আহ্বান ছিল, ছিল হুঁশিয়ারিও; কিন্তু কান দিল না কেউ, তাতে কান হয়েছে ঝালাপালা; তাতেই শেষ নয়, আতঙ্কের রাত কাটিয়ে ভোর দেখতে হয়েছে অনেককে, বিশেষ করে বৃদ্ধ ও শিশুদের। আর অবোধ প্রাণীরা বুঝতে পারেনি, বুদ্ধিমান মানুষ কেন তাদের মনে এত ভয় ধরাচ্ছে!
বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকায় খ্রিস্টীয় নতুন বছর ২০২৫ বরণের আয়োজন এমন পরিবেশ নিয়ে এসেছিল মঙ্গলবার রাতে; যাকে কেউ কেউ বলেছেন ‘অমানবিক উচ্ছ্বাস’।
আগের অভিজ্ঞতায় এবার আতশবাজি, পটকা ফোটানো এবং ফানুস ওড়ানোতে নিষেধাজ্ঞা ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে। এমন প্রবণতা এড়াতে পরিবেশ মন্ত্রণালয় হুঁশিয়ারিও দিয়েছিল মোবাইল কোর্ট পরিচালনার। মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষও অনুরোধ জানিয়েছে ফানুস না ওড়াতে। সোশাল মিডিয়ায়ও চলেছিল আবেদন-নিবেদন।
কিন্তু তার সবই হারিয়ে গেল উদযাপনের ডামাডোলে। রাত ১২টার আগে থেকেই আকাশ লাল হতে শুরু করে, বিকট শব্দে ফুটতে থাকে পটকা। তাতে ঘরে থেকেও কান চেপে ধরতে হয়েছে, ভোর অবধি চলতে থাকায় বারবার ঘুমও ভেঙেছে।
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) অনুরোধ জানিয়েছিল ফানুস না ওড়াতে। কারণ তা মেট্রোর বৈদ্যুতিক লাইনে আটকে গতবারও চলাচল বিঘ্নিত করেছিল। এবার ফানুস তুলনামূলক কম উড়লেও মেট্রোরেলের লাইনে ঠিকই এসে পড়েছিল নয়টি। তবে কর্তৃপক্ষের সতর্কতার কারণে বড় কোনও দুর্ঘটনা ঘটেনি।
এখানে বড় দূর্ঘটনা না ঘটলেও পটকা ও আতশবাজি পোড়ানোর সময় দগ্ধ হয়েছে পাঁচজন। তাদের মধ্যে তিনটি শিশু। রাতেই তাদের নেওয়া হয় ঢাকার জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। তাদের একজনের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় ভর্তি করাতে হয়েছে হাসপাতালে।
ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক ডা. শাওন বিন রহমান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, শিফান মল্লিক নামের ১২ বছরের এক শিশুর এবং ২০ বছরের সম্রাটের দেহের এক শতাংশ করে, ৪৩ বছরের শান্ত আর তিন বছরের তাফসিরে দুই শতাংশ করে পুড়েছে। সবচেয়ে বেশি দগ্ধ হয়েছে আট বছরের ফারহানের। শরীরের ১৫ শতাংশে আগুনের ক্ষত নিয়ে তাকে ভর্তি হতে হয়েছে হাসপাতালে।
ডা. শাওন জানান, হাসপাতালে আসা সবাই ঢাকার বিভিন্ন জায়গা থেকে এসেছে। তাদের মধ্যে ফারহান ছাড়া সবাইকে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি পাঠানো হয়।
আতশবাজি আর পটকার বিকট শব্দে শিশুদের কষ্ট দেখে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন গণমাধ্যমকর্মী মনিরুল ইসলাম।
তিনি নিজের দুই বছরের মেয়ের দিকে তাকিয়ে তিনি ফেইসবুকে লিখেছেন, “যেসব অবুঝের দল বোঝেন না আতশবাজিতে বাচ্চারা ক্যামনে কেঁপে ওঠে, তারা আমার বাসায় আসতে পারেন।
“আমার মেয়ের বয়স দুই এবং ও এক একটা শব্দের পর চিৎকার করে পালানোর জায়গা খুঁজতেছে। যেসব বাচ্চার বয়স দুই/তিন মাস, তাদের অবস্থা কী হয় বলতে পারেন? ওরা তো চিৎকার করাতে পারে না, বলতেও পারে না, দৌড় দিতেও পারে না।”
বাতিঘর সাংস্কৃতিক বিদ্যালয়ের পরিচালক তামান্না সেতু তার সাত বছরের ছেলে সহজ স্বপ্নের কথা লিখেছেন ফেইসবুকে। পরে সকাল সন্ধ্যাকেও জানান পেরিয়ে আসা রাতের অভিজ্ঞতা।
“সহজ স্বপ্ন এডিএইচডিতে আক্রান্ত। যে কোনও শব্দে সে মারাত্মক হাইপার হয়ে যায়,” বলেন সেতু।
৩১ ডিসেম্বর রাতে কেন এই বাজি ফাটাচ্ছেন আপনারা- এই প্রশ্ন রেখে সেতু ফেইসবুকে লিখেছেন, “এখনও ১২ টা বাজেনি, আমার ছেলেটার এডিএইচডি। সাউন্ডে মারাত্বক হাইপার হয়ে যায়, বাজির আওয়াতে ঘুমাতে পারছে না। প্রতি ১০ ঘরে এমন দুটো করে বাচ্চা আছে জানেন? নিউ বর্ন বেবি, অসুস্থ রোগীদের কী অবস্থা কে জানে?”
সেতুর পোস্টেই অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন রাহিমা আক্তার সুমি নামে একজন। বড় দুটো অস্ত্রোপচার শেষে তিনি বাড়ি ফিরেছেন কিছুদিন হলো। তিনি উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত, তার উচ্চ আওয়াজের ভীতিও আছে।
“এলাকার কুকুরগুলো একটানা ডাকছে। দরজা-জানালা বন্ধ করে দিয়ে বসে আছি। যতটা শব্দ কম নেওয়া যায়। ফুল স্পিডে ফ্যান ছেড়ে কম্বলের ভিতর মাথা গুঁজে আছি। পাখিদের কথা বলতে পারি না। ভীষণ মাথা ঘুরছে, বোধহয় বমি হবে… আজকে রাতের এই ট্রমা থেকে বের হতে মোটামুটি চার-পাঁচ দিন লাগবে।”
সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিওতে দেখা যায়, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আশেপাশে কোথাও আতশবাজি ফুটছে, আর তাতে উড়ে যাচ্ছে শত শত পাখি। মৃত পাখির ছবিও ছড়িয়েছে ফেইসবুকে।
মঙ্গলবার রাতেই নিজের ওয়ালে এক ভিডিও পোস্ট করেছেন সংযুক্তা মিশু। একমাস বয়সে সংযুক্তার কাছে এসেছিল সাত বছরের টোটো। নিজের সন্তানের চাইতে কোনও অংশে কম নয় টোটো। তাই প্রিয় কুকুর টোটোর সবকিছু সংযুক্তার মুখস্থ।
ভিডিওতে দেখা যায়, ‘টোটো’কে শান্ত করছিলেন তিনি। কিন্তু কিছুক্ষণ পরপর বাসার পাশে আতশবাজির বিকট শব্দে ভয়ঙ্করভাবে উত্তেজিত হয়ে উঠছিল কুকুরটি। তাকে শান্ত করতে বেগ পেতে হচ্ছিল সংযুক্তাকে।
সংযুক্তা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “রাতে ১২টার আগেই, খুব সম্ভবত ১১টা ৪০ এর দিকে এই আবাসিক এলাকায় (এলাকার নামটি না জানাতে অনুরোধ করেছেন তিনি) পটকা ফাটানো শুরু হয়। যেহেতু এখন শীতের রাত, তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই শব্দ ভীষণ বিকট শোনায়। এই শব্দেই টোটো ভয় পাচ্ছিল, কোনোরকমে তাকে আমার সঙ্গেই কান বন্ধ করে রেখেছিলাম।
“কিন্তু ১২টা বাজার ১০ মিনিট আগে পটকা আর আতশবাজি যখন একসঙ্গে শুরু হয়, তখন বাইরের কুকুররা খুব দৌড়াচ্ছিল আর চিৎকার করছিল ভয়ে, নিজেদের বাঁচাতে এদিক-ওদিক ছুটতে শুরু করে। এতেই পাগল হয়ে যায় টোটো। এরপর সে হাইপার হয়ে গেলে তার হার্টবিট বেড়ে যায়। রাতে ঘুমায়নি।”
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ এহসান রহমান জিয়া জানান তার ৮৬ বছর বয়সী বাবার দুর্ভোগের কথা। তিনি স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে গত সাড়ে চার বছর ধরে শয্যাশায়ী।
বছর বরণে এমন আচরণকে ‘অমানবিক উচ্ছ্বাস’ হিসাবে দেখার কথা জানিয়ে জিয়া সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, মুহুর্মুহু বিকট শব্দের মধ্যে নিজের রুমে দরজা-জানালা আটকে বসে ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ তার সাড়ে ১২ বছরের মেয়ে প্রকৃতি নাযারীনা আহমেদের চোখে পানি দেখে তার চোখ আটকে যায়।
নালন্দা বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থী প্রকৃতির চোখে পানি কেন- জানতে চাইলে প্রকৃতি জবাব দিয়েছিল, পাশের কক্ষে থাকা জেগে থাকা প্যারালাইজড দাদার জন্য তার কষ্ট হচ্ছে। এই শব্দে দাদা, দাদার মতো যারা রয়েছেন, সঙ্গে রাস্তার কুকুর, বেড়াল আর গাছের পাখির জন্য কিছু করতে না পারার অসহায়ত্বের কারণে তার কান্না পাচ্ছে।
১ জানুয়ারি সরকারি জরুরি সেবাদানের হটলাইন ৯৯৯ এর পুলিশ পরিদর্শক (গণমাধ্যম ও জনসংযোগ) আনোয়ার সাত্তার জানিয়েছেন, আগের রাতে উচ্চশব্দে গান-বাজনা, হৈ-হুল্লোড় ও আতশবাজি ইত্যাদি শব্দ দূষণ প্রতিকারে ৯৯৯ নম্বরে মোট ১ হাজার ১৮৫টি কল আসে। এর মধ্যে ঢাকা মহানগর থেকে ৩৮৭টি এবং দেশের অন্যান্য স্থান থেকে ৭৯৮টি।
এর আগে ৯৯৯ এর তথ্য অনুসারে, গত বছর এই রাতে উচ্চ শব্দে গানবাজনা ও শব্দদূষণ সংক্রান্ত ৯৭১টি অভিযোগ ছিল। সবচেয়ে বেশি অভিযোগ ছিল ঢাকা মহানগর থেকে। ২০২২ সালে বরণের সময় আতশবাজি ও ফানুস থেকে রাজধানীর ছয় জায়গায় অগ্নিকাণ্ড ঘটেছিল। তার মধ্যে যাত্রাবাড়ী ও ধোলাইখাল এলাকায় ফায়ার সার্ভিসকে গিয়ে আগুন নেভাতে হয়।