Beta
বুধবার, ৩ জুলাই, ২০২৪
Beta
বুধবার, ৩ জুলাই, ২০২৪

ভারতকে রেল করিডোর দেওয়া দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি : বিএনপি

রবিবার গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর 
ভারতের সঙ্গে এমওইউ নিয়ে দলের এই সিদ্ধান্তের কথা জানান।
রবিবার গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভারতের সঙ্গে এমওইউ নিয়ে দলের এই সিদ্ধান্তের কথা জানান।
Picture of প্রতিবেদক, সকাল সন্ধ্যা

প্রতিবেদক, সকাল সন্ধ্যা

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে যে ১০টি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়েছে, তা ‘গোলামির নবতর সংস্করণ’ বলে অভিহিত করে এসব এমওইউ প্রত্যাখান করেছে বিএনপি। দলটি বলছে, ভারতকে রেল যোগাযোগে করিডোর দিলে তাতে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে।  

রবিবার বিকালে ঢাকার গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলের এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে এমওইউগুলোর নানা দিক তুলে ধরেন।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, “জনগণের ভোটাধিকার হরণকারী বর্তমান অবৈধ মাফিয়া সরকার প্রধান শেখ হাসিনা ভারতের সাথে ১০টি সমঝোতা স্মারক সই করেছে, তা গোলামির নবতর সংস্করণ। কানেক্টিভিটির নামে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের এক অংশ থেকে আরেক অংশ পর্যন্ত রেল যোগাযোগের নামে করিডোর প্রদানের মাধ্যমে যা করা হয়েছে, তাতে আমাদের সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তা মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে।

“আপনাদের নিশ্চয়ই ১৯৭২ সালের ভারতের সাথে স্বাক্ষরিত ২৫ বছরের চুক্তির কথা স্মরণ আছে। ৫২ বছর পর সে ধারাবাহিকতায় গত ২২ জুন ভারতের সাথে সমঝোতার আড়ালে যেসকল চুক্তি করা হলো, তা বাংলাদেশকে আজীবনের জন্য ভারতের গোলামে পরিণত করবে। এর ফলে আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা বিপন্ন হবার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আমরা পুনর্ব্যক্ত করতে চাই, সার্বভৌমত্ব, জাতীয় নিরাপত্তা বিরোধী এই সকল চুক্তি জনগণ কখনও মেনে নেবে না। বিএনপি এই সকল দেশবিরোধী চুক্তি-সমঝোতা প্রত্যাখান করছে।”

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় গত ২২ জুন দুই দেশের মধ্যে ১০টি এমওইউ সই হয়েছে। সেদিন নয়া দিল্লির রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন হায়দরাবাদ হাউসে দুই দেশের প্রতিনিধি পর্যায়ে বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উপস্থিতিতে এমওইউগুলো সই হয়।  

সুনীল অর্থনীতি ও সামুদ্রিক সহযোগিতা, রেলওয়ে কানেক্টিভিটি, সক্ষমতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য, একাডেমিক সহযোগিতা, মৎস্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সই হওয়া সমঝোতা স্মারকগুলোর মধ্যে সাতটি নতুন ও তিনটি পুরনো, যেগুলো নবায়ন করা হয়েছে।

এর আগে দুই দেশের প্রতিনিধি পর্যায়ের বৈঠকে মূলত যোগাযোগ, জ্বালানি, অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, সামুদ্রিক সম্পদ, বাণিজ্য, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তা ও উন্নয়ন অংশীদারত্বের বিষয়ে আলোচনা হয়।  

‘এসব দেশের জন্য বিপজ্জনক’

ভারতের সঙ্গে হওয়া সমঝোতার স্মারকগুলোর বিভিন্ন বিষয় দেশের স্বার্থের সম্পূর্ণ বিরোধী বলে উল্লেখ করেন মির্জা ফখরুল।

তিনি বলেন, “এসব সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে আমাদের দেশের প্রতিরক্ষা ও জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি ভারতের জাতীয় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তার অংশে পরিণত করা হয়েছে, যা খুবই বিপজ্জনক এবং দেশের স্বাধীনতার প্রতি হুমকি। এটি শান্তির সহাবস্থান ও জোট নিরপেক্ষ নীতির পরিপন্থী।

“বস্তুত এই সকল সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে নিরাপত্তার কৌশলগত ‘বাফার স্টেট’ হিসেবে ভারতকে ব্যবহারের সুযোগ দিতে চায়। এর ফলে বাংলাদেশ নিশ্চিতভাবে আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার জটিলতার মধ্যে জড়িয়ে পড়বে।”

যে ৭টি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে, সেগুলোর প্রায় সবই দেশের উত্তরাঞ্চল কেন্দ্রিক বলে জানান বিএনপি মহাসচিব।

তিনি বলেন, “প্রয়োজনের সময়ে বাংলাদেশ ভূখণ্ডকে ভারতের সামরিক ও বেসামরিক পণ্য পরিবহনের জন্য কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ‘চিকেন নেক’কে বাইপাস করে ব্যবহার করার সুদূরপ্রসারী মহাপরিকল্পনা থেকেই এসব চুক্তি করা হয়েছে বলে আমরা মনে করি। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে জলাঞ্জলি দিয়ে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে দীর্ঘ মেয়াদে ভারতের গোলামি চুক্তির গভীর ফাঁদে ফেলার সেই ঘৃণ ষড়যন্ত্রের লিপ্ত হয়েছে।”

‘দেশের প্রাপ্তি শূন্য’

মির্জা ফখরুল বলেন, “নানা নাম দিয়ে যে দশটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হলো, তাতে বাংলাদেশের প্রাপ্তি শূন্য। দেশের স্বার্থ সংরক্ষণের চাইতে ভারতের কাছে শেখ হাসিনার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দায়বদ্ধতা থেকে এসব স্মারক সই হয়েছে, তা জনগণের কাছে স্পষ্ট। এগুলোর সাথে বাংলাদেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণের ন্যূনতম সংশ্লিষ্টতা নেই।

“সেই কারণেই বহু পূর্বে ভারত ঘোষিত সাড়ে ৭ বিলিয়ন ডলারের ভারতীয় চুক্তি (লাইন অব ক্রেডিট- এলওসি) বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া তরান্বিত করার বিষয়ে এই সফর (শেখ হাসিনার সফর) ছিল নিরব। ডলারকে পাশ কাটিয়ে ভারতীয় মুদ্রায় বাণিজ্য পরিচালনার বিষয়ে উঠে এসেছে আলোচনায়; অথচ বাংলাদেশের রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের অন্যতম প্রধান মুদ্রাই হচ্ছে মার্কিন ডলার।”

“এভাবে একতরফা আগ্রাসী বাণিজ্যে বাংলাদেশকে ভারতের বাজারে পরিণত করা হয়েছে। ট্র্যারিফ, নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ার পরিহার করে বিপুল বাণিজ্যিক ঘাটতি কাটিয়ে উঠার কিছুই এসব সমঝোতায় স্থান পায়নি,” বলেন ফখরুল।

‘তিস্তা চুক্তি হলো না’

মির্জা ফখরুল বলেন, “এবারে সরকার প্রধানের সফরে তিস্তার পানি প্রবাহ বৃদ্ধি এজেন্ডাতেই ছিল না। অথচ এটাই হওয়া উচিত ছিল সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। ২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরকালে তিস্তা চুক্তি হওয়ার কথা থাকলেও আজ পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন হয়নি। এরপর গত ১৪ বছরে তিস্তা শুকিয়ে মরুভূমিতে পরিণত হলেও এই সংকটের সমাধান হয়নি।

“এহেন অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার লক্ষ্যে তিস্তা পানি সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্প গ্রহণ করা হলো। প্রশ্ন হলো, যাদের বিমাতাসুলভ আচরণের কারণে তিস্তার ন্যায্য পানি থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হচ্ছে, সেই তাদেরকেই তিস্তার পানি ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত করলে তা যে স্বার্থ সাংঘর্ষিক ও আত্মঘাতী, সেটা দেশের মানুষ বোঝে।”

তিনি বলেন, “তিস্তা প্রকল্প নিয়ে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার বর্তমান অবৈধ সরকার প্রকারান্তরে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের উপর অর্পণ করেছে বলে প্রতীয়মান হয়, যা বর্তমান গণবিচ্ছিন্ন সরকারের নতজানু পররাষ্ট্র নীতির বহিঃপ্রকাশ।”

তিস্তার পানি অভাবে অসহায় মানুষের আর্তনাদ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী রসিকতা করেছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন বিএনপি মহাসচিব।

সীমান্ত হত্যা বন্ধ নিয়ে সরকারের ভূমিকারও সমালোচনা করেন বিএনপি মহাসচিব। তিনি বলেন, “বিএসএফের গুলিতে প্রতিবছর রেকর্ড পরিমাণ সীমান্ত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হবার পরও প্রধানমন্ত্রীর সফরে এ বিষয়টি বাংলাদেশ সরকার চূড়ান্তভাবে নির্লিপ্ত থেকেছে। ভারত-নেপাল, ভারত-চীন ও ভারত-পাকিস্তান সীমান্তেও এই পরিমাণ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটতে দেখা যায় না। কিন্তু বাংলাদেশে অহরহ সীমান্তে হত্যা হচ্ছে।”  

সব সমঝোতা জনসমক্ষে প্রকাশের দাবি

মির্জা ফখরুল বলেন, “এবার শেখ হাসিনার ভারত সফরটি কার্যত ছিল একপাক্ষিক। এই সফরে স্বাক্ষরিত কিংবা চুক্তি বাংলাদেশের ন্যূনতম স্বার্থ সুনিশ্চিত করে না। সামরিক সহযোগিতার নামে জাতীয় নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। ইতিপূর্বে আদানির সাথে বিদ্যুৎ আমদানির অন্যান্য চুক্তি, জ্বালানি ও বিদ্যুতের মতো অধিকতর কৌশলগত পণ্যের জন্য ভারতের ওপর নির্ভরশীলতা করে তোলার চলমান উদ্যোগ দেশবাসী এবং আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ মহল গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছে।

“ঢাকা ও দিল্লি নতুন যাত্রা শুরু করেছে, উভয় দেশ দেশ রুপকল্প ২০৪১ ও ভারত ২০৪৭ অনুসরণ করে একটি স্মার্ট বাংলাদেশ নিশ্চিত করার জন ভবিষ্যতের কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হয়েছে- শেখ হাসিনার এই বক্তব্যের মাধ্যমেই তার ভারত সফরের প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে, যা দেশবাসী গভীরভাবে উপলব্ধি করেছে বলে বিএনপি বিশ্বাস করে। আমরা এই সফরসহ ভারতের সাথে ইতিপূর্বে স্বাক্ষরিত সকল চুক্তি জনসমক্ষে প্রকাশের দাবি জানাচ্ছি।”

দেশের স্বার্থ ঠিক রাখতে হবে

মির্জা ফখরুল বলেন, “বিশ্বায়ন ও মুক্ত বাজার অর্থনীতির এই যুগে সব বন্ধু রাষ্ট্রের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা, বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অংশীদারত্ব বাড়াতে নানাভাবে কানেক্টিভিটি তৈরি করার পক্ষেই বিএনপির অবস্থান। কিন্তু সড়কপথ, নৌপথ বা রেলপথে যেভাবে কানেক্টিভিটি বাড়ানো হোক না কেন, তাতে জাতীয় স্বার্থকে বিবেচনা করতে হবে সর্বাগ্রে।

“কোনোভাবেই সার্বভৌমত্বের সাথে কম্প্রোমাইজ করা যাবে না। কিন্তু বর্তমান অবৈধ শেখ হাসিনার সরকার অবৈধ ক্ষমতা অটুট রাখার হীন স্বার্থে জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে।”

সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ইসমাইল জবিউল্লাহ ও জহির উদ্দিন স্বপন উপস্থিত ছিলেন।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত