অভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন দিয়ে যাওয়ার কথা জানালেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ জামান।
তিনি বলেছেন, “আমরা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও অন্তর্বর্তী সরকারের সফলতার জন্য সবকিছু করতে প্রস্তুত আছি এবং প্রস্তুত থাকব।”
রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের পাঁচ মাস পর দৈনিক প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে একথা বলেন সেনাপ্রধান। বুধবার সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছে।
অতীতের মতো সেনাবাহিনী রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করবে না বলে আশ্বস্ত করেছেন জুলাই অভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা জেনারেল ওয়াকার।
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার ওপর জোর দেওয়ার পাশাপাশি নির্বাচন, সংস্কার নিয়েও কথা বলেছেন তিনি। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনার পক্ষে তিনি মত দিয়েছেন।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের আন্দোলন রক্তাক্ত পথ পেরিয়ে অভ্যুত্থানে রূপ নিলে গত ৫ আগস্ট দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা।
সেদিন সেনাপ্রধান ওয়াকারে মুখ থেকেই সর্বপ্রথম জানা গিয়েছিল যে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়েছেন এবং এখন একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হবে।
সেনানিবাসে বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনার পর তিনি একথা জানিয়েছিলেন। পরে রাষ্ট্রপতির জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণের সময়ও বঙ্গভবনে ছিলেন জেনারেল ওয়াকার।
অভ্যুত্থানের পাঁচ মাস পর দেওয়া এই সাক্ষাৎকারে জেনারেল ওয়াকার বলেন, ড. ইউনূস যেভাবেই চাইবেন, সেভাবেই সেনাবাহিনী তাকে সহযোগিতা করার চেষ্টা করবে। তাতে বাহিনীর অসুবিধা হলেও সহযোগিতা থেমে থাকবে না।
“আমরা চেষ্টা করব, প্রধান উপদেষ্টা যেভাবেই আমার বা আমাদের সাহায্য চাইবেন, আমরা সেভাবেই উনাকে সহযোগিতা করব। এটাতে যদি আমাদের অসুবিধা হয়, সৈনিকদের যদি সাময়িক অসুবিধাও হয়, তারপরও সরকারকে সহযোগিতা করে যাব।”
দেশ ও জাতির স্বার্থেই সেনাবাহিনী যেকোনো ত্যাগ স্বীকার করতে তৈরি বলেও জানান তিনি।
সামরিক বাহিনীর রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের পক্ষে নন জানিয়ে জেনারেল ওয়াকার বলেন, “অতীতে সেনাবাহিনী রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছে। এটা কখনও ভালো ফল বয়ে আনেনি।
“এজন্যই আমার অঙ্গীকার হচ্ছে, সেনাপ্রধান হিসেবে নিজের মেয়াদকালে আমি রাজনীতিতে নাক গলাব না। আমি সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে হস্তক্ষেপ করতে দেব না। এটাই আমার স্পষ্ট অঙ্গীকার। আমরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, রাজনীতিবিদের বিকল্প রাজনীতিবিদরাই। তাদের বিকল্প সেনাবাহিনী নয়।”
কয়েক মাস আগে বিদেশি সংবাদমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আগামী নির্বাচনের সময় নিয়ে কথা বলেছিলেন সেনাপ্রধান। তা নিয়ে আলোচনাও উঠেছিল। পরে গত ১৬ ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস দেড় বছরের মধ্যে নির্বাচনের একটি ধারণা দেন।
নির্বাচনের এই সময়কেই ঠিক মনে করছেন সেনাপ্রধান। তিনি বলেন, “দেশবাসী অবশ্যই একটা ভালো নির্বাচন চায়। সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর নির্বাচন চায়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান লক্ষ্যও সেটা। প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের সময়সীমা দিয়েছেন। সেটা ঠিক সময়। আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বাচনের রূপরেখা বাস্তবায়নে সব সহযোগিতা করব।”
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাও দেয় অন্তর্বর্তী সরকার।
সেই ক্ষমতা সেনাবাহিনী কতটুকু প্রয়োগ করছে- সেই প্রশ্নে জেনারেল ওয়াকার বলেন, “আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমরা তুলনামূলকভাবে পর্যালোচনা করে দেখেছি, সেনাবাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা প্রয়োগের পরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা নিয়ে যতটা হতাশ মনে হচ্ছে কাউকে কাউকে, এতটা হতাশ আমি না।”
পরিস্থিতির উন্নতিতে সবার নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের ওপর জোর দিয়ে সেনাপ্রধান বলেন, “এখানে পুলিশের ভূমিকা রয়েছে, প্রশাসনের আছে, সরকারের ভূমিকা আছে। সেনাবাহিনী কাজ করে যাচ্ছে। সাধারণ জনগণেরও তো ভূমিকা রয়েছে।
“সবার সামগ্রিক প্রয়াসের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হবে। এটা আমাদের সবাইকে সবসময় মনে রাখতে হবে। আমরা একজনের ঘাড়ের ওপর দোষ চাপিয়ে বলি সরকার, বলি পুলিশ বা বলি সেনাবাহিনী দায়ী, এটা করা যাবে না। এখানে তো সবার একটা ভূমিকা আছে।”
অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেওয়ার পর সংবিধান, নির্বাচন, বিচার বিভাগ, পুলিশ, দুর্নীতি দমন কমিশন, জনপ্রশাসনসহ রাষ্ট্রের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সংস্কারের লক্ষ্যে কমিশন গঠন করা হয়।
সেনাপ্রধানও মনে করেন, সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। বিশেষ করে সংবিধান সংস্কার করে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা দরকার।
তার পরামর্শ, রাষ্ট্রপতির অধীনে কাজ করবে সশস্ত্র বাহিনী। তেমনটা হলে শাসনব্যবস্থায় ভারসাম্য আসবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কারের পদক্ষেপ রাজনৈতিক দলগুলো আদৌ ইতিবাচকভাবে দেখছে কি না, এক্ষেত্রে তাদের মনোভাব কী- এ প্রশ্নের জবাবে জেনারেল ওয়াকার বলেন, “আমি আশাবাদী। রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে ভালো রাজনীতিবিদ রয়েছেন। হয়ত ভিন্নমতের মানুষও আছেন। আমার অতীত অভিজ্ঞতা বলে, যখন এমন একটা ক্রান্তিকাল আসে, আমাদের রাজনীতিবিদদের সঙ্গে বসলে তারা সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসেন।”
সংস্কারের বিষয়ে তিনি বলেন, “একটা সুশৃঙ্খল পরিবেশের মধ্যে সবকিছু যদি ঠিক হয়ে যায়, তাহলে দীর্ঘমেয়াদে অনেকেই তো এই পরিবর্তনের সুফল ভোগ করবেন। রাজনীতিতে বিরোধী দল বিরাট এক সহায়ক শক্তি। সরকার এবং বিরোধী দল একে অন্যের পরিপূরক।
“গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় শক্তিশালী বিরোধী দল থাকা গুরুত্বপূর্ণ। এমন প্রক্রিয়া থাকলে একে অন্যের ভুল ধরিয়ে দিতে পারে। সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য থাকে। সবাই তাদের পরিধির মাঝে থেকে দায়িত্ব পালন করে যেতে পারেন। এটা তো একটা দেশের জন্য খুবই প্রয়োজন।”
অন্তর্বর্তী সরকারকে সময় দিতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে সেনাপ্রধান বলেন, “বর্তমানে জটিল ও কঠিন একটা সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশ। এই মুহূর্তে নিজেদের দাবি-দাওয়াগুলো আমরা যেন সীমিত রাখি। সরকারকে বিরক্ত না করি। তাহলে সেটা আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সাহায্য করবে।
“ধৈর্য ধারণ করি। ব্যবসায়ী, শিল্পোদ্যোক্তাদের জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিৎ। এটা মুনাফার সময় নয়। চিরাচরিত প্রথার বাইরে গিয়ে কিছু করাটা জরুরি। কারণ, দেশ তো এক কঠিন পথে চলেছে। কাজেই আসুন, এ সময় আমরা সবাই মিলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সহায়তা করি; যাতে তারা সংস্কারগুলো শেষ করে নির্বাচনের দিকে যেতে পারে। আমরা যেন তাদের ওপর বোঝা না চাপাই।”
সাক্ষাৎকারে সেনাপ্রধানকে ভারত নিয়েও প্রশ্ন করা হয়। বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন ও সীমান্তে উত্তেজনাসহ দু’দেশের মধ্যকার অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে তার বক্তব্য জানতে চাওয়া হয়।
সেনাপ্রধানের মতে, ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক ন্যায্যতার ভিত্তিতে হওয়া উচিৎ।
তিনি বলেন, “ভারত আমাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী। আমরা অনেক দিক থেকে ভারতের ওপর নির্ভরশীল। আবার ভারতও আমাদের কাছ থেকে সুবিধা পাচ্ছে। আনুষ্ঠানিক আর অনানুষ্ঠানিক মিলিয়ে ওদের প্রচুর মানুষ বাংলাদেশে কাজ করছে। এ দেশ থেকে অনেক মানুষ চিকিৎসার জন্য ভারতে যায়। আমরা তাদের কাছ থেকে অনেক পণ্য কিনছি।
“কাজেই বাংলাদেশের স্থিতিশীলতার ব্যাপারে ভারতের বিরাট স্বার্থ আছে। এটা একটা দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্ক। ন্যায্যতার ভিত্তিতে হতে হবে এটা। যেকোনো দেশ সব সময় অন্য দেশ থেকে সুবিধা পেতে চাইবে। এটা তো দোষ না। আমি যদি আদায় করে নিতে না পারি, দোষ তো আমারও। এই বিষয়গুলো দেখতে হবে।”
“আমাদের ন্যায্যতার ভিত্তিতে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলতে হবে। জনগণ যেন কোনোভাবেই মনে না করে ভারত বাংলাদেশের ওপর কর্তৃত্ব করছে বা এমন কিছু করছে, যা আমাদের স্বার্থের পরিপন্থী। কোনোভাবেই মানুষ যেন এটা না ভাবে,” বলেন তিনি।
ভারতকে সীমান্তে হত্যা বন্ধের আহ্বান জানিয়ে সেনাপ্রধান বলেন, “আমার প্রতিবেশীর সঙ্গে আমি এমন কিছু করব না, যেটা তাদের কৌশলগত স্বার্থের পরিপন্থী হয়। একই সঙ্গে আমার দিক থেকে প্রত্যাশা থাকবে যে প্রতিবেশীও আমার সঙ্গে এমন কিছু করবে না, যা আমার স্বার্থের পরিপন্থী। আমি যখন তাদের স্বার্থ দেখব, তারাও আমার স্বার্থটা সমান গুরুত্বের সঙ্গে দেখবে।
“আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিতিশীলতা তৈরি হবে না। স্থিতিশীলতা নষ্ট হবে না মিয়ানমার সীমান্তেও। সীমান্তে আমাদের লোকজনকে হত্যা করবে না। আমরা ন্যায্য হিস্যার পানি পাব। এতে তো কোনো অসুবিধা নেই। সম্পর্কটা ন্যায্যতার ভিত্তিতে হোক।”
প্রতিরক্ষা সহযোগিতার প্রেক্ষাপটে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে জেনারেল ওয়াকার বলেন, “চীন আমাদের উন্নয়নের অংশীদার। বাংলাদেশে তাদের অনেক বিনিয়োগ আছে। কাজেই চীন আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চীনের অনেক সমরাস্ত্র আমরা ব্যবহার করছি। বিমানবাহিনী ব্যবহার করছে। নৌবাহিনী ব্যবহার করছে। তাদের সমরাস্ত্র তুলনামূলকভাবে সস্তা।”
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক বজায় রেখে চলার কথা বলেন তিনি।
“সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়- আমাদের এই পররাষ্ট্র নীতি চমৎকার। আমাদের ভারসাম্য রেখে এগিয়ে যেতে হবে।”