Beta
রবিবার, ৭ জুলাই, ২০২৪
Beta
রবিবার, ৭ জুলাই, ২০২৪

সিলেটে দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিচ্ছে বন্যা 

গত দুদিনের ভারি বৃষ্টিতে  সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির বেশ অবনতি হয়। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
গত দুদিনের ভারি বৃষ্টিতে সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির বেশ অবনতি হয়। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
Picture of আঞ্চলিক প্রতিবেদক, সিলেট

আঞ্চলিক প্রতিবেদক, সিলেট

সিলেট অঞ্চলে উন্নতির দিকে থাকা বন্যা পরিস্থিতির অনেকটা অবনতি হয়েছে গত দুদিনের ভারি বৃষ্টিতে। বুধবার সকাল থেকে সুরমাসহ কয়েকটি নদীর পানি বেশির ভাগ পয়েন্টে কমতে শুরু করলেও কুশিয়ারা, মনু ও খোয়াই নদীর পানিবৃদ্ধি সব পয়েন্টে অব্যাহত রয়েছে।

উজানের উপজেলাগুলো থেকে পানি নামতে থাকায় ভাটির উপজেলাগুলোর নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।

ফলে প্লাবিত এলাকা পরিবর্তিত হলেও সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির কোনও উন্নতি হচ্ছে না। বরং আগে থেকে পানি নিমজ্জিত এলাকাগুলোতে মানুষের দুর্ভোগ ও ভোগান্তি আরও বেড়েছে। নদী ও হাওরগুলো পানিতে পরিপূর্ণ থাকায় দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিচ্ছে সিলেট বিভাগে বন্যা পরিস্থিতি।

গত ২৯ মে ভারি বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সিলেটে প্রথম বন্যা পরিস্থিতির ‍সৃষ্টি হয়। ৮ জুনের পর পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়।

বন্যার দ্বিতীয় ধাক্কা আসে ১৬ জুন। সেদিন আবার পাহাড়ি ঢলে সিলেটের সীমান্তবর্তী দুই উপজেলা বন্যার কবলে পড়ে। পরে নগর এলাকাসহ জেলার ১৩টি উপজেলায় বন্যা দেখা যায়। গত ১৯ জুন অতিবর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ওইসব উপজেলায় বন্যা বিস্তৃত হয়।

এর মধ্যে ১৭ জুন থেকে সুনামগঞ্জ জেলায় ফের বন্যা দেখা দেয়। পরে মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলায় তা বিস্তৃত হয়।

এরপর ২৫ জুন থেকে সিলেট অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি অনেকটা উন্নতি হতে শুরু করার মধ্যেই সোমবার থেকে অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে নদীর পানি বেড়ে আবার বন্যা পরিস্থিতি গুরুতর আকার ধারণ করেছে।

মঙ্গলবার রাত ১২টার দিকে জকিগঞ্জ পৌর এলাকা ও সদর ইউনিয়নের নরসিংহপুর, মানিকপুর, ছবড়িয়া ও রারাই এলাকার বিভিন্ন স্থানে কুশিয়ারা নদীর বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করায় অন্তত ১০টি গ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে।

কুশিয়ারা তীরবর্তী ফেঞ্চুগঞ্জ ও বালাগঞ্জ উপজেলা সদর বন্যার পানিতে এখনও নিমজ্জিত রয়েছে।

সিলেটের ১৩টি উপজেলার মধ্যে আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষ নেই কেবল সিলেট সদর ও জৈন্তাপুর উপজেলায়। সীমান্তবর্তী গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, জৈন্তাপুর ও কোম্পানীগঞ্জে বন্যার পানি নামছে।

তবে ওসমানী নগর, বালাগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার উপজেলায় দীর্ঘস্থায়ী বন্যার কারণে মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। এই চার উপজেলায় ১৪৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে এ মুহূর্তে অবস্থান করছেন ৭ হাজার ১৭১ জন মানুষ।

পানি উন্নয়ন বোর্ড, সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “উজান থেকে নেমে আসা ঢল ও ভারি বর্ষণের কারণে নদীগুলোতে পানি বেড়েছে। ভারতের মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি বেশি হলে সিলেটে তার প্রভাব পড়ে।

“গত তিন দিনে চেরাপুঞ্জিতে ৬৪০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। আর আমাদের এখানে বৃষ্টি হয়েছে ৩৫০ মিলিমিটার। এ কারণে নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে।” 

টানা ভারি বৃষ্টিতে ভোগান্তিতে পড়েছেন সিলেটে অঞ্চলের মানুষ। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

পানি উন্নয়ন বোর্ড, সিলেটের বুধবার সকাল ৯টার তথ্য অনুযায়ী, সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ৮৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, যা মঙ্গলবার ছিল বিপৎসীমার ১১২ সেন্টিমিটার ওপরে।

সিলেট পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, যা আগের দিন বইছিল বিপৎসীমার ২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে।

কুশিয়ারা নদীর পানি বিয়ানীবাজারের শেওলা পয়েন্টে বিপৎসীমার ৪৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, যা মঙ্গলবার বিপৎসীমার ২৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।

জকিগঞ্জের অমলসিদ পয়েন্টে কুশিয়ারা নদীর পানি বিপৎসীমার ১৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, যা মঙ্গলবার ছিল বিপৎসীমার ৮৯ সেন্টিমিটার ওপরে।

ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে কুশিয়ারা নদীর পানি বিপৎসীমার ৯৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, যা আগের দিন বইছিল বিপৎসীমার ৯৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে।

শেরপুর পয়েন্টে কুশিয়ারা নদীর পানি বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, যা আগের দিন ছিল বিপৎসীমার ১৭ সেন্টিমিটার ওপরে। 

সিলেট আবহাওয়া অফিস বলছে, মঙ্গলবার সকাল ৬টা থেকে বুধবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সিলেটে বৃষ্টি হয়েছে ২৫ মিলিমিটার। এর আগে সোমবার সকাল ৬টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৬টা পর্যন্ত সিলেটে ২৯৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। 

সিলেট জেলা প্রশাসনের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ১৩টি উপজেলায় বন্যায় আক্রান্তের সংখ্যা ৭ লাখ ১ হাজার ৬৫৮। ১১টি উপজেলায় ১৮৯টি আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছেন ৮ হাজার ৩৫১ জন মানুষ।

সিলেটে সবচেয়ে বেশি বন্যা কবলিত উপজেলা ওসমানী নগর। এই উপজেলার ২৭৩টি গ্রামে ১  লাখ ৮২ হাজার মানুষ বন্যা আক্রান্ত রয়েছেন। আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা মানুষও এই উপজেলায় বেশি। ৬৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে এ মুহূর্তে অবস্থান করছেন ৩ হাজার ১৮১ জন। 

বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “জেলার অভ্যন্তরীণ নদ-নদীর পানি ৬টি পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। উজানের উপজেলাগুলো থেকে ঢলের পানি নামতে থাকায় ভাটির উপজেলাগুলোতে বন্যা পরিস্থিতির কোনও উন্নতি হচ্ছে না।”

উজানের উপজেলাগুলো থেকে পানি নামতে থাকায় ভাটির উপজেলাগুলোর নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

সুনামগঞ্জের পরিস্থিতি

সুনামগঞ্জে উন্নতির দিকে থাকা বন্যা পরিস্থিতির সোমবার অবনতি হয়েছিল। সেদিন পৌর শহরের নিম্নাঞ্চলসহ সুরমা তীরবর্তী বিভিন্ন উপজেলার কয়েকটি স্থান প্লাবিত হয়।

তবে বুধবার সকাল থেকে বন্যার পানি জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে নামতে শুরু করেছে। অবশ্য সুনামগঞ্জের ছাতক, দোয়ারাবাজার, বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর, জামালগঞ্জ ও জগন্নাথপুর উপজেলার নিম্নাঞ্চল এখনও পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে।

সুনামগঞ্জ জেলা সদরের সঙ্গে বিশ্বম্ভরপুর ও তাহিরপুর উপজেলার সরাসরি সড়ক যোগাযোগ এখনও বিচ্ছিন্ন। এছাড়া সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার কুরবান নগর ও রঙ্গারচর ইউনিয়নের জেলা সদরের সঙ্গে সংযোগ সড়ক কয়েকটি জায়গায় বন্যার পানিতে ভেঙে গেছে।

এতে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে কর্মজীবী মানুষ ও স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের। বারবার বন্যায় মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উপজেলাগুলোর গ্রামীণ সড়ক। 

পানি উন্নয়ন বোর্ড, সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার সকাল সন্ধ্যাকে জানান, সোমবার সকাল ৯টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৯টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় ৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে, যা ছিল এ বছরে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ।

এ অঞ্চলে মঙ্গলবার বিকাল থেকে বৃষ্টি কমে যাওয়ায় নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় সুনামগঞ্জে ২৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। 

তিনি জানান, বুধবার সকালে সুরমা নদীর পানি সুনামগঞ্জ পয়েন্টে বিপৎসীমার ৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, যা মঙ্গলবার বিপৎসীমার ২৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। 

সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ রেজাউল করিম সকাল সন্ধ্যাকে জানান, জেলার ১২টি উপজেলায় ৩ লাখ ৮৬ হাজার ৮৩১ জন বন্যা কবলিত। আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছেন ১ হাজার ৮৩৭ জন।

তিনি জানান, বৃষ্টিপাত কমার ফলে অভ্যন্তরীণ নদ-নদীগুলোর পানি কিছুটা হ্রাস পাচ্ছে। জেলার ছাতক উপজেলায় ৩ সেন্টিমিটার ও সুনামগঞ্জ সদরে ২৩ সেন্টিমিটার পানি হ্রাস পেয়েছে। দিরাই উপজেলায় ২০ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। দুর্গতদের মধ্যে জেলা প্রশাসনের ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।

এদিকে, মৌলভীবাজারের জুড়ী, কুলাউড়া ও বড়লেখায় আগে থেকে পানিবন্দী থাকা মানুষ নদীর পানি বৃদ্ধির কারণে আরও বেশি দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন।

মনু ও কুশিয়ারা নদীর পানি বেড়ে লোকালয়ে প্রবেশ করায় মৌলভীবাজার সদর ও রাজনগর উপজেলার নিম্নাঞ্চলেও পানি বেড়েছে। মৌলভীবাজার সদর উপজেলার হামরকোনা গ্রামে কুশিয়ারা নদীর বাঁধ ভেঙে কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। 

বন্যায় সিলেট অঞ্চলের অনেক স্থাপনা পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

হাকালুকি হাওরে জলাবদ্ধতা

বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হয়ে জলাবদ্ধতায় রূপ নিয়েছে হাকালুকি হাওর এলাকায়। অন্যান্য এলাকায় পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও অপরিবর্তিত রয়েছে হাকালুকি হাওর তীরবর্তী গ্রামগুলো।

চলমান পরিস্থিতিতে খাবার, বিশুদ্ধ পানি, স্যানিটেশন ও গবাদিপশুর খাবার সংকটের পাশাপাশি পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে চরম দুর্ভোগে আছেন বানভাসিরা। 

হাকালুকি হাওরের পানি ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়ায় কুলাউড়া উপজেলা পরিষদসহ বিভিন্ন দপ্তর ও আবাসিক এলাকা থেকে পানি নামছে না। গত ১৬ দিন ধরে বন্যার পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে কুলাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। 

মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জাবেদ ইকবাল সকাল সন্ধ্যাকে জানান, গত দুদিনের ভারি বৃষ্টিতে উজানের পানি নামতে থাকায় নদ-নদীর পানি বাড়ছে।

কুশিয়ারা, মনু ও জুড়ী নদীর পানি প্রতিটি পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

জুড়ী ও কুলাউড়া উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ বলে জানান পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জাবেদ ইকবাল।   

কুশিয়ারা নদীর পানি পাড় উপচে হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার দীঘলবাক, ইনাতগঞ্জ ও মোস্তফাপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের বন্যার পানি আরও বেড়েছে। 

জেলার বানিয়াচং উপজেলার মার্কুলি ও আজমিরীগঞ্জ উপজেলা পয়েন্টে কুশিয়ারা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে এই দুই উপজেলার নদী তীরবর্তী এলাকা পানি নিমজ্জিত হয়।

এছাড়া মাধবপুর ও লাখাই উপজেলার নিম্নাঞ্চলও বন্যায় প্লাবিত রয়েছে।

হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় ৭টি উপজেলার আংশিক এলাকায় বন্যাকবলিত ২ হাজার ৩১৩ জন এবং আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছে ৭৯২ জন।

হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোছা. জিলুফা সুলতানা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “জেলার বন্যা পরিস্থিতি আমরা সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করছি। কুশিয়ারা ও খোয়াই নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। দুর্যোগ মোকাবিলায় সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত