধেকটা জুড়ে বসেছেন ভাসমান দোকানিরা। মাত্র ৫০০ মিটার এলাকায় হাজারেরও বেশি দোকান। এতে প্রশস্ত ওই সড়ক সরু হয়ে পড়েছে, ফলে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত যানজট লেগেই থাকে।
এই দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ভাসমান এসব দোকান থেকে প্রতিদিন ৫০ টাকা থেকে শুরু করে ৪০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করা হয়। সে হিসেবে কেবল এই সড়ক থেকেই প্রতিদিন পাঁচ লাখ চাঁদা তুলে নেওয়া হয়।
যখন দোকানিদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তখনই উত্তর সিটি করপোরেশেনের জ্যাকেট পরে এক কিশোরকে দোকানগুলো থেকে চাঁদা তুলতে দেখা যায়।
এছাড়াও ওই সড়কের কালভার্টের পাশেই সরকারি জায়গায় ৩৩ নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর তারেকুজ্জামন রাজিবের প্রশ্রয়ে কার্যালয় করেছিলেন স্থানীয় ইমারত শ্রমিকরা। কার্যালয়ের পাশাপাশি অবৈধভাবে সেখানে আটটি দোকানও তৈরি করে ভাড়া দেওয়া হয়। মাসে প্রায় ৫০ হাজার টাকা ভাড়া ওঠে এই ভবন থেকে।
জানা গেল, ৫ আগস্টের আগে এসব দোকান থেকে ভাড়া তুলতেন সাবেক কাউন্সিলর আসিফ। গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে ভাড়া নিচ্ছেন ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি মান্নান হোসেন শাহীন। সহযোগী তাজুল হকের মাধ্যমে এসব ভাড়া আদায় করেন তিনি।
এছাড়াও বেঁড়িবাধে ওপর গড়ে ওঠা নার্সারি, অটোরিকশা স্ট্যান্ড থেকেও চাঁদা আদায় করা হয়। এমনকি রাইড শেয়ারিং মোটরসাইকেল চালকদের প্রতি ট্রিপে ১০ টাকা করে দিতে হয়।
২৪ সেপ্টেম্বর হামলায় আহত হওয়ার পর এখনও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকায় এসব অভিযোগের বিষয়ে কথা বলা সম্ভব হয়নি ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি মান্নান হোসেন শাহীনের সঙ্গে।
তবে ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম অপু বিএনপি নেতাকর্মীদের চাঁদাবাজির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “মোহাম্মদপুরের কাঁচা বাজারের দোকানগুলো আমরা দখলমুক্ত করে দিয়েছি। এটা কি আমাদের অপরাধ? বাজারের দোকানদাররাই বলছে, আপনারা দেখেন, আপনারা বাজার পরিচালনা করেন। এরপর যেদিন ওই বাজারে কমিটি দেওয়ার কথা সেদিনই আমাদের সভাপতির ওপর হামলা হয়।”
ওই বাজার থেকে প্রতিদিন ৬-৭ হাজার টাকা চাঁদা ওঠে স্বীকার করে তিনি বলেন, “প্রতিদিন বাজার থেকে ৬-৭ হাজার টাকা ওঠে। এর থেকে প্রতিমাসে ময়লা ফেলার বিল ১৮ হাজার টাকা দিতে হয়। এছাড়া ৫০-৬০ হাজার টাকা বিদ্যুৎ বিল দিতে হয়। এছাড়াও আছে দুজন সিকিউরিটির বেতন, পানির বিলসহ আরও খরচ। যে চাঁদা ওঠে সেটা দিয়ে বাজার পরিচালনার খরচই মেটানো হয়, কোনও ব্যক্তি নেয় না।”
ইমারত শ্রমিকদের দোকান থেকে চাঁদা আদায়ের বিষয়ে জানতে চাইলে অপু বলেন, “কথাটা আমিও শুনেছি । এ বিষয়ে আমি জানি না।”
শীর্ষ সন্ত্রাসী হেলালের নাম ব্যবহারের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এসব মিথ্যা কথা। হেলাল ভাই শীর্ষ সন্ত্রাসী ছিলেন না, তাকে সন্ত্রাসী বানিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। তিনি খুব ভালো ছাত্রনেতা ছিলেন, সাংগঠনিকভাবে ছিলেন খুব শক্তিশালী। এসব কারণে শীর্ষ সন্ত্রাসীর লেবেল লাগিয়ে তাকে রাজনীতি থেকে দূরে সরানোর চেষ্টা করা হয়েছে।”
মোহাম্মদপুরে চাঁদাবাজি কারা করছে সে বিষয়ে জানতে চাইলে অপু বলেন, “অভ্যুথানের সময় যারা ছাত্রদের ওপর হামলায় জড়িত ছিল তারা এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওই হত্যা মামলার আসামিরা আমাদের সভাপতির ওপরও হামলা চালিয়েছে। তারাই এখনও কিশোর গ্যাং লালন-পালন করছে, তারাই চাঁদা তুলছে।”
বিএনপি অরাজকতা পছন্দ করে না জানিয়ে তিনি বলেন, “যেখানেই দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে সেখানেই দলীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এমন অবস্থায় বিএনপির নেতাকর্মীদের চাঁদাবাজিতে জড়ানোর সাহস হবে কীভাবে?”
তারাও চাঁদাবাজি বন্ধ চান জানিয়ে জহিরুল ইসলাম অপু বলেন, এই কাজে যদি প্রশাসন বিএনপির সহায়তা চায় তাহলে তারা সঙ্গে থাকবেন।
চাঁদাবাজির অভিযোগ বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে
চাঁদাবাজি, অনৈতিক কর্মকাণ্ড ও দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে দলের কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী ও তার ছেলে সামির কাদের চৌধুরীকে কারণ দর্শানোর নোটিস দিয়েছে বিএনপি।
এ ছাড়া গিয়াস উদ্দিনের দুই অনুসারী–রাউজান উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল হুদা চেয়ারম্যান ও ফিরোজ আহমেদ মেম্বারকেও একই অভিযোগে আলাদাভাবে শোকজ করা হয়।
মঙ্গলবার বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর সই করা চিঠিতে তাদের তিনদিনের মধ্যে নোটিসের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীকে দেওয়া নোটিসে বলা হয়েছে, “এলাকায় দলমত নির্বিশেষে ধনী ব্যবসায়ীর তালিকা করে কোটি কোটি টাকা চাঁদা আদায়; ওমানে বসবাসরত সিআইপি ব্যবসায়ী ইয়াসিনের কাছ থেকে দেড় কোটি টাকা চাঁদা দাবি, চাঁদা না পেয়ে সন্ত্রাসীদের দিয়ে ইয়াসিনের রাউজানের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া।
“সিআইপি ব্যবসায়ী মো. ফোরকানের কাছে এক কোটি টাকা চাঁদা দাবি করে না পেয়ে সন্ত্রাসীদের দিয়ে ফোরকানকে নির্মম শারীরিক নির্যাতন, আপনার সন্ত্রাসীরা দোকান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বিদেশে অবস্থানরত রাউজানের ব্যবসায়ীদের ওপর ঢালাও চাঁদাবাজির মাধ্যমে এলাকাকে আতঙ্কের জনপদে পরিণত করা ইত্যাদির অভিযোগ জমা হয়েছে।”
নোটিসে আরও বলা হয়, “স্বঘোষিত কমিটি ঘোষণা করার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে আপনি ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে বলেন, ‘রাউজান কমিটি গঠন করতে কারোর প্রয়োজন নেই, আমার এলাকা আমি করব’।”
এ ধরনের বক্তব্য ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নেতৃত্বের প্রতি চরম অনাস্থা ও ধৃষ্টতা বলেও সেখানে উল্লেখ করা হয়।
তবে এ মুহূর্তে গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী দেশের বাইরে থাকায় এ বিষয়ে তার মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
চাঁদাবাজি চলছে সারা দেশেই
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীও জানালেন, সারা দেশে চাঁদাবাজি বেড়ে যাওয়ার কথা।
বুধবার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বৈঠক শেষে তিনি বলেন, “দেশে বাড়তে থাকা চাঁদাবাজি দমনে কঠোর হতে হবে। অপরাধী যেই হোক না কেন, কেউই ছাড় পাবে না।”
ঢাকার বাইরে থেকে আসা পুলিশ সদস্যদের অলিগলি চিনতে সময় লাগবে তাই তাদেরকে একটু সময় দিতেও অনুরোধ করেন তিনি।
চাঁদাবাজি বন্ধে দেশজুড়ে পুলিশের বিশেষ অভিযান চলছে বলে সকাল সন্ধ্যাকে জানিয়েছেন পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর।
তিনি বলেন, “চাঁদাবাজি প্রতিরোধে বিশেষ অভিযান চালানো হচ্ছে। জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে।”