প্রায় এক শতাব্দীর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে ফ্রান্সের ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ মায়াত্ত।
মায়ত্ত দ্বীপ কর্তৃপক্ষ মঙ্গলবার জানিয়েছে, ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের পর সৃষ্ট ক্ষুধা, রোগ এবং অরাজকতা ছড়িয়ে পড়া রোধ করতে তারা হিমশিম খাচ্ছে।
মঙ্গলবার রাত থেকে সেখানে কারফিউ জারি করা হয়েছে। ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষণা করেছে, মঙ্গলবার থেকে প্রতিদিনি রাত ১০টা থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত কারফিউ জারি থাকবে।
গত শনিবার রাতে মায়াত্তে আঘাত হানার সময় ঘূর্ণিঝড় ‘চিদো’র বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২২৫ কিলোমিটারের বেশি।
ঝড়টি পূর্ব আফ্রিকার উপকূলের কাছে অবস্থিত ফ্রান্সের সবচেয়ে দরিদ্র বিদেশি অঞ্চল মায়ত্তে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পর মোজাম্বিকের উপর দিয়ে আফ্রিকার মূল ভূখণ্ডে আঘাত হানে।
মায়াত্তে এখন পর্যন্ত ২২ জনের মৃত্যুর খবর জানা গেছে। আহত হয়েছেন ১৪০০ জন। তবে চিডোর তাণ্ডবে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়ে থাকতে পারে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় কর্মকর্তারা। মোজাম্বিকে নিহত হয়েছেন ৩৪ জন।
আফ্রিকা উপকূলের কাছে সাগরের মাঝে অবস্থিত মায়াত্তে ৩ লাখ ২০ হাজার মানুষের বসবাস রয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ে পুরো দ্বীপটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
মায়াত্তের অনেক এলাকায় এখনও উদ্ধারকর্মীদের পৌঁছানো সম্ভব হয়নি এবং নিহতদের মৃত্যু আনুষ্ঠানিকভাবে গণনা করার আগেই দাফন করা হয়েছে। ফলে সম্পূর্ণ ধ্বংসযজ্ঞের পরিমাণ বুঝতে কয়েকদিন সময় লেগে যেতে পারে।
মায়াত্ত ভারত মহাসাগরে আফ্রিকার পূর্ব উপকূলের কাছে, মাদাগাস্কার থেকে পশ্চিমে অবস্থিত। এর অধিকাংশ বাসিন্দা মুসলিম। ফরাসি কর্তৃপক্ষের ধারণা অনুযায়ী, সেখানে আরও প্রায় ১ লাখ অভিবাসী বসবাস করে, যারা সোমালিয়ার মতো দূরবর্তী স্থান থেকেও এসেছে।
‘পারমাণবিক যুদ্ধের মতো ধ্বংসযজ্ঞ’
স্থানীয় বাসিন্দারা বিবিসিকে বলছেন, ঘূর্ণিঝড়ের পর দ্বীপটির অবস্থা দেখতে অনেকটা পারমাণবিক যুদ্ধের পরবর্তী পরিস্থিতির মতো মনে হচ্ছে। দেখা দিয়েছে তীব্র খাদ্য,আশ্রয় ও পানির সঙ্কট।
ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেছেন, তিনি আগামী কয়েক দিনের মধ্যে মায়োত্তে সফর করবেন। তিনি উদ্ধার কার্যক্রমে জড়িত নাগরিক, সরকারি কর্মচারী এবং জরুরি পরিষেবাগুলোকে সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন।
ফ্রান্স থেকে আসা ত্রাণ সহায়তা দলসহ উদ্ধারকর্মীরা ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে জীবিতদের উদ্ধারে সন্ধান চালিয়ে যাচ্ছেন। এখন পর্যন্ত ২২ জনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে, তবে স্থানীয় কর্মকর্তারা বলেছেন যে নিহতের সংখ্যা কয়েক হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে।
ফ্রান্স সোমবার জাহাজ এবং সামরিক বিমানের মাধ্যমে উদ্ধারকর্মী ও ত্রাণ সরঞ্জাম পাঠিয়েছে। ফরাসি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রুনো রেতাইও বলেন, “মায়াত্ত পুরোপুরি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।” মন্ত্রণালয়ের অনুমান অনুযায়ী, জনসংখ্যার ৭০% ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ফরাসি রেড ক্রস এই ধ্বংসযজ্ঞকে ‘অকল্পনীয়‘”’ বলে বর্ণনা করেছে এবং জানিয়েছে যে উদ্ধারকর্মীরা এখনও মৃতদেহের সন্ধানে কাজ করছে।
প্রেসিডেন্ট ইম্মানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেছেন, এই বিয়োগান্তক ঘটনা ফ্রান্সের প্রত্যেককে নাড়িয়ে দিয়েছে। সেই আলোকে তিনি একটি জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করবেন।
কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, দ্বীপটির ৩ লাখ ২০ হাজার বাসিন্দার মধ্যে ১ লাখেরও বেশি অবৈধ অভিবাসী। এ কারণে মৃত্যুর সঠিক সংখ্যা নির্ধারণে তারা সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন।
অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি— বিদ্যুৎ লাইন ভেঙে পড়া এবং চলাচলের অযোগ্য রাস্তার কারণে জরুরি উদ্ধার কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
সহায়তা সামগ্রী আসতে শুরু করেছে, তবে কিছু এলাকায় খাবার, পানি এবং আশ্রয়ের মারাত্মক সংকট দেখা দিয়েছে। প্রায় ৮৫% এলাকা এখনও বিদ্যুৎবিহীন এবং মাত্র ২০% ফোন সংযোগ কাজ করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিছু এলাকায় ট্যাপের পানি সরবরাহ শুরু হলেও পরিস্থিতি এখনও কঠিন।
মঙ্গলবার ফ্রান্স থেকে বিমান ও সমুদ্রপথে ২০ টন খাবার ও পানি মায়াত্তে পৌঁছেছে। ফরাসি সরকার সোমবার রাতে জানিয়েছিল, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ৫০% পানি সরবরাহ পুনরুদ্ধার করা হবে এবং সপ্তাহের মধ্যে ৯৫% পুনরুদ্ধার সম্পন্ন হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
রাজধানী মামুদজোর মেয়র আম্বদিলওয়াহেদু সুমাইলা মঙ্গলবার রেডিও ফ্রান্স ইন্টারন্যাশনালকে বলেন, “আজকের অগ্রাধিকার হলো পানি ও খাবার।” তিনি আরও বলেন, “দুর্ভাগ্যবশত বহু মানুষ মারা গেছে, এবং তাদের দেহ পচতে শুরু করেছে, যা স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।”
“আমাদের বিদ্যুৎ নেই। রাতে অন্ধকার নামলে কিছু মানুষ এই পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে।”
স্থানীয়দের বরাতের বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চারিদিকে শুধু ধ্বংসযজ্ঞের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। এটি একটি মহাবিপর্যয়, কিছুই অবশিষ্ট নেই।
জন ব্যালোজ নামে মামৌদজুর এক বাসিন্দা বলেন, ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার সময় তিনি বেঁচে গেছেন দেখে বিস্মিত হয়েছেন। তিনি বলেন, “সবকিছু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, প্রায় সবকিছুই— পানি পরিশোধন কেন্দ্র, বিদ্যুতের খুঁটি, কিছুই অক্ষত নেই”।
মোহামেদ ইশমায়েল নামে মামৌদজুর আরেক বাসিন্দা রয়টার্সকে বলেন, “এই ধ্বংসযজ্ঞ দেখলে আপনার মনে হবে আপনি পারমাণবিক যুদ্ধের পরবর্তী পরিস্থিতিতে আছেন। আমি পুরো একটি আবাসিক এলাকাকে ধসে পড়তে দেখেছি।”
দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজধানী মামুদজোতে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে। স্কুল, হাসপাতাল, রেস্টুরেন্ট এবং অফিস ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ফরাসি আবহাওয়া বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২২০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা (১৩৬ মাইল প্রতি ঘণ্টা) গতির ঝোড়ো হাওয়ায় ঘরবাড়ির ছাদ উড়ে গেছে, আর তালগাছগুলো অর্ধেক ভেঙে পড়েছে।
মঙ্গলবার ম্যাক্সার টেকনোলজিস প্রকাশিত স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা গেছে, রাজধানীর ছাদগুলো ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, জেটি থেকে নৌকাগুলো উধাও, এবং ঘন সবুজ বনাঞ্চল ধ্বংস হয়ে বাদামি হয়ে গেছে। গাছপালাগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছে।
নিহতের সংখ্যা হাজার ছাড়ানোর শঙ্কা
দ্বীপের প্রিফেক্ট ফ্রাঁসোয়া-জেভিয়ার বিউভিল স্থানীয় গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, সম্পূর্ণ ক্ষয়ক্ষতির মূল্যায়নের পর নিহতের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়তে পারে। তিনি সতর্ক করে বলেন, এটি ‘নিঃসন্দেহে কয়েকশো’ ছাড়িয়ে যাবে এবং হাজারে পৌঁছানোর আশঙ্কা রয়েছে।
মায়াত্তের দরিদ্র সম্প্রদায়গুলো, বিশেষ করে অবৈধ অভিবাসীরা যারা আশ্রয়প্রার্থনার উদ্দেশ্যে ফরাসি এই অঞ্চলে এসেছেন, তাদের আবাসনের ভঙ্গুর প্রকৃতির কারণে তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
প্রিফেক্ট আরও বলেন, মুসলিম রীতিতে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মৃতদেহ সমাহিত করার প্রথার ফলে মৃত্যুর সংখ্যা নথিভুক্ত করাও আরও কঠিন হয়ে পড়েছে।
ফরাসি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রুনো রেতাইও বলেছেন, নিহতের প্রকৃত সংখ্যা জানতে অনেক দিন লেগে যাবে।
ঘূর্ণিঝড় চিদো মায়াত্তের পর মোজাম্বিকেও আঘাত হানে। সেখানে এটি পেমবা শহরের উত্তর থেকে প্রায় ২৫ মাইল (৪০ কিমি) দক্ষিণে আকস্মিক বন্যা তৈরি সহ, গাছ উপড়ে ফেলা এবং বাড়িঘরের ক্ষতি করেছে। সেখানেও ৩৪ জনের মৃত্যুর খবরও পাওয়া গেছে।
মোজাম্বিকের কাবো ডেলগাডো প্রদেশ থেকে ড্রোনের মাধ্যমে ধারণ করা ভিডিওতে দেখা গেছে, সৈকতের কাছাকাছি খড়ের ছাউনিযুক্ত বাড়িগুলো সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে, এবং বেঁচে থাকা কয়েকটি তালগাছের নিচে ব্যক্তিগত জিনিসপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। সেখানে ইতিমধ্যেই ইসলামি বিদ্রোহের কারণে মানবিক সংকট চলছে।
চিডো হলো সর্বশেষ প্রাণঘাতী ঝড় যা এত উচ্চ মাত্রার শক্তি নিয়ে তৈরি হয়েছে। চিডো ছিল একটি ক্যাটাগরি ৪ ঘূর্ণিঝড়, যা মাত্রার দিক থেকে দ্বিতীয় শক্তিশালী এবং ১৯৩০-এর দশক থেকে মায়োত্তে আঘাত হানা সবচেয়ে ভয়াবহ ঝড়।
বিবিসি ওয়েদার সেন্টারের সারাহ কিথ-লুকাস জানান, এটি সমুদ্রের উপর দীর্ঘ পথ পার হওয়ার কারণে শক্তিশালী হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়টি মাদাগাস্কারের কঠিন ভূখণ্ডে আঘাত করলে দুর্বল হয়ে পড়ত।
কিথ-লুকাস বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঘূর্ণিঝড়টি এতো শক্তিশালী হয়েছে।
ঝড়টি নিম্নচাপে পরিণত হয়ে মঙ্গলবার রাতে জিম্বাবুয়ের দিকে চলে গেছে। এর প্রভাবে মঙ্গলবার ব্যাপক বৃষ্টিপাত হয়েছে।
ফ্রান্স ১৮৪১ সালে মায়াত্ত দ্বীপপুঞ্জ দখল করেছিল এবং ২০শ শতকের শুরুর দিকে কোমোরস দ্বীপপুঞ্জের তিনটি প্রধান দ্বীপকেও তার বিদেশী অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত করে।
কোমোরস ১৯৭৪ সালে স্বাধীনতা লাভের জন্য ভোট দিলেও মায়াত্ত ফ্রান্সের অংশ হিসেবে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
দ্বীপটির জনগণ ফ্রান্সের আর্থিক সহায়তার ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল এবং দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও রাজনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গে লড়াই করছে।
মায়াত্তের জনসংখ্যার প্রায় ৭৫% দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে এবং বেকারত্ব প্রায় এক তৃতীয়াংশের কাছাকাছি।