চালের প্রধান সরবরাহকারী জেলা নওগাঁ ও কুষ্টিয়ায় মিনিকেট ও নাজিরশাইল চালের দাম কিছুটা বেড়েছে। তবে সেদ্ধ চাল ও পাইজামের দাম আগের মতোই রয়েছে।
চালকল মালিকরা বলছেন, বাংলামতি ও কাটারি ধানের মজুত শেষ হয়ে আসছে। আগামী চৈত্র মাস নাগাদ আবার এই ফসল উঠলে নতুন চাল বাজারে আসবে। তার আগ পর্যন্ত সরু চাল কিছুটা বেশি দামেই খেতে হবে।
নওগাঁ ও কুষ্টিয়া এলাকার চালকল মালিকরা পাইকারি দরে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চাল পাঠান। বর্তমানে এই এলাকাগুলো থেকে ঢাকায় ব্রি ২৮ ধানের আঠাশ চালের ৫০ কেজির বস্তা পৌঁছানোর খরচসহ পাইকারি দাম পড়ছে ২৫০০ টাকা। অর্থাৎ কেজি প্রতি আঠাশ সিদ্ধ চালের দাম ৫০ টাকা।
চিকন ও মাঝারি আকারের চালের চাহিদা বিগত মৌসুমের তুলনায় কয়েক গুণ বেড়ে যাওয়ায় ঈদের আগে ও পরে কয়েক দফায় প্রতি কেজি চালের দাম নওগাঁ মোকামে ২-৬ টাকা বেড়েছে। গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে পাইকারি পর্যায়ে মানভেদে প্রতি কেজি চালের দাম ২-৩ টাকা বেড়েছে।
ঢাকার নয়া পল্টনের এ টু জেড সদাইপাতি নামের একটি দোকানের মালিক মো. চমনের দোকানে গিয়ে দেখা যায়, সপ্তাহ খানেকের ব্যবধানে সব ধরনের চালের দামই ২-৪ টাকা বেড়েছে।
মুদি দোকানি চমন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, তাদের পক্ষে পাইকারি বাজারে গিয়ে চাল আনা সম্ভবপর হয় না। বিভিন্ন এজেন্ট তাদের চাল দিয়ে যায়। এজেন্টরাই সব ধরনের চালের দাম বাড়িয়েছে।
পুরান ঢাকার বাদামতলী ও বাবুবাজার চাল আড়ৎ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. নিজাম উদ্দিন জানান, নওগাঁ ও কুষ্টিয়ার মোকামে চালের দাম বাড়লেও তার প্রভাব এখনও রাজধানীতে পড়েনি।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমরাও পত্রিকা মারফত জেনেছি, নওগাঁ ও কুষ্টিয়ায় চালের দাম কিছুটা বাড়তি। তবে ঢাকায় আমাদের সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে এখনও চালের পাইকারি দাম বাড়েনি। কারণ আমাদের গোডাউনগুলোতে এখনও চাল মজুদ আছে।”
তবে এই মজুদ শেষ হলে নতুন চালান যখন আসবে, তখন চালের দাম বেড়ে যাবে বলে স্বীকার করেন তিনি।
নিজাম বলেন, “কারণ বিভিন্ন এলাকায় বন্যা ও অতিবৃষ্টির কারণে চালের সরবরাহ ঘাটতি দেখা দিয়েছ, পরিবহন ব্যয় বেড়েছে। ঢাকায় যেসব আড়ৎদারদের চাল শেষ হয়েছে বা কমে আসছে, তারা ৫০ পয়সা থেকে ১ টাকা পর্যন্ত কেজিতে চালের দাম বাড়াতে শুরু করেছে।”
সরু চালের দাম বাড়লেও মোটা চালের দাম আগের মতোই রয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ অটোমেটিক রাইস মিল মালিক সমিতির (কুষ্টিয়া শাখা) সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মাসুদ রানা।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, মোটা চালের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। সাধারণ মানুষ মোটা চাল খায়। তাদের চাল কম দামেই পাওয়া যাবে। স্বচ্ছল মানুষরা চিকন চালের ভাত খেতে পছন্দ করে। এই চিকন চালের দাম এখন কিছুটা বেশি।
এর কারণ হিসেবে কুষ্টিয়ার মাতৃভান্ডার অটো রাইস মিলের এই মালিক বলেন, বাসমতি ও কাটারি ধান থেকে চিকন চাল করা হয়। এই ধানের মজুত শেষ হয়ে আসছে। কোরবানির ঈদের পর থেকেই বস্তা প্রতি ১০০-১৫০ টাকা ধানের দাম বেড়েছে। এ কারণে চালের দামও (৫০ কেজি) বস্তায় ১৫০-২০০ টাকা বেড়েছে।
বাংলাদেশের প্রধান খাদ্য ভাত বলে চালের বাজার অনেক বড়। দেশের সব জেলাতেই চালকল রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে নওগাঁয়, দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে কুষ্টিয়া।
নওগাঁর সরবরাহকারীরা মিনিকেট পাইকারিতে প্রতিকেজি ৬৩ টাকা করে বিক্রি করছেন। স্পেশাল নাজির চাল পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ৬৭ টাকা কেজি। পাইজামের পাইকারি দাম ৫৩ টাকা।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার ঢাকায় প্রতিকেজি মধ্যম মানের সিদ্ধ চালের (ব্রি ধান-২৮, ব্রি ধান-২৯, বিআর-২৩) পাইকারি মূল্য ছিল ৫১-৫২ টাকা। এ ধরনের চালের খুচরা মূল্য ছিল প্রতিকেজি ৫৫-৫৮ টাকা।
বড় কোম্পানিগুলো নানা ধরনের চাল মোড়কজাত করে বাজারে ছাড়ছে। তাদের চালের দাম কেজিতে প্রতি ৫-১০ টাকা বেশি।
এদিকে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যে বলা হচ্ছে, শুক্রবার ঢাকায় খুচরা পর্যায়ে চিকন বা সরু চালের (মিনিকেট, নাজির) বাজারদর সর্বনিম্ন ৬০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ৭৮ টাকা প্রতি কেজি। মাঝারি চাল (পাইজাম) সর্বনিম্ন ৫২ টাকা, সর্বোচ্চ ৫৮ টাকা কেজি। মোটা চাল (স্বর্ণা, চায়না ইরি) সর্বনিম্ন ৪৮ টাকা এবং সর্বোচ্চ ৫২ টাকা কেজি।
গত এক মাসের মধ্যে ঢাকায় চালের দামে কোনও পার্থক্য আসেনি বলে জানানো হয় টিসিবির ওই তথ্যে। বরং মোটা চালের সর্বোচ্চ দাম কিছুটা কমেছে। এক মাস আগে মোটা চালের সর্বোচ্চ দাম ছিল ৫৪ টাকা কেজি।
কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশে চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ কোটি ৭৭ লাখ টন। এর বিপরীতে চালের উৎপাদন ছিল ৪ কোটি ১৩ লাখ টন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, দেশে মাথাপিছু দৈনিক চাল গ্রহণের পরিমাণ ৩২৮ দশমিক ৯ গ্রাম। শুধু ভাত হিসেবে এ চাল মানুষ গ্রহণ করে। এর বাইরে বিভিন্ন পোলট্রি ফিড, বীজসহ অন্যান্য প্রয়োজনে চাল ব্যবহার হয় ১ কোটি টন। সব মিলে প্রয়োজন ৩ কোটি ৬০ লাখ টন। কিন্তু গত বছরে উৎপাদন হয়েছে ৪ কোটি ১৩ লাখ টন।
নওগাঁর আড়তে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, বর্তমানে পাইকারি পর্যায়ে মানভেদে প্রতি কেজি চালের দাম ২-৬ টাকা বেড়ে স্বর্ণা-৫ জাতের চাল ৫১-৫২ টাকা, ব্রি আর-২৮ ও ২৯ জাত ৫৩-৫৫ টাকা, সুভলতা ৫৭-৫৮ টাকা, জিরাশাইল ৬২-৬৩ টাকা এবং কাটারিভোগ ৬১-৬৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
দুই সপ্তাহ আগে এই মোকামে মানভেদে প্রতি কেজি স্বর্ণা-৫ জাতের চাল ৪৯-৫০ টাকা, ব্রি আর-২৮ ও ২৯ জাতের ৫২ টাকা, সুভলতা ৫১-৫২ টাকা, জিরাশাইল ৫৯-৬০ টাকা এবং কাটারীভোগ ৫৯-৬২ টাকা করে বিক্রি হয়েছে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে নওগাঁ জেলা চালকল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার বলেন, দেশে ধানের দাম ছিল ১ হাজার ১০০ টাকা থেকে ১ হাজার ১৫০ টাকা মণ। সেই ধানের দাম বৃদ্ধি পেয়ে এখন ১৪০০ থেকে সাড়ে ১৪০০ টাকা মণে বিক্রি হচ্ছে। “স্বাভাবিকভাবে ধানের দাম বৃদ্ধি পেলে সেখান থেকে চাল উৎপাদন করলে দাম একটু বৃদ্ধি পাবে। এই হিসাবে চাল প্রতি দুই টাকা করে বৃদ্ধি পেয়েছে।”
এরসঙ্গে আবহাওয়াকে কারণ দেখিয়ে তিনি বলেন, বর্ষায় মিলগুলো চাহিদা অনুযায়ী চাল উৎপাদন করতে পাচ্ছে না, এ কারণেও বাজারে কিছুটা সংকট দেখা দিয়েছে।
[প্রতিবেদনটি তৈরিতে সাহায্য করেছেন সকাল সন্ধ্যার বগুড়া প্রতিনিধি আসাফ-উদ-দৌলা নিওন]