নায়ক নির্ভর সিনেমার জমজমাট বাজার হয়েই টিকে আছে বলিউড। এমন ধারা থেকে হালে বেরিয়ে এসে নারী কেন্দ্রিক চরিত্রে সিনেমা বানিয়ে সমালোচকদেরও সাধুবাদ কুড়িয়ে নিচ্ছে হিন্দি সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি।
টাইমস অব ইন্ডিয়া বলছে, ২০২৪ সালে নারী কেন্দ্রিক সিনেমার অনেক উদাহরণ দেখাতে পেরেছে বলিউড।
কারিনা কাপুর খান, টাবু এবং কৃতি শ্যানন এক জোট হয়েছিলেন দ্য ক্রু সিনেমায়। লাপাতা লেডিস সিনেমায় ছিলেন নবাগতা নিতানশি গোয়াল এবং প্রতিভা রত্না।
নায়িকারা প্রমাণ করেছেন নায়ক নির্ভর সিনেমার মতো দারুণ না হলেও বক্সঅফিসে ভালোই আয় এনে দিতে পারেন তারা।
এরমধ্যে বলিউডের তালিকায় আছে আলিয়া ভাটের জিগরা এবং আলফা । অন্যদিকে কঙ্গনা রানাউতের ইমার্জেন্সি । এমন সিনেমা শুধু নায়িকা প্রধানই নয়, নারী চরিত্রে আছে আলাদা মাত্রার গুরুত্ব।
নায়ক নির্ভর সিনেমার ছক ভেঙ্গে নারীর মুখ্য ও ক্ষুরধার চরিত্রকে ঘিরে সিনেমা যেন নতুন যুগের সূচনা করেছে বলিউডে।
দশকের পর দশক ধরে হিন্দি সিনেমাতে প্রেমের দৃশ্য, পার্শ্বচরিত্র নয়তো বিপদের মুখে নায়কের হাতে উদ্ধার হওয়া অবলা নায়িকা চরিত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল নারী।
যদিও এরমধ্যেও কিছু ব্যতিক্রম হয়ে এসেছে মাদার ইন্ডিয়া, আর্থ, বন্দিনী এবং সুজাতা । এসব উদাহরণের বাইরে নারীকে সাধারণত দ্বিতীয় সারির চরিত্র করে রেখেছিল বলিউড।
হালে আগের ধারণা চ্যালেঞ্জ করে নারী চরিত্রকে ভেবেই সিনেমার কাহিনী সাজানো হচ্ছে।
বিদ্যা বালানকে দিয়ে সিনেমায় নারী চরিত্রের উপর ভরসা করার দিন ফিরে আসে। কাহানি, ইশকিয়া, দ্যা ডার্টি পিকচার, পা, নো ওয়ান কিলড জেসিকা নিয়ে বিদ্যা বালান তখন একের পর এক হিট সিনেমা দিয়ে চলেছেন।
তিন নারীর পেশাগত ও ব্যক্তিগত জীবনের অধ্যায় নিয়ে দ্য ক্রু এই ধারায় আরও একবার সফলতার পালক যোগ করে। বন্ধুত্ব, উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং সহনশীলতার গল্পে দর্শক খুঁজে পেয়েছে এমন এক সিনেমা যা তাদের আত্মবিশ্বাস, দুর্বলতা এবং জটিলতার কথা তুলে ধরতে পারে।
দ্য বাকিংহাম মার্ডারস সিনেমাতেও কারিনা কাপুর মুখ্য চরিত্রে কাজ করেছেন। এই সিনেমা বক্সঅফিসে নিজের অবস্থান ধরে রেখেছে।
বক্সঅফিস বিশ্লেষক তারান আদার্শ অবশ্য মনে করেন, নারীকেন্দ্রিক সিনেমা সবসময়ই হয়ে এসেছে বলিউডে।
“আমি শুধু মাদার ইন্ডিয়া বা বন্দিনী সিনেমার কথা বলছি না। মুঘল-ই-আজম সিনেমাও তো আনারকলি ছাড়া অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। তবে ৭০ এবং ৮০ এর দশকে মারপিট নির্ভর সিনেমা শুরু হলে তখন নায়িকাদের শুধু গ্ল্যামার এবং গানের জন্যই নেয়া হতো।”
“আমাদের নায়িকা প্রধান সিনেমা এরপরেও এসেছে। তবে ২০২৪ সালে এমন একাধিক সিনেমা দেখা গেছে, আর এসব সিনেমা বক্সঅফিসেও ভালো ব্যবসা করেছে।”
কিন্তু সিনেমা নায়ক না নায়িকা প্রধান তাতে কিছু আসে যায় না, বললেন তারান আদার্শ।
“সিনেমার গল্প দর্শকের কাছে পৌঁছাতে হবে। আমাদের নায়িকা, নারী পরিচালক, নারী গল্পকারদের সঙ্গে কাজ করতে হবে। আমার এবারের পছন্দের সিনেমা হলো লাপাতা লেডিস । আমি তো নির্মাতাদের বলেছি, তাদের এই সিনেমা আরও একবার হলে মুক্তি দেয়া উচিত। এতে শুধু নায়িকারা মূল চরিত্রে কাজ করেছে তা তো নয়, সিনেমার নির্মাণেও ছিলেন নারী পরিচালক কিরণ রাও।”
নারী পরিচালকের নির্মাণে লাপাতা লেডিস সিনেমা একটি ছোট শহরে দুই নারীর জীবনযুদ্ধের গল্প বলেছে। দুজন নতুন মুখ নির্ভর এই সিনেমা বলছে, এই ইন্ডাস্ট্রি নারীর কাজের প্রতিভাকে মন খুলে স্বাগত জানাতে উদার হচ্ছে।
প্রেমের সিনেমায় নারী চরিত্রের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও এখন মারপিট, থ্রিলার, সামাজিক বার্তা দেয়া সিনেমাতেও নারীই থাকছে মুখ্য চরিত্রে।
ইয়ামি গৌতমের আর্টিকেল ৩৭০ সিনেমার কাহিনী ছিল রাজনীতির মারপ্যাঁচ নিয়ে। এতে ইয়ামি গৌতম মুখ্য চরিত্রে সাহসী অভিনয় করেছেন। তখনই অনেকের উপলব্ধি হয়, নারী মানে পারিবারিক ও রোমান্টিক সিনেমাই শেষ কথা নয়; নারী কেন্দ্রিয় চরিত্রেও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে।
হাসিন দিলরুবা সিনেমার সিক্যুয়েল ফির আয়ি হাসিন দিলরুবা নিয়ে তাপসী পানু রহস্য ও রোমান্সের অসামান্য মিশ্রণ ঘটিয়ে দেখিয়েছেন। বড় পর্দায় শুধু গ্ল্যামার দেখানোর চেয়ে, দর্শকের কাছে জটিল চরিত্রে অসামান্য অভিনয় করা নায়িকার চাহিদাই বরং বেশি প্রমাণিত হয় এবার।
শর্বরী ওয়াগ বেদা এনে দেখালেন অ্যাকশন সিনেমাতেও নারী মুখ্য চরিত্রে কাঁপিয়ে দিতে পারে। আগে এমন চরিত্র নায়কদের দখলে থাকলেও এবার বলিউড সরাসরি নায়িকাদেরই চাইছে অ্যাকশন চরিত্রে। শর্বরী ওয়াগ নিজেও প্রমাণ করেছেন পুরনো ছক ভেঙ্গে অন্তরঙ্গ, বিতর্কিত, চ্যালেঞ্জিং যে কোনো চরিত্রে কাজ করতে আজকের নায়িকারা একেবারেই প্রস্তুত। আদিত্য চোপড়ার স্পাই ইউনিভার্স আলফা সিনেমায় আলিয়া ভাটের সঙ্গে দেখা যাবে শর্ববীকেও।
আলিয়া ভাট বলিউডে সব সময় ভিন্ন রকম সিনেমায় কাজ করেই এগিয়ে এসেছেন। তার অভিনীত রাজি, ডার্লিং, গাঙ্গুবাই কাঠিয়াওয়াড়ি, জিগরা একের পর এক সে কথাই প্রমাণ করে চলেছে।
গাঙ্গুবাই কাঠিয়াওয়াড়ি সিনেমা পুরোটাই নিজের কাঁধে টেনে নিয়ে বক্সঅফিস মাতিয়েছেন আলিয়া ভাট।
ইমার্জেন্সি সিনেমার পরিচালকও কঙ্গনা রানাউত। ইন্দিরা গান্ধীর জীবনীভিত্তিক এই সিনেমায় রাজনীতির সঙ্গে নারীর ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের বার্তাও উঠে এসেছে। একাধিক সিনেমার হিট নায়িকা কঙ্গনা রানাউত ইন্দিরা গান্ধী হয়েছেন ইমার্জেন্সি সিনেমায়।
সবিতা ধুলিপালা অভিনীত লাভ সিতারা, অঞ্জিনী ধাওয়ানের বিনি অ্যান্ড ফ্যামিলি সিনেমা নারীকে আরও নানাভাবে মুখ্য চরিত্রে তুলে এনেছে। ধুলিপালা সাধারণত আধুনিক ভালোবাসা ও সম্পর্কের কাহিনী বেছে নেন। আর ধাওয়ানের অভিষেক হয়েছে নারীবাদী বার্তা নির্ভর চরিত্রে। এভাবেই চোখে পড়ছে বলিউডের দিন বদলের পালা।
টিসকা চোপড়া একসময় নিয়মিত কাজ করতেন পর্দায়। তার নতুন পরিচিতি ঘটেছে লেখক হিসাবে।
বলিউডের এই বদল নিয়ে তিনি বলেন, “সত্যি বলতে, নারী চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে কাহিনী লেখায় আরও গভীরতা দরকার।
“যত বেশি নারী লেখা শুরু করতে পরিবর্তনও তত হবে। অবলা, দুর্বল, গ্লানি বয়ে চলা চরিত্রেই নারীকে আটকে রাখা হতো। আমি এসবে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। আমি তো এমন চরিত্র নির্মাণ ও অভিনয় না করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতাম। কারণ এতে করে বিনির্মাণ হয়ে ওঠে না।”
পর্দার বাইরেও এখনও নারী নির্ভর সিনেমার জন্য উদ্যোগ নিতে এগিয়ে আসছেন অনেকে। প্রযোজকরাও এমন সিনেমায় লগ্নি করতে চাইছেন আজকাল। দর্শকরা সিনেমায় নায়ক ও নায়িকাকে সমানে সমান দেখতেও আগ্রহী হচ্ছে।
নারী পরিচালক মেঘনা গুলজার, জোয়া আখতার এবং কিরণ রাও সিনেমায় নারীকে সামনে আনতে একেবারে সিদ্ধহস্ত। করণ জোহর কল মি বে নামে একটি ওয়েব সিরিজ করেছেন, যেখানে আছেন অনন্যা পান্ডে। পরিচালনা করেছেন ঈশিতা মৈত্র। গল্প লিখেছেন কণিকা ধীলন।
এই কণিকা ধীলন আবার প্রযোজক হয়ে এসেছেন কৃতি শ্যানন ও কাজলকে নিয়ে নির্মিত দো পাত্তি সিনেমায়।
তবে শুধু নারী নির্ভর সিনেমা নির্মাণ করলেই হবে না, নায়ক প্রধান সিনেমার মতো এসব সিনেমার বেলাতেও প্রচারণায় শতভাগ মনোযোগ দিতে হবে; এমন কথায় উপসংহার টেনেছে টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদন।