ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতা থেকে উৎখাত হওয়া আওয়ামী লীগ ফিরে আসার চেষ্টা চালাচ্ছে বলে দেশবাসীকে হুঁশিয়ার করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
নিজের অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন পূর্তিতে রবিবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি এই ধরনের ষড়যন্ত্র ঠেকাতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান।
দেড় দশক ধরে ক্ষমতা থাকা আওয়ামী লীগ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে আন্দোলনে ‘ফ্যাসিস্ট’ তকমা নিয়ে বিদায় নেওয়ার তিন দিন পর গত ৮ আগস্ট গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার।
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাশের দেশ ভারতে আশ্রয় নিয়ে আছেন। তার দলের বেশ কয়েকজন নেতাও বিদেশে পালিয়ে আছে।
ভাষণে ড. ইউনূস কারও নাম উল্লেখ না করে বলেন, “এ সরকারকে ব্যর্থ করার জন্য, অকার্যকর করার জন্য বিশাল অর্থে বিশ্বব্যাপী এবং দেশের প্রতিটি স্থানে, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে এক মহাপরিকল্পনা প্রতি মুহূর্তে কার্যকর রয়েছে।
“পতিত সরকারের নেতৃবৃন্দ, যারা এদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করে নিয়ে গেছে, সে অর্থে বলিয়ান হয়ে তারা দেশে ফিরে আসার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে।”
সরকারের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির পাঁয়তারা হচ্ছে দাবি করে তিনি বলেন, “তাদের একটি বড় প্রচেষ্টা হচ্ছে, আমাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা। তাদেরকে কিছুতেই সফল হতে দেবেন না। তারা সফল হওয়া মানে জাতির মৃত্যু। জাতি হিসেবে আমাদের অবসান।”
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে নানা প্রশ্নে অন্তর্বর্তী সরকারের দূরত্ব সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে এই সময়ে ঐক্যবদ্ধ থাকার ওপর জোর দেন ড. ইউনূস।
তিনি বলেন, “সাবধান থাকুন। তাদের সকল হীন প্রচেষ্টাকে আমাদের ঐক্যের মাধ্যমে নস্যাৎ করে দিন।
“যেভাবে নস্যাৎ করেছিলেন, তাদের বন্দুকের গুলিকে। তাদের আয়না ঘরকে। প্রতি পায়ে তাদের অনাচারের শিকলকে। এ ব্যাপারে সবাই একমত থাকুন, ঐক্যবদ্ধ থাকুন।”
মুক্তিযুদ্ধের লাখো শহীদ এবং গত জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে নিহতদের স্মরণ করে ভাষণ শুরু করেন ড. ইউনূস।
শান্তিতে নোবেলজয়ী এই বাংলাদেশি ১০০ দিন আগে যে প্রেক্ষাপটে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন, তা তুলে ধরে বলেন, “আপনারা জানেন, কী কঠিন এক পরিস্থিতিতে আমাদের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়েছে। জুলাই-অগাস্ট বিপ্লবের পর আমরা এমন একটি দেশ হাতে পেয়েছি যার সর্বত্র ছিল বিশৃঙ্খলা।
“ছাত্র-শ্রমিক-জনতার অভূতপূর্ব গণ অভ্যুত্থানের পর ফ্যাসিস্ট সরকার প্রধান পালিয়ে গেলে দেশ সরকার-শূন্য হয় সাময়িকভাবে। পুলিশ প্রশাসন ও এসময় সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়লে উদ্বেগজনক এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। স্বৈরশাসনে বিপর্যস্ত এই দেশকে আমাদের সবাইকে মিলে পুনর্গঠন করতে হচ্ছে।”
ভাষণে ১০০ দিনে সরকারের নেওয়া নানা পদক্ষেপ তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টা। তার অনেকগুলো তুলে ধরে তিনি বলেন, “গত ১০০ দিনে আমরা আরও অনেক কল্যাণমূলক কাজ করেছি, যা এখানে স্বল্প পরিসরে বর্ণনা করা সম্ভব নয়।”
জুলাই অভ্যুত্থানে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বিচারের উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “তার কাজও বেশ ভালোভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনাকেও আমরা ভারত থেকে ফেরত চাইব।”
এই অভ্যুত্থানে প্রতিটি মৃত্যুর তথ্য জোগাড় করা হচ্ছে জানানোর পাশাপাশি আহত ১৯ হাজার ৯৩১ জনের জন্য ঢাকার ১৩টি হাসপাতালসহ বিভিন্ন বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
আওয়ামী লীগের গত ১৫ বছরের সব অপকর্মের বিচারের ঘোষণা দিয়ে ড. ইউনূস বলেন, “অসংখ্য মানুষ গুম হয়েছে, খুন হয়েছে এই সময়ে। আমরা গুমের তদন্তে একটি কমিশন গঠন করেছি। কমিশন প্রধান আমাকে জানিয়েছেন অক্টোবর পর্যন্ত তারা ১,৬০০ গুমের তথ্য পেয়েছেন। তাদের ধারণা, এই সংখ্যা ৩,৫০০ ছাড়িয়ে যাবে।
“অনেকেই কমিশনের কাছে গুমের অভিযোগ করতে ভয় পাচ্ছেন এই ভেবে যে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দ্বারা তারা আবার আক্রান্ত হতে পারেন, ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। আমি আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই, আপনারা দ্বিধাহীন চিত্তে কমিশনকে আপনাদের অভিযোগ জানান। কারও সাধ্য নেই, আপনাদের গায়ে আবার হাত দেয়।”
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর হিন্দু নির্যাতনের অতিরঞ্জিত তথ্য ছড়ানো হয়েছে দাবি বরে তিনি বলেন, “কয়েকটি ক্ষেত্রে তারা সহিংসতারও শিকার হয়েছেন। কিন্তু এটা নিয়ে যে সব প্রচার-প্রচারণা হয়েছে, তা ছিল সম্পূর্ণ অতিরঞ্জিত।
“অল্প যেসমস্ত সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, তার মূল কারণ ছিল রাজনৈতিক। কিন্তু এসব ঘটনাকে ধর্মীয় আবরণ দিয়ে বাংলাদেশকে নতুন করে অস্থিতিশীল করে তোলার চেষ্টা হয়েছে। শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ই নয়, দেশের কোনও মানুষই যাতে কোনও রকম সহিংসতার শিকার না হয়, সেজন্য আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি এবং সব সময় সে চেষ্টা করে যেতে থাকব।”
বর্তমান সরকার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতে কাজ করে যাচ্ছে দাবি করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আমি তাই সরকারের সকল মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছি, তাদের নিজ নিজ কাজের বিস্তারিত বিবরণ নিজেদের ওয়েবসাইট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করার জন্য।
“আমি আমার দপ্তরকেও বলেছি, সরকারের সব কাজের বিবরণ যাতে জনগণ জানতে পারে এজন্য যেন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়।”
সরকারি কার্যক্রমকে গতিশীল করতে বিভিন্ন পর্যায়ের ১৯ হাজার ৮৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে পদোন্নতি, ১৩ হাজার ৪২৯ জনকে বদলি এবং ১২ হাজার ৬৩৬ জনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানান প্রধান উপদেষ্টা।
দৈনন্দিন কাজ পরিচালনার পাশাপাশি ভবিষ্যতের বাংলাদেশ বিনির্মাণে সংস্কারের কাজও সরকার গুরুত্ব দিয়ে করছে বলে জানান ড. ইউনূস।
সংস্কারের পর নির্বাচনের আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেন, “নির্বাচনের কথা বলার সঙ্গে নির্বাচন ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সংস্কারের কথাটিও বলুন। সংস্কার হলো জাতির দীর্ঘ মেয়াদি জীবনী শক্তি।”
সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন পাওয়ার পরপরই নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করবেন জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, “আমি নিশ্চিত নই, সংস্কার প্রস্তাবসমূহ বাস্তবায়নের সুযোগ আমরা কতটুকু পাব। তবে আমি আপনাদের কথা দিচ্ছি, আপনারা সুযোগ দিলে প্রয়োজনীয় কিছু অত্যাবশ্যকীয় সংস্কার কাজ শেষ করেই আমরা আপনাদের কাঙ্ক্ষিত নির্বাচন আয়োজন করব। ততদিন পর্যন্ত আমি আপনাদের ধৈর্য ধারণ করার অনুরোধ করব।”