গুম- গত এক দশকজুড়ে বাংলাদেশে আলোচিত একটি শব্দ; তবে তখন ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকার বারবারই তা অস্বীকার করে আসছিল। সরকারের কর্তা-ব্যক্তিদের কাছ থেকে এমনও বক্তব্যও আসত- সরকারকে বিপদে ফেলতে অনেকে আত্মগোপনে গিয়ে গুমের নাটক সাজাচ্ছে।
তবে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পাল্টেছে দৃশ্যপট; গুমের শিকার কয়েকজন মুক্তি পেয়েছেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গুমের ঘটনাগুলো তদন্তে গঠন করেছে কমিশন।
তবে এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অগ্রগতির খবর এল বৃহস্পতিবার। তা হলো গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে বাংলাদেশের যোগদান। উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘের এই সনদের দলিলে সই করে বলেন, এটি একটি ‘ঐতিহাসিক’ ঘটনা।
প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন ও কার্যালয় যমুনায় উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের পর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সাংবাদিকদের বলেন, “এই কনভেনশনে বাংলাদেশ আজকে স্বাক্ষর করেছে। প্রধান উপদেষ্টা নিজে স্বাক্ষর করেছেন।”
প্রতি বছর ৩০ আগস্ট জোরপূর্বক গুমের শিকার ব্যক্তিদের জন্য আন্তর্জাতিক দিবস পালন করা হয়ে থাকে। দিবসটির একদিন আগে ড. ইউনূস এই দলিলে সই করলেন।
বাংলাদেশ ১১৬তম সদস্য হিসাবে জাতিসংঘের এই সনদে যুক্ত হতে যাচ্ছে। তবে যতগুলো দেশ এই সনদে সই করেছে, তারা সবাই এটি কার্যকর করেনি নিজ নিজ দেশে।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, চীন নিরাপত্তা পরিষদের এই চার স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রের কেউ এখনও এই সনদে সই করেননি। করেছে কেবল ফ্রান্স।
কীভাবে এল এই সনদ
গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদটি ২০১০ সালে জাতিসংঘের স্বীকৃতি পেলেও এর প্রক্রিয়াটি শুরু তার বেশ আগে।
১৯৯২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের একটি প্রস্তাবে জোরপূর্বক গুমের ঘটনার বিষয়টি উল্লেখ ছিল। তখন জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থাকে এর খসড়া তৈরির দায়িত্বটি দেওয়া হয়েছিল।
তখন একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হয়েছিল, তারা ২০০৬ সালে একটি খসড়া চূড়ান্ত করে। গুমের হাত থেকে মানুষকে রক্ষায় ওই বছরই জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল সেই খসড়াটি অনুমোদন করে।
২০০৬ সালের ২০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ এই খসড়াটি গ্রহণ করে এবং এটিকে সনদ হিসাবে গ্রহণের জন্য সদস্য দেশগুলোর স্বাক্ষরের জন্য উন্মুক্ত করে। এই স্বাক্ষর অনুষ্ঠানটি হয় ফ্রান্সে।
৩২টি দেশ অনুস্বাক্ষরের পর ২০১০ সালে International Convention for the Protection of All Persons from Enforced Disappearance বাস্তবায়ন শুরু হয়।
সনদে মোট ৪৫টি অনুচ্ছেদ আছে। তবে স্বাক্ষরকারী কোনও দেশ চাইলে সনদের ‘এক বা একাধিক অনুচ্ছেদ মেনে চলবে না’ বলেও তাদের সিদ্ধান্ত জাতিসংঘকে জানাতে পারে।
এই সনদের যথাযথভাবে প্রয়োগ হচ্ছে কি না, সেটি দেখভালের জন্য জাতিসংঘের ১০ সদস্যের একটি কমিটি কাজ করে। ওই কমিটি পক্ষভুক্ত রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিবেদন যাচাই করে থাকে।
সনদে যা আছে
জাতিসংঘের এই সনদে জোরপূর্বক গুমকে একটি মানবতাবিরোধী অপরাধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
সামগ্রিকভাবে এই সনদের লক্ষ্য কাউকে জোরপূর্বক গুম করা বন্ধের পাশাপাশি এই অপরাধের জন্য দায়মুক্তি বন্ধ করা। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সহায়তা দেওয়া।
গুমবিরোধী সনদে বলা হয়েছে, কোনও মানুষকেই জোর করে গুম করা যাবে না। যত ব্যতিক্রমী পরিস্থিতি আসুক না কেন, কাউকে গুম করা যাবে না। যুদ্ধ, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বা অন্য কোনও জরুরি অবস্থাকেও গুমের ন্যায্যতা হিসাবে দেখানো যাবে না।
সনদে বলপূর্বক গুমের সংজ্ঞায় বলা হয়, রাষ্ট্রের এজেন্ট বা রাষ্ট্রের অনুমোদন, সমর্থন বা সম্মতির সঙ্গে কাজ করে এমন ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের হাতে কেউ গ্রেপ্তার, আটক, অপহরণ বা অন্য কোনও পদ্ধতিতে স্বাধীনতা বঞ্চিত হওয়ার পর যদি রাষ্ট্র তা অস্বীকার করে বা নিখোঁজ ব্যক্তির ভাগ্য বা অবস্থান গোপন করে, যা সেই ব্যক্তিকে আইনের সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত করে, তাহলে তা গুম হিসাবে গণ্য হবে।
সনদের ৩৩ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে, এতে পক্ষভুক্ত কোনও দেশে যদি গুমের ঘটনা ঘটে, তবে ওই দেশের পরিস্থিতি দেখার জন্য কমিটির সদস্যরা সফরও করতে পারে।
অবশ্য স্বাক্ষরকারী অনেক দেশ এই অনুচ্ছেদটির শর্ত মেনে নেয়নি।
সনদে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর গুমের বিরুদ্ধে কর্তব্য হিসাবে বলা হয়, প্রতিটি রাষ্ট্র নিজ দেশে গুমের প্রতিটি ঘটনা তদন্ত করার জন্য এবং দায়ীদের বিচারের আওতায় আনার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য থাকবে।
প্রতিটি রাষ্ট্র তার ফৌজদারি আইনের অধীনে বলপূর্বক গুমকে একটি অপরাধ বলে নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।
এই সনদ অনুযায়ী, বলপূর্বক গুমের ব্যাপক বা পদ্ধতিগত অনুশীলন মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে, যেমনটা প্রযোজ্য আন্তর্জাতিক আইনে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। এই অপরাধের বিচারও হবে সেই আন্তর্জাতিক আইনে।
বিচারে আসবে কারা
জোরপূর্বক গুমের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিচারের আওতায় আনার বিষয়ে সনদে বলা হয়, প্রতিটি রাষ্ট্র অন্তত যাদের বিচারের আওতায় আনতে বাধ্য থাকবে তারা হল-
>> এমন যে কোনও ব্যক্তি যিনি বলপূর্বক গুম করেন, আদেশ দেন, অনুরোধ করেন বা প্ররোচিত করেন বা করার চেষ্টা করেন বা সহযোগিতা বা অংশগ্রহণ করেন।
>> এমন কোনও উচ্চ পদস্থ ব্যক্তি যিনি জ্ঞাতসারে বা সচেতনভাবে এমন কোনও তথ্য উপেক্ষা করেন, যা স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করে যে তার বা তার কার্যকর কর্তৃত্ব এবং নিয়ন্ত্রণের অধীনে অধস্তনরা বলপূর্বক গুমের অপরাধ করছে বা করতে চলেছে।
>> যিনি বলপূর্বক গুমের অপরাধের সঙ্গে সম্পর্কিত কার্যকলাপের জন্য কার্যকরভাবে দায়িত্ব পালন এবং নিয়ন্ত্রণ করেন।
>> যিনি বলপূর্বক গুমের ঘটনা প্রতিরোধ বা দমন করার জন্য বা তদন্ত ও বিচারের জন্য উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে বিষয়টি উত্থাপনে তার ক্ষমতার মধ্যে সমস্ত প্রয়োজনীয় এবং যুক্তিসঙ্গত ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছেন।
এসব কাজে সংশ্লিষ্ট এমন কোনও সামরিক কমান্ডার বা সামরিক কমান্ডার হিসাবে কার্যকরভাবে কাজ করা ব্যক্তিদেরও আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে বিচারের আওতায় আনতে হবে।
কোনও বেসামরিক, সামরিক বা অন্য কোনও সরকারি কর্তৃপক্ষের আদেশ বা নির্দেশকে বলপূর্বক গুমের অপরাধকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা যাবে না।
সনদে বলা হয়েছে, প্রতিটি রাষ্ট্র জোরপূর্বক গুমের অপরাধকে চরম গুরুতর বিবেচনায় নিয়ে উপযুক্ত শাস্তির মাধ্যমে শাস্তিযোগ্য করে তুলবে।
কারা সই করেছে, কারা করেনি
দেড় দশক গড়ালেও গুমবিরোধী জাতিসংঘ সনদে প্রভাবশালী অনেক রাষ্ট্রই যোগ দেয়নি।
জাতিসংঘের ওয়েবসাইটের তথ্যে দেখা যায়, ৭৫টি দেশ এই সনদে অনুস্বাক্ষর করেছে, ৪০টি দেশ যোগ দিছে। ৮২টি দেশ এটি কোনও পর্যায়েই অনুমোদন করেনি।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শুধু শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ এই সনদে অনুস্বাক্ষর করেছে। অর্থাৎ সনদটিকে অভ্যন্তরীণ আইনের অংশ হিসেবে গ্রহণ করেছে।
ভারত শুধু এটিতে যোগ দিয়েছে, কিন্তু অনুস্বাক্ষর করেনি। তার সঙ্গে এখন বাংলাদেশের নামও যুক্ত হলো।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য দেশ পাঁচটি। শুধু ফ্রান্স এই সনদ অনুস্বাক্ষর করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র এই সনদে যোগ না দেওয়ার কারণ দেখিয়ে বলেছে, এই সনদ তাদের প্রত্যাশামাফিক হয়নি।
সনদের কয়েকটি ধারা মনমতো না হওয়ায় যুক্তরাজ্যও এই সনদে যোগ দেয়নি।
জোরপূর্বক বা অনিচ্ছাকৃত গুম সংক্রান্ত জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপ ১৯৮০ সাল থেকে ১১০টি দেশে ৫৯ হাজারেরও বেশি গুমের ঘটনার তদন্ত করে প্রকাশ করেছে। এসব দেশের মধ্যে মানবাধিকারের মশালবাহী অনেক দেশও রয়েছে।
এই সময়ের মধ্যে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি গুমের ঘটনা ঘটেছে শ্রীলঙ্কায়। ১৯৮০-র দশকের শেষদিকে দেশটিতে ৬০ হাজার থেকে ১ লাখ মানুষকে গুম করা হয়।
বাংলাদেশে কী হবে
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানোর আগে দেড় দশকে আওয়ামী লীগের শাসনকালে বহু মানুষকে গুম করার অভিযোগ রয়েছে।
মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের হিসাবে, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে ৭০০-র বেশি মানুষ গুম হয়েছে। এর মধ্যে ১৫০ জনের বেশি মানুষের খোঁজ এখনও পাওয়া যায়নি।
২০২১ সালে হিউম্যান রাইট ওয়াচের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে গুমের শিকার ৮৬ জনের খোঁজ তখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান বলেছে, ২০০৭ থেকে গত ১৭ বছরে গুমের শিকার হয় ৬২৯ জন। এর মধ্যে ৭৮ জনের লাশ পাওয়া গিয়েছিল পরে। ছেড়ে দেওয়া হয় ৬২ জনকে। ৭৩ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ৩৮৩ জনের খোঁজ মেলেনি।
বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের পর উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সাংবাদিকদের বলেন, সাতশ’র বেশি মানুষ এখনও নিখোঁজ রয়েছে।
তিনি বলেন, “গুম বাংলাদেশে অহরহ হচ্ছিল। এটা আমরা অস্বীকার করেছিলাম।”
বাংলাদেশ জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক ৯টি সনদের ৮টিতে সই করেছে। জাতিসংঘের দীর্ঘদিনের অনুরোধের পরও আওয়ামী লীগ আমলে বাংলাদেশ গুমবিরোধী সনদে সই করেনি।
গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে যোগ দেওয়ায় বাংলাদেশ কী সুফল পাবে- এই প্রশ্নে রিজওয়ানা বলেন, “আর যেন কেউ কখনও নিজের ক্ষমতা কুক্ষিগত করে কোনও বাহিনীকে দিয়ে কোনও পদ্ধতির মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থের কারণে পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার কথা বলে গুম না করতে পারে, সেজন্য আমরা স্বাক্ষর করেছি। এ ব্যাপারে আইনি সংস্কার আমরা করব।”
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “মানবাধিকার কর্মী হিসেবে বলতে চাই, গুমবিরোধী যে সনদে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করল, এতে মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরেছে। সেইসঙ্গে বলা যায়, বাংলাদেশ কার্যকর ভুমিকা রাখবে এবং আন্তর্জাতিক মহলে জবাবদিহিতা থাকবে।”
গুমের প্রতিটি ঘটনা তদন্তে ৫ সদস্যের একটি কমিশন এরই মধ্যে গঠন করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সেই কমিটিতে নূর খানও রয়েছেন।