মুক্তিযুদ্ধ খুবই গুরুত্বপূর্ণ আমাদের অস্তিত্বের এবং পরিচয়ের প্রশ্নের। অনেকেই একটা কথা বলছেন, ২৪ দিয়ে ৭১কে ভূলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটা খুবই ভুল। ২৪ কিংবা ৭১ কোনোটাই সাংঘর্ষিক নয়। দুই জায়গাতেই মানুষ তার অধিকার আদায়ের জন্য নেমে এসেছিল। শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের কোনো দলের ছিল না, এবারও কারও কোনও দল ছিল না। সবাই এক কাতারে এসে দাঁড়িয়েছে। ফলে, যারা এসব গল্প দিচ্ছে তাদের উদ্দেশ্য ভালো না। এখানে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও থাকতে পারে। বাংলাদেশের মানুষের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বিশ্বাস প্রায় সকলেরই ছিল। কিন্তু আওয়ামী আমলে জোরপূর্বক অনেক কিছু করানো হয়েছে। আইন প্রয়োগ করে পতাকা উত্তোলন কিংবা আইন প্রয়োগ করে জাতীয় স্লোগান এসব মানুষের মনে বিরক্তি তৈরি করেছে। এতে মানুষের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এটাকে তখন অনেকেই আওয়ামী লীগের পলিটিক্যাল আইডেনটিটির সঙ্গে মিলিয়ে ফেলছে। এটাই সমস্যা হয়েছে। এখন নিশ্চয়ই সেই অবস্থা থেকে আমাদের উত্তরণ হবে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর দুটি বিজয় দিবস পেয়েছি। আমরা দেখেছি, বেশ ঘটা করে পালন হত। অবশ্য সবই সরকারি বয়ানেই। মুক্তিযুদ্ধের বয়ান খুব কমই থাকত। কিন্তু সেই রকম কোনও আয়োজন এ বছর আমরা দেখি নাই।
এবারের বিজয় আর ১৬ ডিসেম্বর কোনোভাবেই এক নয়। ১৬ ডিসেম্বর তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কিত। মুক্তিযুদ্ধ তো কোনোভাবেই ভুয়া না। পাক হানাদার বাহিনী যে অত্যাচার চালিয়েছে। মানুষ সে সময় ফুঁসে ওঠে, তারপর যুদ্ধ। এগুলো তো কোনোটাই মিথ্যা না। সবই সত্য। ১৯৭১ আর ২০২৪ এ কিছু মিল আছে। ৭১ তো দেখিনি। তবে যেটা বুঝেছি, মানুষ মুক্তি পাবে এই আশাতেই যুদ্ধে গিয়েছিল। কোটা বৈষম্য দূর করার জন্য আমরা আন্দোলন শুরু করেছিলাম। যখন এত ভাই-বোন মারা গেল, তখন তো আর বসে থাকা গেল না। আমরাও মুক্তির জন্য আন্দোলনে নেমে ফ্যাসিস্ট সরিয়েছি। দুই জায়গাতেই দেখেন আমরা আসলে ব্যবস্থা পাল্টানোর জন্যই আন্দোলন করছি। অনেকবারের মতো জাঁকজমকপূর্ণতা এবার কিছুটা কম। এর দোষ তো পূর্ববর্তী সরকারের। মুক্তিযুদ্ধকে মানুষের গল্প বাদ দিয়া নিজেদের গল্প করে ফেলছে। এরজন্য মানুষের রাগও উঠছে এসব নিয়ে। কিন্তু এখন যেহেতু ওই সরকার নাই। এখন মুক্তিযুদ্ধ পালন আমরা আমাদের মতো করতে পারব। সবার উচিৎ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কর্মসূচি করা।
তৎকালীন পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধটি ছিল একটি গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এবং স্বাধীনতা অর্জনের জন্য একটি সামষ্টিক আন্দোলন এবং একটি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। এর মূল দাবি ছিল বাঙালির ন্যায্য অধিকার এবং শোষণমুক্ত স্বাধীন রাষ্ট্র। আর ২০২৪ সালের ‘ইনকিলাব’ দীর্ঘ ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যাপক দুর্নীতি, দমন নীতি এবং শাসন ব্যবস্থার প্রতি জনগণের তীব্র অসন্তোষের কারণে। ইনকিলাবের মূল লক্ষ্য সমাজ বা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা। স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা নয়। মূলত ১৯৭১এর মুক্তিযুদ্ধ ২৪ এর ইনকিলাব বা গণঅভ্যুত্থান উভয়টি ছিল শোষকের শোষণের বিরুদ্ধে। জালেমের জুলুমের বিরুদ্ধে। অত্যাচারী স্বৈরশাসকের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে। একাত্তরে পাঞ্জাবিদের জুলুমে পিষ্ট জনমানুষের আকাঙ্ক্ষা ছিল একটি জুলুমমুক্ত ইনসাফপূর্ণ সমাজ। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এই আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি, তাই চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান ঘটেছে।
একাত্তরের বিজয়কে আমি চোখে দেখিনি, তবে শুনে যতটুকু জেনেছি, তাতে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান এবং অন্যতম প্রত্যাশাই ছিলো স্বাধীনতা। কিন্তু বাকশালতন্ত্র কায়েমে সহযোগিতা করে সেই স্বাধীনতাকে মুক্তিযোদ্ধারাই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে বারবার। আমরা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, তবে দেখেছি মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা কীভাবে বাকশালতন্ত্র কায়েম হয়েছে, দেখেছি মুক্তিযোদ্ধাদের তত্ত্বাবধানে কীভাবে দিনে দিনে তৈরি হয়েছে স্বৈরশাসক। মুক্তিযোদ্ধাদের যেমন অবদান ছিল পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর হাত থেকে দেশকে মুক্ত করা, ঠিক তেমনি ৭১ পরবর্তী সময়ে তাদের ব্যর্থতার দায়ভারও রয়েছে, যা স্বাধীনতাকামী প্রত্যেকটি নাগরিককে হতাশ করেছে। যেসকল মুক্তিযোদ্ধারা দেশকে জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেছে, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা আজন্ম, কিন্তু যে সকল মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা পুনরায় দেশের মানুষ আবার একটি শোষণযন্ত্রের ভেতরে পিষ্ট হয়েছে, তাদের আমরা কোনোদিন ক্ষমা করব না। বরং আমাদের প্রজন্ম তাদেরও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে। কারণ স্বাধীনতার প্রশ্নে দেশের প্রশ্নে কাউকেই ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। মোদ্দাকথায় আমি বলব, তারা দেশপ্রেমের তাগিদে যুদ্ধ করলেও সেই প্রেম লালন করতে পারেনি। তাদের কাছে এখন আর কোনও প্রত্যাশা নেই। এখন যা করার, তরুণরা করবে।
একাত্তরের বিজয় ছিল বাঙালি জাতির জন্য একটি অত্যাবশ্যকীয় বিষয়। পাকিস্তানি রাজনৈতিক সরকার এবং তাদের হানাদার বাহিনীর অত্যাচার নিপীড়ন এবং সর্বক্ষেত্রে বর্তমান বাংলাদেশের মানুষদের ওপর যেই অবিচার প্রতিটি ক্ষেত্রে লক্ষণীয় ছিল, তা থেকে পরিত্রাণ পেতে বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে আসা ছিল আবশ্যক। একটি সুন্দর, সুশৃঙ্খল এবং দুর্নীতিমুক্ত মানবিক দেশ গড়ার স্বপ্ন তারা দেখতেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কিংবা তার কাছাকাছি পরবর্তী সময়ে এগুলোই ছিল বীর যোদ্ধাদের প্রত্যাশা। তারা স্বপ্ন দেখতেন স্বাধীন দেশের, যেখানে বুক ফুলিয়ে নিজের মত প্রকাশ করতে পারবে। এমনটায় জেনে এসেছি ছোট থেকে। এজন্য অনেক গর্ববোধ করতাম। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ শেষে বিজয় এলেও আজ ২০২৪ সালের শেষের দিকে এসেও আসেনি মানুষের প্রত্যাশিত ভূমি। যে ভূমির স্বপ্নে বুকে নিয়ে দেশ গড়েছিল লাখো শহীদ। আজ চার দিকে দুর্নীতি, হত্যা, গুম, রাহাজানিতে সাধারণ মানুষের যেন একটু স্বস্তিতে ঘুমানোর সুযোগ নেই। মুক্তিযোদ্ধারা বিজয় পাওয়ার পর অনেকগুলো কাজ করতে পারতেন, এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য কাজের কথা যদি বলি তাহলে প্রথমেই বলতে হয়, শক্তিশালী ও সৎ রাজনৈতিক নেতৃত্ব গঠন করা, যারা কেবলই কাজ করবে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি উন্নয়ন এবং দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং মানুষের কল্যাণে। মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সহিংস রাজনীতির জন্য। মুক্তিযোদ্ধাদের বেশি আর বেঁচে নেই, তবে যারা আছে তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি সম্মান দিতে হবে। তাদের থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার গল্প শুনে আমাদের মতো তরুণরা যেন দেশ গঠনে ভূমিকা রাখতে পারি, সে সুযোগ বিভিন্ন প্রোগ্রাম আয়োজনের মাধ্যমে করে দিতে হবে।
মাহফুজা খানম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদে এখন পর্যন্ত একমাত্র নারী ভিপি। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের সাবেক এই মহাপরিচালক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের সদস্য, এশিয়াটিক সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক, শিশু সংগঠন খেলাঘর আসরের চেয়ারপারসন। পেয়েছেন একুশে পদক পদক, রোকেয়া পদক, অনন্যা পুরস্কার।
কথা বলতে গিয়ে জানা গেল তার পারিবারিক ঐতিহ্য। ম্যাজিস্ট্রেট দাদা ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের কর্মী, মাস্টারদা সূর্য সেনের শিষ্য, নাম ছিল চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সঙ্গে। চাচা নেতাজী সুভাষ বসুর শিষ্য। বাবা মোস্তাফিজুর রহমান খান করেছেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন। জানালেন, ঢাকায় তাদের ৩৬ নম্বর স্বামীবাগের বাড়িটিতে ছিল রাজনৈতিক, সামাজিক আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্র। সেখানে যেতেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমা, কবি গোলাম মোস্তফা, আহসান হাবিবসহ অনেকে।
১৯৬১ সালে ইডেন কলেজে ভর্তির পর সরাসরি ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। যোগ দেন ছাত্র ইউনিয়নে যুক্ত ছিলেন ১৯৬২-এর হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে। ১৯৬৬-৬৭ সালে রাজনীতির উত্তাল সময়ে ডাকসুর ভিপির দায়িত্ব পালন করেন।
প্রথম শ্রেণিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর করেন পদার্থবিদ্যায়। পেয়েছিলেন কমনওয়েলথ স্কলারশিপ, পেয়েছিলেন যুক্তরাজ্যের সাসেক্স ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সুযোগ। কিন্তু পাকিস্তান সরকারের রোষানলে পড়ায় যেতে পারেননি। কারণ পাসপোর্ট দেওয়া হযনি তাকে। ১৯৬৮ সালে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় প্রথম হয়ে পুলিশ ভেরিভিকশনে ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’ পাননি।
“ফার্স্ট হয়েও চাকরি পাচ্ছি না। কোথাও না। এমননি কোনও স্কুলেও না,” বললেন মাহফুজা খানম। এরমধ্যে এল একাত্তর, শুরু হলো অন্য রকম পথচলা।
১৯৭১ সালের মার্চের শুরুতে দেশজুড়ে উৎকণ্ঠা। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর ঢাকার পাড়ায় পাড়ায় ব্রিগেড তৈরি করা হলো। তাদের কাজ ছিল রাস্তায় রাস্তায় পালা করে পাহারা দেওয়া, হাতে থাকতো স্টিলের লাঠি আর বাঁশি। ভয় ছিল যে কোনও সময় আক্রমণ হতে পারে।
২৫ মার্চ রাতে দায়িত্ব ছিল মাহফুজা খানম আর তার স্বামী শফিক আহমেদের। সন্ধ্যা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত রাস্তায় টহল শেষ করে ঘরে ফেরেন তারা। বড় সন্তানের বয়স মাত্র পাঁচ মাস।
হঠাৎ করেই গোলাগুলি, পুরানা পল্টনের রাস্তা দিয়ে রাজারবাগে সেনা কনভয় যাওয়ার ঘরঘর শব্দ। মাহফুজা বলেন, “তখন তো বড় বড় ভবন ছিল না। বারান্দায় বের হয়ে দেখলাম আকাশ লাল, রক্তলাল। পুরানা পল্টন থেকে একেবারে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছি, ততক্ষণে ইকবাল হল অ্যাটাক হয়ে গেছে, রোকেয়া হল, জগন্নাথ, সলিমুল্লাহ…এই হলগুলো অ্যাটাক করে ফেলেছে তারা। জানালার কাচগুলো ঝরঝর করে ঝড়ে পড়ছে। ছেলেকে নিয়ে খাটের নিচে সারারাত কাটালাম।”
“ভোর হলো। ২৬ মার্চ ছিল কারফিউ, বের হতে পারলাম না। ২৭ মার্চে কারফিউ তুলে নিলে আর ঘরে থাকতে পারলাম না।”
ছেলেকে স্বামীর হাতে দিয়ে এলাকার এক তরুণ রিকশাচালককে নিয়ে বের হলেন মাহফুজা।
“রাস্তায় রাস্তায় আগুন তখনোও ধিকিধিকি জ্বলছে, পোড়া মৃতদেহ…স্তব্ধ হয়ে গেলাম…বুঝতে পারছিলাম না, হোয়াট টু ডু অ্যান্ড হোয়াট নট টু ডু।”
“এখন ভাবি, সেসময় ওরকম দেখে শক্ত ছিলাম কী করে,” বলতে বলতে একটু দম নেন মাহফুজা খানম। তারপর বলেন, “এরপর ধীরে ধীরে যোগাযোগ হতে শুরু করে পার্টির (কমিউনিস্ট পার্টি) সঙ্গে, বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে। পার্টি থেকে ঢাকার দায়িত্ব দেওয়া হলো, সঙ্গে লেখক-সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সারও থাকবেন।”
এরপর মুক্তিযুদ্ধে নামা, যাকে জীবনের আরেকটা অধ্যায় বলছেন মাহফুজা খানম।
“যারা ওদিকে (সীমানা পার হয়ে ভারতে) চলে গিয়েছিল, তারা তো অন্তত জীবন সম্পর্কে…হয়তো খাবার কষ্ট, থাকার কষ্ট…কিন্তু ঢাকাতে আমরা যারা ছিলাম, প্রতি মুহূর্তে বেঁচে রয়েছি কি না, এটা বোঝা যেত না। প্রতি রাতে নক করা হতো। আমাদের এলাকার অনেককে তুলে নিয়ে গেছে। শফিক সাহেব (শফিক আহমেদ) লিস্টে ছিলেন, আমিও লিস্টে ছিলাম।”
পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়া এড়াতে প্রায়ই নিজের বাসায় থাকতেন না মাহফুজা। এলাকার ভেতরের দিকে অন্যদের বাড়িতে চলে যেতেন।
তবে ২৫ মার্চের পর থেকেই তার বারান্দাসহ দুই কক্ষের বাড়িটিতিই মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা-খাওয়া শুরু হয়। কাদের নামের বাবুর্চির কথা মনে করে মাহফুজা বলেন, “সে কোনোদিন বলেনি এত মানুষের রান্না করতে পারব না। ভাত-ডাল, সঙ্গে একটা তরকারি। কেউ দুপুরে, কেউ রাতে আসত খেতে। মোমবাতির আলোয় তারা খেত। কারণ আলো দেখলেই অ্যাটাক হতো।”
মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়ানোর পাশাপাশি তথ্য আদান-প্রদানের কাজে নেমে পড়েন মাহফুজা।
“ওদিক থেকে চিঠি আসছে, সেগুলো পৌঁছে দিতে হতো এদিকে। এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের হরলাল দাদা সাহায্য করতেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের ল্যাবরেটরি থেকে প্রয়োজনীয় রাসায়নিক দ্রব্য নিতে রহমান ভাই খুব সাহায্য করেছেন, এখানে নানা ধরনের বিস্ফোরক দ্রব্য তৈরি করতাম, নটর ডেম কলেজের ফাদাররা আমাদের সাহায্য করেছে…তখন পূর্ব পাকিস্তানে যারা ছিল, প্রত্যেকটা মানুষ ছিল মুক্তিযোদ্ধা।”
সেসময়ে এক ঘটনা স্মরণ করে মাহফুজা বলেন, “একবার সাইক্লোস্টাইল করে ইশতেহার নিয়ে হচ্ছি, কনভয় যাচ্ছে পাশ দিয়ে। নটর ডেমের কলেজের পাশ দিয়ে নালা ছিল অনেক বড়। সেখানে লাফ দিলাম, সেই পানির মধ্যে ছিলাম যতক্ষণ না কনভয়ের শব্দ শেষ হচ্ছিল। এক একটা দিন এমনও গিয়েছিল।” এছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অর্থ সংগ্রহের দায়িত্ব ছিল মাহফুজার। সে অর্থ পাঠাতে হতো নানা জায়গায়। এই কাজ হতো মাহফুজা খানমের বাবা মুস্তাফিজুর রহমান খানের জিন্নাহ এভিনিউর (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ) বিমা অফিসে।
এসব কাজ করতে করতে সরাসরি লড়াইয়েও নেমে পড়তে হয় মাহফুজা খানমকে।
“বড় দুটো অপারেশনে আমি যুক্ত ছিলাম। টিভি টাওয়ার অপারেশনে যুক্ত ছিলাম। পায়ে বেঁধে, গায়ে বেঁধে বিস্ফোরক রেখে এসেছিলাম সেখানে। আরেকটি ছিল সেগুন বাগিচার মোড়ে ইউএসআইএস লাইব্রেরি, সেখানেও বড় একটা অপারেশন করেছিলাম।” কিন্তু এর মূল্য তাকে দিতে হয়েছে। বড় দুই ভাই ধরা পড়ল।
“আমার বাড়ি থেকেই দুই ভাইকে ধরা হলো…আমার মায়ের অবস্থা…এটা বলতে পারব না। আব্বাকে পুলিশ-আর্মিরা ঘিরে ধরে নিয়ে গেল। সবকিছু তছনছ হয়ে গেল …এগুলো বলে এখন আর লাভ নেই। আমরা যে অনেক কিছু করতে পেরেছি, তা নয়, কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য ছিল জানান দেওয়া…আমরা, মুক্তিযোদ্ধাা আছি…অ্যাক্টিভ আছি।”
যারা যুদ্ধে গিয়ে আহত কিংবা অসুস্থ হয়ে আসতেন, তাদেরকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতেন মাহফুজা। “ঠেলা গাড়িতে করে মাথায় কাপড় দিয়ে ছাতা মাথায় কখনও বোন, কখনও স্ত্রী সেজে কাঁদতে কাঁদতে নিয়ে যেতাম…অভিনয় যে কত করেছি! হাতিরপুলে ডা. আজিজুর রহমানের ছিল পলি ক্লিনিক। সেখানে নিয়ে আহতদের চিকিৎসা করাতাম। পলি ক্লিনিক সেসময় ভীষণভাবে সহযোগিতা করেছে। সেসময় যে কতবার ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে আসছি, এত বছর পরে এখন আর মনেও নেই।”
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের সাক্ষীও মাহফুজা খানম।
“আমি ভীষণ ভাগ্যবান। ঢাকা ক্লাবের উল্টো দিকেই তো পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করল। ঢাকা ক্লাবের ছাদে উঠে আমি সব দেখেছি, আমি খুব গর্বিত ছিলাম সেসমসয়। নিজের চোখে সব দেখতে পাচ্ছি।”
তবে যে ত্যাগের বিনিময়ে এসেছে স্বাধীনতা, তা ধরে রাখা গেল না কেন, সেই প্রশ্নে মাহফুজা বলেন, “মুক্তিযুদ্ধকে অবহেলা করার জন্য যারা ছিল …জামায়াতে ইসলামী, পাকিস্তান, আমেরিকা, চায়নাও…এদের নানামুখী তৎপরতা ছিল…যে তৎপরতার লিগ্যাসি এখন আমরা দেখছি। আমি জানি না, এই বাংলাদেশ কোথায় যাবে?”
এই সংশয়ের কালন ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “বুদ্ধিজীবী হত্যা কারা করেছে? জামায়াত। তারা আজ প্রতিটি পত্রিকায় বক্তব্য দিচ্ছে। এখনকার রাজনীতিতে বড় ভুমিকা রাখছে তারা। তাহলে এই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কী হবে?
“যারা মুক্তিযুদ্ধকে মেনে নিতে পারে নাই…জামায়াত এবং অন্য যারা ছিল, তারা তখন থেকেই দৃঢ়ভাবে অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। শফিকুর রহমান (জামায়াত আমির) এখনও বলে, ‘আমরা ভুল করি নাই’। অনেক উত্থান-পতন হয়েছে দেশে। বলা হয়, স্বাধীনতা ঘোষক জিয়া (মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান)। কিন্তু জিয়া ঘোষণাপত্র পাঠ করেছে। অন বিহাফ অব শেখ মুজিব বলেছে। ২৬ মার্চ রাতে যখন তিনি গ্রেপ্তার হন, তখন তিনি ঘোষণা দিয়েছেন। এই যে বঙ্গবন্ধুকে নেগলেক্ট করা, তার সমকক্ষ তৈরি করা, ইতিহাসকে বিকৃত করার চেষ্টা হলো…”
এই দায় আওয়ামী লীগকেও দিচ্ছেন মাহফুজা খানম।
তিনি বলেন, “আমি যখন ডাকসুর ভিপি, তখন শেখ হাসিনা (পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী) মিছিলে আমার পেছনে হাঁটা মেয়ে। অনেক পথ গেছে আওয়ামী লীগ। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এক ধরনের ভিশন ছিল। যেমন বঙ্গবন্ধু হত্যা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হলো…রায় হলো, রায়ের বাস্তবায়ন হলো। কিন্তু এরপর থেকে আওয়ামী লীগের পথ পরিবর্তন হলো। কেন ডানপন্থিদের সঙ্গে তাদের এত সখ্য তৈরি হলো? যেখানে সংবিধানে ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা বলা হয়েছে, সেখানে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গে এত সখ্য! কত কত মসজিদ হলো।
“মাদ্রাসা শিক্ষায় সিলেবাস কী আমরা জানি না, কী পরীক্ষা, কী ফল-জানি না। অথচ মাস্টার্সের সমতূল্য করা হলো। সরকারি কর্ম কমিশনসহ বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রতিযোগিতা করে তারা প্রশাসনসহ বিভিন্ন জায়গায় আসছে।” শিক্ষা ব্যবস্থায় গলদের কথা তুলে ধরে শিক্ষায় একুশে পদক পাওয়া মাহফুজা খানম বলেন, “এত হিযবুত তাহরীর কোথা থেকে এল? জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার একমাত্র পথ শিক্ষা, কিন্তু সেটা করা হয়নি।
“পাঁচ আগস্টের পর থেকে আবার প্রতিটি জায়গায় ধর্মভিত্তিক দলের মানুষদের বসানো হচ্ছে। যার মগজে, মননে বিশ্বাসে একটা জায়গার চিন্তা-এটা আমাদের সংবিধানের সঙ্গে যায় না, মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যায় না।”
আওয়ামী লীগ সরকারে স্বামী শফিক আহমেদের আইনমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, “শফিক সাহেবের ইচ্ছা ছিল না মন্ত্রী হওয়ার। প্রথমে শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা তাকে ডেকে নিয়ে মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দেন। এরপর আইনজীবীসহ অন্যদের ইচ্ছার কাছে তাকে (শফিক আহমেদ) হার মানতে হয় ।”
মন্ত্রী হলেও বাড়তি কোনও সুবিধা শফিক আহমেদ নেননি দাবি করে মাহফুজা বলেন, “মন্ত্রী হওয়ার পর প্রথম দিনই দুপুরবেলা হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল থেকে খাবার নিয়ে আসল। কিন্তু শফিক আহমেদ সে খাবার প্রত্যাখ্যান করেন; জানান যে বাড়ির থেকে আনা রুটি আর ভাজি খাবেন। পুরো পাঁচ বছর তিনি বাড়ি থেকে নেওয়া রুটি আর ভাজি খেয়েছেন সচিবালয়ে বসে।
“মন্ত্রী হওয়ার পর তার পতাকাওয়ালা গাড়িতে আমার ছেলেরা কেউ ওঠেনি। আমরা কেউ কখনও তার গাড়িতে উঠতে পারিনি। এটা একদম রেস্ট্রিকটেড ছিল।”
তার বিপরীতে মন্ত্রী-এমপিরদের অর্থ-বিত্তের পাহাড়ের খবরের প্রতিক্রিয়ায় হতাশা প্রকাশ করে মাহফুজা খানম বলেন, “এখন শুনি মন্ত্রী, এমপিদের হাজার হাজার কোটি টাকা, বিদেশে বাড়ি-গাড়ি কতকিছু। এটা তো আমি মানতে পারি না, মেলাতে পারি না কোনোভাবেই।”
“এখন আমার ৭৯ বছর চলছে। আমার ৬০ দশক পুরোটা গিয়েছে রাস্তায়, এমনকি কিছুদিন আগ পর্যন্ত ছিলাম। কিন্তু এই বাংলাদেশ চাইনি আমি, আমরা,” বলেন মাহফুজা খানম।
একাত্তরের বিজয় নিজ চোখে দেখা হয়নি আমার। তবে বাবার মুখে বিজয়ের গল্প শুনেছি। তার কাছ থেকে বিজয়ের গল্প শুনে যেটি আমার উপলব্ধি হয়েছে, সেটা হলো বিজয়টি আমাদের জন্য অবশ্যই গৌরবের ছিল। তার থেকে বড় বিষয় যেটি ছিল সেটি হলো স্বাধীনতা। পরাধীনতার শিকল ভাঙ্গা। তখন সবাই স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিল স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার। সবাই ভেবেছিল, এবার হয়ত মিলবে অর্থনৈতিক মুক্তি, স্বাধীনভাবে ব্যবসা করার স্বাধীনতা, সবার জন্য উন্নত চিকিৎসা, উন্নত শিক্ষা। কিন্তু এর কোনোটিই বাঙালি পায়নি। স্বাধীনতা ঠিকই পেয়েছি, কিন্তু বৈষম্য হয়েই রয়েছে। স্বাধীনের পর মুক্তিযোদ্ধারা চাইলে আত্মকেন্দ্রিক চিন্তাধারাটা বদলাতে পারত। সবাই যে আত্মকেন্দ্রিক চিন্তা করেছে, এমনটা নয়। তবে বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধারা সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছেন। তারা সবসময় নিজের ঘড়া ভর্তি করার চিন্তা করেছেন। যার ফলে দেশে জন্ম নিয়েছে নোংরা রাজনীতির। তারা চাইলে এই জায়গাগুলো থেকে নিজেদের সরিয়ে রেখে দেশ গঠনে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারতেন। তারা সবাই নেতা হতে চেয়েছেন, কিন্তু কেউ দক্ষ কর্মী তৈরি করতে পারেননি। যার ফলে দেশে নোংরা রাজনীতি টেনে এনেছেন তারা। অনেকেই অমত পোষণ করবেন জানি। কিন্তু এটাই বাস্তব। রাজনীতির খারাপ অধ্যায় শুরু হয়েছে বিজয়ের পর থেকেই। এখন মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে কোনও চাওয়া-পাওয়া নাই আমার। কারণ তাদের এখন করার তেমন কিছুই নাই, মোটিভেশন স্পিচ দেওয়া ছাড়া। তাই এখন এগিয়ে আসতে হবে তরুণদের। তাদের জানতে হবে বাঙালি বহির্বিশ্বের তুলনায় কতটা পিছিয়ে আছে চিন্তা ধারায়। উপায় বের করতে হবে কীভাবে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে নিজের দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়।
বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অনন্য অধ্যায় ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধ। এ দেশের গণমানুষের গণতান্ত্রিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের জন্য এক ঐতিহাসিক সংগ্রাম। এ যুদ্ধে বিজয় বাংলাদেশের জনগণের জন্য ছিল স্বাধীনতার প্রতীক এবং বিশ্বের বুকে একটি নতুন মানচিত্রের আত্মপ্রকাশ। সেই সময় মানুষের প্রত্যাশা ছিল সামাজিক ন্যায়বিচার, অর্থনৈতিক সাম্য এবং সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা অর্জন। একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র জন্ম নিল ঠিক, কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, প্রত্যাশার সেই উচ্চতা পূরণ হয়েছিল কি? যার উত্তর পাওয়া যায় যুদ্ধ-পরবর্তী অর্থনৈতিক সংকট, রাজনৈতিক টানাপড়েন এবং দুর্নীতির প্রভাব পরিলক্ষণ করে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাঙালির স্মৃতিতে অমলিন, চিরদিন। তবে ৭১ এর পর পরই যেন, চেতনা চুরির কায়দায় নেমে ফায়দা লুটে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল। শীর্ষ রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে বাকশালী কায়দায়, এদিকে দেশে শুরু হয় দূর্ভিক্ষ। শুধু ক্ষুধার দুর্ভিক্ষ নয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক সকল প্রেক্ষাপট থেকেই দুর্ভিক্ষ প্রতীয়মান হতে থাকে। বর্তমান প্রেক্ষাপটেও চোখে ধুলো দেওয়া অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সমাজের বৈষম্য ও প্রতিটা পদে দুর্নীতি সমাধানে সরকারের কোনও সদিচ্ছা দেখা যায় না। এদেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় কেবল অতীতের গৌরব নয়, বরং একটি দৃষ্টান্ত যা এদেশের জনসাধারণকে অনুপ্রাণিত করে বারবার, যে আদর্শ বাংলাদেশি জনগণের আত্মপরিচয়ের ভিত্তি, যে ঐক্যে এক হয়ে এখনও জুলাই অভ্যুত্থানের মতো এক বৃহৎ বিপ্লব ঘটাতে পারে এ বাঙালি জাতি। জুলাই বিপ্লব এবং বিশ্বজুড়ে চলমান গণতান্ত্রিক আন্দোলনগুলোর আলোকে বলা যায়, মুক্তিযোদ্ধাদের চেতনা এবং তাদের সংগ্রাম এখনও প্রাসঙ্গিক। এক্ষেত্রে বিবেচনায় রাখতে হবে যে, মুক্তিযোদ্ধারা জাতির গর্ব এবং প্রেরণার উৎস হলেও তাদের প্রকৃত অবস্থান অনেক ক্ষেত্রে অনাদর ও অবহেলার শিকার। যুদ্ধপরবর্তী প্রজন্মের কাছে তাদের অবদান তথ্যবহুল ও সঠিকভাবে তুলে ধরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল আমাদের ইতিহাসের এক শানিত ও গৌরবময় অধ্যায়, যা আমাদের স্বাধীনতা এবং আত্মমর্যাদার প্রতীক। একাত্তরের বিজয় বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রামের এক অবিস্মরণীয় স্মারক, যেখানে দেশের সব শ্রেণি, পেশা, ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষ একত্রিত হয়ে বীরত্বের সঙ্গে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। তখনকার জনগণের প্রত্যাশা ছিল মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটি সুখী, সমৃদ্ধ এবং অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়া। তবে স্বাধীনতার পর থেকে, দেশে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা, দুর্নীতি এবং বৈষম্য বেড়ে যাওয়ায় মানুষের প্রত্যাশার তুলনায় বাস্তবতা অনেকাংশেই পরিবর্তিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই এমন এক সমাজে বসবাস করছেন, যেখানে তাদের অবদান যথাযথভাবে মূল্যায়িত হয়নি। তাদের যে সম্মান পাওয়ার কথা ছিল, তা তারা অনেক জায়গায় পায়নি। মুক্তিযুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকারি ও সামাজিক স্বীকৃতির অভাব এবং তাদের জীবনযাত্রার মান অনেক সময় অবহেলিত ছিল। যদি মুক্তিযুদ্ধের বীরেরা আরও বেশি সুযোগ এবং সহায়তা পেতেন, তবে হয়তো দেশে অনেক উন্নয়নমূলক কাজ আরও দ্রুত করা সম্ভব হত। এই মুহূর্তে আমাদের উচিৎ মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানিত করা, তাদের অবদান সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা এবং তাদের জন্য আরও সুবিধা নিশ্চিত করা, যেন আগামী প্রজন্ম তাদের সংগ্রামের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা জানাতে পারে। একাত্তরের বিজয়ের পরের সময়টা আরও কার্যকরী এবং উপকারী হতে পারত যদি মুক্তিযোদ্ধাদের উন্নয়নের অংশীদার হিসেবে সক্রিয়ভাবে নিয়ে যাওয়া হতো। তাদেরকে দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন এবং নেতৃত্বের ক্ষেত্রে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিৎ ছিল। কিন্তু সময় এখনও চলে যায়নি, তাদের থেকে তরুণদের শিখতে হবে, মনের মধ্যে দেশকে ভালোবাসার অসীম শক্তি ধারণ করতে হবে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাংলাদেশের জন্য এক গৌরবময় অধ্যায়, যেখানে জাতি একত্রিত হয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। তখন মানুষের প্রত্যাশা ছিল একটি শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ এবং সাম্প্রদায়িকতামুক্ত দেশ গঠন। কিন্তু স্বাধীনতার পর দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি প্রত্যাশার চেয়ে অনেকটা ভিন্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীনতার পর পর্যাপ্ত সম্মান, সুযোগ এবং স্বীকৃতি পাননি। তাদের অবদান যথাযথভাবে মূল্যায়িত হয়নি এবং তাদের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত হয়নি, যা তাদের জীবনযাত্রার মানকে প্রভাবিত করেছে। মুক্তিযুদ্ধের বীরেরা আরও সাহায্য ও মর্যাদা পেলে হয়ত দেশে আরও দ্রুত উন্নয়ন সম্ভব হতো। বর্তমানে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করা উচিৎ, এবং তাদের জন্য আরও সুযোগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তাদের সম্মানিত করা এবং তাদের সংগ্রামের গুরুত্ব নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা দেশের দায়িত্ব।
গত ১৫ বছর ধরে মুক্তিযুদ্ধ আওয়ামী লীগের সম্পত্তিই বনে গিয়েছিল একপ্রকার। ফলে দেখা যেত, বিজয় দিবস বা স্বাধীনতা দিবসের মতো আমাদের এত গুরুত্বপূর্ণ দিবসগুলো সরকারিভাবেই আরোপিত হতো মানুষের উপর আওয়ামী লীগের স্তুতি দিবসের মতো করে। এইবার তা ঘটে নাই, নানান মানুষের মনে নানান শঙ্কা শেষে আমরা দেখতে পেলাম যে সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফুর্তভাবেই বুদ্ধিজীবী দিবসে স্মরণ করছেন শহীদ বুদ্ধিজীবীদের, বিজয় দিবসের আমেজ, আনন্দ কোনও জোর-জবরদস্তি ছাড়াই সকল খানে। এইবারের বিজয় দিবসটা ভিন্ন, কারণ এবারের বিজয় দিবসটা আমাদের, জনগণের। একটা স্বৈরাচার হটানোর পর, বা আন্দোলনের সময়জুড়েই আমরা প্রত্যেকে বারবার স্মরণ করেছি, ধারণ করেছি আমাদের মুক্তিযোদ্ধা পূর্বসূরিদের। বিজয় দিবসের দ্বারপ্রান্তে আমরা, একটা রক্তক্ষয়ী বছর শেষে আমাদের আকাঙ্ক্ষা আমার মনে হয় না ৭১ এর চেয়ে ভিন্ন কিছু। বৈষম্যহীন সেই বাংলাদেশের জন্য বাংলা বারবার বুক পেতে দেয়, তাই আমি বাস্তবায়িত দেখতে চাই। শিক্ষা খাত থেকে শুরু করে জীবনের যত পর্যায়ে যত প্রকারের শোষণের সম্মুখীন হতে হয় আমাদের দেশের মানুষের, তার বিলুপ্তির ভাবনাই এইবার আমাদের এই বিজয় দিবসে।
সাক্ষাৎকার : জাকিয়া আহমেদ, অনিক রায়, মেরিনা মিতু | প্রচ্ছদ : মোতাসিম বিল্লাহ পিন্টু