রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ঢেউ লেগেছে সংস্কৃতি অঙ্গনেও। বিভিন্ন কমিটি পুনর্গঠন হচ্ছে; তার ধারায় পুনর্গঠিত হলো পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র অনুদান কমিটিও।
তবে চলচ্চিত্রে অনুদান দেওয়ার নীতিমালা না বদলালে শুধু ব্যক্তি বদলে এক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যাবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ী এই অঙ্গনের ব্যক্তিরাও।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর শিল্পী কল্যাণ ট্রাস্ট বোর্ড, চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের জুরি বোর্ড পুনর্গঠন হয়।
সোমবার তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় থেকে ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র অনুদান কমিটি’ পুনর্গঠনের প্রজ্ঞাপন আসে।
কমিটির সদস্যরা হলেন- তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএফডিসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার এন্ড পারফরম্যান্স স্টাডিস বিভাগের শিক্ষক ও অভিনেতা-নির্দেশক ড. আবুল বাশার মো. জিয়াউল হক (তিতাস জিয়া), চলচ্চিত্র নির্মাতা ও প্রযোজক খান শারফুদ্দীন মোহাম্মদ আকরাম (আকরাম খান), চলচ্চিত্র নির্মাতা ও চিত্রনাট্যকার নার্গিস আখতার, রেইনবো চলচ্চিত্র সংসদের সভাপতি আহমেদ মুজতবা জামাল, নির্মাতা ও সম্পাদক সামির আহমেদ এবং অভিনেত্রী জাকিয়া বারী মম। কমিটির সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (চলচ্চিত্র)।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, চলচ্চিত্র শিল্পে মেধা ও সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করা এবং বাংলাদেশের আবহমান সংস্কৃতি সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও সহায়তা প্রদানের উদ্দেশে ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য’ চলচ্চিত্র নির্মাণে সরকারি অনুদান প্রদান নীতিমালা-২০২০ (সংশোধিত) অনুযায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরকারি অনুদান প্রদানের লক্ষ্যে প্রাপ্ত প্যাকেজ প্রস্তাবসমূহ পরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত প্রদানের জন্য সরকার ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র অনুদান কমিটি’ পুনর্গঠন করল।
দীর্ঘদিন ধরেই চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা অনুদান প্রক্রিয়ায় দলীয়করণ ও প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ জানিয়ে আসছিল। দাবি উঠছিল অনুদান প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ করার।
এমন প্রেক্ষাপটে এই পরিবর্তন অনুদান দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ফেরাতে পারবে কি না, এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে দায়িত্বপ্রাপ্তদের।
পুনর্গঠিত কমিটিতে স্থান পাওয়াদের একজন আকরাম খান। এর আগে দুটি চলচ্চিত্রে অনুদান পেয়েছিলেন তিনি। একটি ১৯৪৭ সালের ভারত ভাগ নিয়ে নির্মিত ‘খাঁচা’, অন্যটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ‘নকশী কাঁথার জমিন’। এবার কমিটিতে স্থান নিয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিতের কথাই বললেন তিনি।
আকরাম খান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “চলচ্চিত্র সংস্কৃতির উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারব, এটা ভেবে ভালো লাগছে। দেশের জনগণের কাছে দায়বদ্ধতা অনুভব করছি। এতটুকু নিশ্চয়তা দিতে পারছি যে সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা নিশ্চিতে কাজ করব।”
অনুদানের চলচ্চিত্র নির্বাচনের শিল্পসম্মত, কারিগরি দিক থেকে মানোত্তীর্ণ চলচ্চিত্রকেই প্রাধান্য দেওয়ার কথা বলেন তিনি।
আকরাম আরও বলেন, “কোনোভাবেই তদবির বা অন্য কারও কোনও প্রভাবে চলচ্চিত্রকে অনুদান দেব না। চেষ্টা করব পরিপূর্ণরূপে মেধার ভিত্তিতেই অনুদান নিশ্চিত করতে।
“একটা স্বাধীন ফিল্ম কমিটির অধীনে কিভাবে চলচ্চিত্রের অনুদান কমিটিকে নিয়ে আসা যায়, প্রক্রিয়াটির সংস্কার করা যায়, সেটাও চেষ্টা করব।”
নতুন কমিটির সর্বকনিষ্ঠ সদস্য অভিনেত্রী জাকিয়া বারী মম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “চেষ্টা থাকবে দেশের চলচ্চিত্রের উন্নয়নে সঠিকভাবে কাজটি করার।”
“তবে কাজের প্রক্রিয়াটা একটু বুঝে উঠতে চাই আগে। তারপর চেষ্টা করব দায়িত্বের সাথে নিজের ভূমিকাটি পালন করতে,” বলেন নাট্যতত্ত্বের সাবেক এই শিক্ষার্থী।
নতুন কমিটিতে স্থান পাওয়া সংস্কৃতি অঙ্গনের প্রতিটি ব্যক্তিত্বই ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনের বিরুদ্ধে সরব ছিলেন।
রাষ্ট্র সংস্কারের ধারায় চলচ্চিত্রাঙ্গনেও সংস্কার আনার কথা তারা বললেও বর্তমান প্রক্রিয়ায় তা কতটুকু সম্ভব, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক বেলায়াত হোসেন মামুনের।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, চলচ্চিত্রে অনুদান দেওয়ার দাবিটি উঠেছিল চলচ্চিত্রের গুণগত বিকাশের জন্য, কিন্তু বহু বছর ধরেই চলচ্চিত্র অনুদানটা চলচ্চিত্র বিকাশের জন্য থাকেনি৷ এটা ভুল পথে চলেছে।
মামুনের মতে, চলচ্চিত্র অনুদান দেওয়ার জন্য সরকার যে নীতিমালা করেছিল, সেই নীতিমালাটাই বরং অনুদানে গুণগত মানের চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রতিবন্ধক৷ ওই নীতিমালা দুটিতে (স্বল্পদৈর্ঘ্য ও পূর্ণদৈর্ঘ্য) যে প্রক্রিয়ায় অনুদানের আবেদন ও অনুদান প্রদানের শর্তাবলি আছে, তা গুণগত চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য সঠিক নয়৷
“এর বাইরে অনুদান কমিটিতে যে বা যারাই চিত্রনাট্য বাছাই ও অনুদান প্রদানের কমিটিতে আসুক না কেন, তাতে খুব বেশি প্রভাব রাখার সুযোগ নেই।”
চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট এসব কমিটিতে আমলাদের আধিক্য নিয়ে অন্য আরও ানেকের মতো প্রশ্ন তুলেছেন মামুনও।
“চলচ্চিত্র বিষয়ক অন্য সব কমিটির মতো এই অনুদান কমিটিতেও আমলারাই সংখ্যায় বেশি৷ শুধু তাই নয়, কমিটিগুলোর প্রধানরাও আমলা৷ ফলে এই কমিটি দ্বারা সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বচ্ছভাবে অনুদান প্রদানের কার্যাবলী সম্পন্ন হবে—এটা মনে করার দৃশ্যত কোনও কারণ দেখছি না৷ কারণ, নীতিমালা এবং কমিটি গঠনের যে ফ্রেম, তা আগের মতোই আছে৷ কিছুই তো বদলায়নি।”