বাগান করা যাদের নেশা তারা জানেন এতে কী আনন্দ মেলে। প্রকৃতির সঙ্গে সময় কাটাতে পার্কে হাঁটা এবং ঘর-বারান্দা আর ছাদে গাছ রাখা মানে বাগান করা মনের সুস্বাস্থ্যে খুব ভালো ওষুধ।
গবেষণার বরাতে ইনডিয়া টুডে বলছে, হাসপাতালে যেসব রোগীর কেবিনে ও আশেপাশে গাছ রাখা থাকে তারা কম ব্যথা ও অস্থিরতা অনুভব করে এবং তাদের রক্তচাপ তুলনামূলক স্বাভাবিক থাকে। অর্থ্যাৎ কেবিনে ও আশেপাশে গাছ নেই এমন রোগীর শারীরিক দশা ঠিক উল্টোটাই হয়।
বাগানে সময় কাটানো ও গাছের পরিচর্যা বাগানিদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যে খুব ভালো ফল আনে। এতে আমাদের হৃদযন্ত্র ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে। শুধু তাই না, মন প্রফুল্ল রাখতে ও মনোবল বাড়িয়ে দিয়ে বাগান করার জুড়ি নেই।
বাগানের কাজ, সবুজ পাতা, ফুল-ফল এসব মানসিক চাপ ও অবসাদ কমিয়ে দেয়।
২০২৩ সালে রিডার্স ডাইজেস্ট ম্যাগাজিনের জুন সংখ্যায় সাইকোথেরাপিস্ট জেমি কিটন জোনস বলেছিলেন, “গাছপালা ও সবুজের সংস্পর্শে থাকলে মানসিক স্বাস্থ্যে নানা ভাবে এর ভালো প্রভাব দেখা দেয়।
“যেমন – বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব গড়ে ওঠে, চিন্তাভাবনা সুগঠিত হয়, মগজের দক্ষতা বাড়ে, মন ভালো থাকে।”
গুরুগ্রামের আর্টেমিস হসপিটালের ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট পি ভেনকাটা কৃষ্ণান ইনডিয়া টুডের কাছে বলেন, “বাগানিদের অভিজ্ঞতা বলছে, এতে তাদের অস্থিরতা কমে আসে এবং মন প্রফুল্ল থাকে।”
বাগানের কাজে ডুবে থাকার সময় এন্ডোরফিন হরমোন নিঃসৃত হয়; যা মনকে তৃপ্তি দেয় ও শিথিল রাখে।
আর যে কোনো শখের কাজের মতোই বাগানে সময় ও ধৈর্য বিনিয়োগ করতে হয়।
এই জুনে গাছ রোপনের উৎসাহ সবার মধ্যে একটু বেশি থাকে। আবার জুনে বৃষ্টি হয় বলে গাছপালা বেড়ে ওঠে তাড়াতাড়ি এবং সতেজ থাকে।
বাগানে অনেক গাছই থাকবে। এরমধ্যে বিশেষ সাতটি গাছের কথা বলছে ইনডিয়া টুডে। এসব যাদের আছে তারা জুনে ঠিক মতো যত্ন নিন এবং যাদের বাগানে এই সাতটি গাছ নেই, তারা অবশ্যই সংগ্রহ করে নিন।
স্নেক প্ল্যান্ট
চ্যাপ্টা ও লম্বা পাতার এই গাছ প্রচুর রোদে ভালো হয়। আবার টানা কয়েকদিন ঘরে রেখে দিলেও ভালো থাকে। এই গাছের আরেক নাম সেনসেভিরিয়া। রোদে থাকলে এই গাছে ফুলও আসে। এই গাছের পাতা কেটে আরও চারা করা যায়।
ঘরের বাতাস বিশুদ্ধ রাখার জন্য এই গাছ অনেকের ভীষণ প্রিয়।
জোনস বললেন, “এই গাছের যত্ন নেওয়া খুবই সহজ। কম আলোতেও দীর্ঘদিন ভালো থাকে এই গাছ এবং ঘরের বাতাস তাজা রাখে।”
স্পাইডার প্ল্যান্ট
ঘরের বাতাস বিশুদ্ধ রাখতে বাগানির ভীষণ পছন্দের তালিকায় আছে স্পাইডার প্ল্যান্ট। ঠিক মতো আলো-বাতাস ও সার পেলে টবে লাগানো এই গাছ ঝোপালো হয়ে ওঠে এবং এতে ফুল আসে।
এই গাছ ঘরের সৌন্দর্য বাড়ালেও একটানা দীর্ঘদিন কম আলোতে গাছের পাতা বিবর্ণ হতে শুরু করে। ভালো হয়, একটার বেশি টবে এই গাছ লাগিয়ে বড় করলে। তাহলে একটি টব যখন ঘরে কম আলোতে থাকবে এবং অন্যটি তখন বাইরে পর্যাপ্ত আলোতে; পাঁচ-সাতদিন পর পর ঘরের টব বাইরে এবং বাইরের টব ঘরে এনে রাখলে গাছ সব সময় তাজা থাকবে।
রিডার্স ডাইজেস্টের কাছে নর্থ ক্যারোলিনার এক বাগানি টাইলের কেইথ বলেন, “অনেকে বাথরুমেও স্পাইডার প্ল্যান্ট রাখেন। এতে ভেতরে একটা সুন্দর পরিবেশ গড়ে ওঠে।”
তুলসী গাছ
তুলসী গাছের আরেক নাম বেসিল। সর্দি-কাশির টোটকা হিসাবে বাড়িতে তুলসী গাছ রাখেন অনেকে। আবার মিষ্টি বেসিল পাতাও আছে। এই পাতা রান্নায় দেওয়া যায়। আবার লাল পাতার তুলসী গাছও আছে।
নিউ ইয়র্কের আর্টস অ্যান্ড ইন্টিগ্রেটেড মেডিসিন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক জেনি সেহাম বললেন, “এ ধরনের তৃণ বড় করা, পাতা তোলার খুব ভালো প্রভাব থাকে মনোজগতে।”
তুলসী পাতার রসও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
ল্যাভেন্ডার
অনেক পাউডার, পারফিউম, এয়ার ফ্রেশনার পাওয়া যায় যা ল্যাভেন্ডার ফুলের সৌরভ ছড়ায়। এই ফুলের সুগন্ধ মনের মধ্যে আরামদায়ক আবেশ জাগিয়ে তোলে। ত্বকের যত্নেও ল্যাভেন্ডার তেল পাওয়া যায়। এতে ঘুমও ভালো হয়।
তবে বাংলাদেশের আবহাওয়াতে ল্যাভেন্ডার গাছ বড় করা খুব সহজ নয়। পানি দেওয়ার সময়, রোদ সহনশীলতা এসব খুব খেয়াল করতে হবে এই গাছের পরিচর্যায়।
পুদিনা পাতা
সালাদে, শরবতে এবং আইসক্রিমেও পুদিনা পাতা মেশানো হয়। গরমে পুদিনা পাতা মেশানো কাঁচা আমের জুস, লেবুর শরবত খেলে মন-প্রাণ একেবারে জুড়িয়ে যায়। ডাল কেটে পানিতে রাখলে দ্রুত এতে শিকড় চলে আসে। এরপর টবেই চাষ করা যায় পুদিনা পাতা। সেহাম বললেন, “পুদিনা পাতার সুগন্ধ খুবই চমৎকার হয়।”
মানি প্ল্যান্ট
পোথোস জাতীয় এই লতানো গাছ সবার বাগানেই থাকে। এই গাছ টবে লাগানো যায় আবার বোতল-বয়ামে পানি ভরে তাতেও রাখা যায়। আলো-বাতাসে অনেক পাতা হয়, লতা দ্রুত বাড়ে। তবে কম আলোতেও দীর্ঘদিন ভালো থাকে মানি প্ল্যান্ট।
সার দিলে গাছের পাতা বড় হবে, ঘন হবে; কিন্তু খুব বেশি যত্ন না করে শুধু একটু নিয়ম করে পানি দিলেও এই গাছ ভালো থাকে। ডাল ভেঙ্গে মাটিতে লাগিয়ে দিলে বা পানিতে রেখে দিলে এই লতার শিকড় গজিয়ে যায় খুব দ্রুত।
অনেক ধরনের পাতার মানি প্ল্যান্ট বা পোথোস দেখা যায় বাগানিদের কাছে। ঘরের শোভা বাড়াতে মানি প্ল্যান্ট সবার পছন্দের লতা। আবার ঘরের বাতাস তাজা রাখতেও মানি প্ল্যান্ট অবশ্যই সংগ্রহে থাকা চাই।
অ্যালোভেরা
বাজারে ত্বক ও চুলের যত্নে অ্যালোভেরা দিয়ে ক্রিম, জেল, শ্যাম্পু পাওয়া যায়। আবার প্যাকেটজাত অ্যালোভেরা জুসও পাওয়া যায়। এমনকি গরমে পথে পথে অ্যালোভেরার শরবতও বিক্রি হতে দেখা যায়।
দোকানে অ্যালোভেরা মোটা পাতা কিনতে পাওয়া যায়; যা এনে ত্বক ও চুলের যত্নে ব্যবহার করেন অনেকে। ঘরে মানে বাগানে লাগিয়ে নিলে সব সময় হাতের কাছেই মিলবে এই গাছ।
হাতে পুড়ে যাওয়ার দাগ থাকলে অ্যালোভেরার পাতা নিয়মিত ডলে দিলে ত্বক মসৃণ হয়ে যায়। অ্যালোভেরায় আছে প্রচুর পরিমাণ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট।
পাতা ভেঙ্গে লাগিয়ে দিলেও তাতে শেকড় চলে আসে। মাঝে মাঝে যত্ন নিতে ভুলে গেলেও এই গাছ টিকে থাকতে পারে অনেকদিন। রোদ-বাতাস ও পানি ঠিক মতো পেলে অ্যালোভেরা গাছে ফুল আসে।
বাগান ও মনের লেনদেন
বাগানে গাছ গুছিয়ে রাখলে, খোলামেলা জায়গা রাখলে সেখানে অনেকক্ষণ বসে থাকতে মন চাইবে সবার। হয়তো তখন একটু গান চালিয়ে নিলেন, বৃষ্টি দেখলেন। এসব মনকে চাঙ্গা করবে।
তবে নিজ হাতে বাগান করার অভ্যাস ধরে রাখতে হবে। প্রতিদিন গাছের সঙ্গে দেখা করতে হবে, পাতা-ফুল ও ফল ছুঁয়ে দেখতে হবে।
যারা একেবারে নতুন বাগানি তাদের শুরুতেই অনেক গাছ না রাখাই ঠিক হবে। একবারে অনেক গাছ কিনে হুট করে গাছ মরে গেলে নতুন বাগানির মন দমে যায়। আগে বেছে বেছে অল্প কিছু গাছ সংগ্রহ করে যত্ন নেওয়া, আলো-বাতাসের ফারাক বুঝতে সময় নিতে হবে এমন বাগানিদের।