Beta
সোমবার, ১ জুলাই, ২০২৪
Beta
সোমবার, ১ জুলাই, ২০২৪

সুনামগঞ্জে বন্যা : কৃষি ও মৎস্য খাতে ১১৬ কোটি টাকার ক্ষতি

সুনামগঞ্জে প্রায় ১০ হাজার কৃষক পরিবারের ক্ষতি হয়েছে ৪১ কোটি টাকার। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
সুনামগঞ্জে প্রায় ১০ হাজার কৃষক পরিবারের ক্ষতি হয়েছে ৪১ কোটি টাকার। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
Picture of আঞ্চলিক প্রতিবেদক, সিলেট

আঞ্চলিক প্রতিবেদক, সিলেট

দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলের ভাটির জনপদ সুনামগঞ্জ সম্পর্কে একটি কথা প্রচলিত আছে। সেটি হলো, ‘মৎস্য,পাথর আর ধান; এই তিনেই সুনামগঞ্জের মান’।

এবারের দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় সেই জেলার অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবন প্রবাহের তিনটি খাতের দুটিই ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে মৎস্য খাতে। বোরো প্রধান অঞ্চল হিসেবে এবার বোরো ফসল ভালো হওয়ায় কৃষকের মধ্যে স্বস্তি ছিল। কিন্তু বন্যার কারণে আউশ ধান ও সবজি ক্ষেতের ক্ষতিতে কৃষকরা পড়েছেন বিপাকে। যোগাযোগ খাতেও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এবারের বন্যায় কেবল কৃষি ও মৎস্য খাতে ক্ষতি হয়েছে ১১৬ কোটি টাকার। বন্যার পানিতে ১ হাজার ৭০০ হেক্টর ফসলি জমি বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়। এতে ক্ষতি হয়েছে ১১ কোটি টাকার। শাক সবজি বন্যায় তলিয়ে যাওয়ায় ক্ষতির পরিমাণ ৩৩ কোটি টাকা।

সব মিলিয়ে প্রায় ১০ হাজার কৃষক পরিবারের ক্ষতি হয়েছে ৪১ কোটি টাকার। বন্যার পানিতে জেলায় ৮ হাজার পুকুরের মাছ ও পোনা ভেসে গিয়ে ক্ষতি হয়েছে ৭২ কোটি টাকার।

ক্ষয়ক্ষতির প্রসঙ্গে কথা হয় সদর উপজেলার কৃষক মহিবুর রহমানের সঙ্গে।

তিনি জানালেন, গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ১ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ধুন্দল আর পটলের চাষ করেছিলেন। ফুলও এসেছিল অনেক। ভেবেছিলেন সফল হয়েছেন, সহজেই ঋণ পরিশোধ করতে পারবেন। কিন্তু এখন পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, ঋণের কিস্তি পরিশোধের বিষয়েই নতুন করে ভাবতে হচ্ছে।

দোয়ারাবাজার উপজেলার ডাউকেরখারা গ্রামের কৃষক জুবায়ের আহমদ বলেন, “আমি ৫ একর জমিতে ডাটা, করলা, ধুন্দল, ঝিঙ্গার চাষ করেছিলাম। পাহাড়ি ঢলে গ্রামের বাঁধ ভেঙে স্রোতের তোড়ে সব কিছু ভেসে যায়। এখন যে জমিতে আমি আমার কষ্টের ফসল চাষ করেছিলাম সেখানে কিছুই নেই কাদা ছাড়া।”

সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, এ বছর সুনামগঞ্জ জেলায় আউশ আবাদ হয়েছিল ৭ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে এবং গ্রীষ্মকালীন শাক সবজি চাষ হয়েছিল ৩ হাজার ৩শ ৭৭ হেক্টর জমিতে। এর মাঝে ১ হাজার ৭০০ হেক্টর আউশ আবাদি জমি পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে এবং গ্রীষ্মকালীন সবজির ৫৬৭ হেক্টর জমি নিমজ্জিত হয়েছে।

ক্ষয়ক্ষতির চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী সুনামগঞ্জে আউশধানের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১১ কোটি টাকার এবং গ্রীষ্মকালীন সবজির ক্ষতি হয়েছে ৩৩ কোটি টাকার।

সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, জেলায় আউশ ধান  চাষ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন চার হাজার চাষি। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের তালিকা প্রণয়নের কাজ চলছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষককদের বিনামূল্যে বীজ ও সার দেওয়া হবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে অন্যান্য সহযোগিতাও করা হবে।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী, জেলার ১২ উপজেলায় ২৫ হাজার ১৭৩টি পুকুর আছে। এর মধ্যে মৎস্য অধিদপ্তরের অধীন ২০টি, ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীন ১৫৩টি, বাকি ২৫ হাজার পুকুরে ব্যক্তিমালিকানায় মাছ চাষ করা হয়। জেলায় মাছ চাষি আছেন ১৬ হাজার ৫০০ জন। এবারের বন্যায় প্রায় ৮ হাজার পুকুরের মাছ ও পোনা ভেসে গেছে। ভেসে যাওয়া মাছ ও পোনার পরিমাণ ৪ হাজার মেট্রিক টন। এ ছাড়া মাছের খামারের অবকাঠামোগত ক্ষতিও হয়েছে। সব মিলিয়ে  ক্ষতি হয়েছে ৭২ কোটি টাকার।

এর মধ্যে অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১০ কোটি টাকার। জেলাটিতে মৎস্য সম্পদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে জেলার সদর, দোয়ারাবাজার, ছাতক ও শান্তিগঞ্জ উপজেলায়।

দোয়ারাবাজার উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের চিলাগাঁও গ্রামের মাছ চাষি ফারুক আহমদ জানালেন, তার মাছের খামারের তিনটি পুকুরের মাছ ও পোনা ভেসে গেছে। এসব পুকুরে রুই, কাতলা, পাঙাশসহ বিভিন্ন জাতের মাছ ছিল। পাহাড়ি ঢলের কারণে সব ভেসে গেছে।

শান্তিগঞ্জ উপজেলা জিয়াপুর গ্রামের এনামুল হক সাতটি বড় পুকুরে মাছ চাষ করেছিলেন। এসব পুকুরে প্রায় ২০ লাখ টাকার মাছ ছিল তার। এক রাতেই পানির তোড়ে ভেঙে যায় তার পুকুরগুলোর পাড়। ভেসে যায় সব মাছ।

এ অবস্থায় সরকারের সহযোগিতা চেয়েছেন তিনি।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. শামশুল করিম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, আট হাজার পুকুর প্লাবিত হয়ে মাছ, পোনা ও অবকাঠামো মিলিয়ে ৭২ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জলবায়ূ সহনশীল মাছ চাষ প্রকল্প থেকে আমরা ক্ষতিগ্রস্থদের সহযোগিতার চেষ্টা করছি।

এছাড়া বন্যায় সুনামগঞ্জের রাস্তাঘাটেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আনোয়ার হোসেন জানান, বন্যায় তাদের প্রায় ১২০ কিলোমিটার সড়কের ক্ষতি হয়েছে; যা সংস্কার করতে প্রয়োজন পড়বল ৩৫০ কোটি টাকা।

অন্যদিকে সড়ক ও জনপদ বিভাগের ১২০ কিলোমিটার সড়কের বিভিন্ন অংশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এগুলো মেরামত করতে অন্তত ১০ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে বলে জানিয়েছেন নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল ইসলাম প্রামাণিক।

শুক্রবার বিকালে সুনামগঞ্জ জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে জেলা প্রশাসন ও সওজ কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী। 

সেখানে তিনি বলেন,  আমরা ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নিয়েছি। পানি কমলে কাজ শুরু হবে। যেসব জায়গায় সড়কের জন্য পানি চলাচল করতে বাধার সৃষ্টি হয় সেসব স্থান চিহ্নিত করা হবে। যেখানে ব্রিজ বা কালভার্ট করা প্রয়োজন সেখানে প্রয়োজন অনুযায়ী সেটা করা হবে। 

এবার সড়ক মেরামতে স্থানীয়দের বক্তব্যকে প্রাধান্য দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।

সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ রেজাউল করিম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, জেলায় এক হাজার ৪৪১ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সব বিভাগের ক্ষয়ক্ষতির তালিকা তৈরির কাজ চলছে।

গত ১৭ জুন শুরু হওয়া বন্যায় সুনামগঞ্জের ১১টি উপজেলায় ১ হাজার ১৮টি গ্রাম প্লাবিত হয়। পানিবন্দি হয়ে পড়েন প্রায় ৮ লাখ মানুষ। ৫৪১টি আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নেন প্রায় ২৫ হাজার মানুষ। পানি নেমে যাওয়ার পর  অধিকাংশ মানুষ আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে বাড়িঘরে ফিরেছেন।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত