পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের অ-ক্রান্তীয় অঞ্চলে ২ হাজার বছরের মধ্যে সবচেয়ে উষ্ণ ছিল ২০২৩ সালের গ্রীষ্মকাল।
ইউরোপ, এশিয়া ও উত্তর আমেরিকার এই বিশাল এলাকাজুড়ে প্রথম খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৯০ সালের মধ্যকার গ্রীষ্মের গড় তাপমাত্রার তুলনায় ২০২৩ সালের জুন, জুলাই ও আগস্টের তাপমাত্রা ২.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল।
নেচার সাময়িকীতে গত মঙ্গলবার প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে এই দাবি করা হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তন বৈশ্বিক ঘটনা হলেও আঞ্চলিক পর্যায়ে উষ্ণায়ন আরও বেশি মাত্রায় হতে পারে। আর আমরা মূলত আঞ্চলিক জলবায়ু পরিবর্তনই অনুভব করি, বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা নয়।
২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে এবং ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। জলবায়ু বিপর্যয় রোধে বিজ্ঞানীরা এই সীমা বেঁধে দিতে বলেছিল।
কিন্তু নতুন এই গবেষণায় দাবি করা হচ্ছে, আঞ্চলিক পর্যায়ে উত্তর গোলার্ধে গ্রীষ্মের তাপমাত্রা এরই মধ্যে সেই সীমা ছাড়িয়েছে।
২০১৮ সালে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করলে তীব্র তাপপ্রবাহ, সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি এবং বন্যপ্রাণীর মৃত্যুর মতো ভয়াবহ সব প্রাকৃতিক বিপর্যয় স্থায়ী হয়ে যাবে।
যুক্তরাজ্যে ২০২৩ সালের গ্রীষ্মে পাঁচটি তাপপ্রবাহে ২ হাজার ২৯৫ জন মানুষ মারা যায়। গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের মাধ্যমে মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে এল নিনো যুক্ত হয়ে এত বেশি গরম পড়েছে। এল নিনো হল প্রশান্ত মহাসাগরের প্রাকৃতিক জলবায়ু চক্রের একটি উষ্ণতর পর্যায়।
সাম্প্রতিক অতীতে জলবায়ু কেমন ছিল, তা খুঁজে বের করার জন্য বিজ্ঞানীরা সাধারণত বিভিন্ন দেশের আবহাওয়া স্টেশনের রেকর্ডগুলো বিশ্লেষণ করে। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি সময়ের তাপমাত্রার রেকর্ড আছে যুক্তরাজ্যের কাছে, যাকে সেন্ট্রাল ইংল্যান্ড টেম্পারেচার সিরিজ বলা হয়। এতে ১৬৫৯ সাল পর্যন্ত তাপমাত্রার রেকর্ড পাওয়া যায়।
নতুন গবেষণায় বিজ্ঞানীরা অতীতের তুলনায় ২০২৩ সালের গ্রীষ্ম উত্তর গোলার্ধে কতটা অস্বাভাবিকভাবে উষ্ণ ছিল, তা বের করার জন্য হাজার বছরের পুরোনো বনের গাছগুলোকে কাজে লাগিয়েছেন। গাছের ভেতরে যে রিং বা বলয় তৈরি হয়, সেগুলো পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা হাজার বছরের তাপমাত্রার রেকর্ড বের করেছেন।
দুই হাজার বছর আগের তুলনায় বর্তমান তাপমাত্রা কতটা বেশি, তা জানতে বিজ্ঞানীরা গাছের গুঁড়ি ছাড়াও মেরু অঞ্চলের বরফের স্তর ও পলির মতো প্রাকৃতিক সংরক্ষণাগারগুলোও পর্যবেক্ষণ করেছেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জমা হওয়া বরফ ও পলির স্তরগুলো থেকেও জলবায়ুর অবস্থা বের করা যায়।
গাছ বিশ্বের অনেক অংশের অতীত জলবায়ুর তথ্য সংবেদনশীলভাবে সংরক্ষণ করে। মৌসুমী জলবায়ুতে গাছে বছরে একটি করে রিং তৈরি হয়, তাই কোনও রিং গঠিত হওয়ার সময়কাল নিয়ে কোনও সন্দেহ থাকে না।
অতীতের জলবায়ু বোঝার জন্য বিজ্ঞানীরা কোনও বছরে একটি গাছের রিংগুলো কতটা প্রশস্ত বা সরু, কাঠ কতটা ঘন এবং এর রাসায়নিক গঠন বিশ্লেষণ করেন।
গাছের রিং জলবায়ু পরিবর্তনের নানা দিকের প্রতিই সংবেদনশীল। তবে উত্তর গোলার্ধের কনিফার প্রজাতির গাছগুলোর ভেতরে বলয় তৈরিতে গ্রীষ্মের তাপমাত্রা সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে। কারণ ওই অঞ্চলে ঠাণ্ডা তাপমাত্রা, উচ্চ বাতাস বা কম আর্দ্রতার কারণে গাছগুলো বেশি বাড়তে পারে না। গ্রীষ্মে তাপমাত্রা বেশি হলে এই জাতীয় গাছগুলোতে প্রশস্ত, ঘন রিং তৈরি হয়।
বিজ্ঞানীরা উত্তর আমেরিকা ও কানাডা, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপ, স্ক্যান্ডিনেভিয়া, রাশিয়া, মঙ্গোলিয়া ও জাপানের শত শত স্থানে হাজার হাজার গাছের বলয় পরীক্ষা করে দেখেছেন।
এই বিশাল গাছের বলয়ের আর্কাইভ থেকে জানা যায়, ২০২৩ সালে উত্তর গোলার্ধের গ্রীষ্মকালের তাপমাত্রা খ্রিস্টাব্দ ১ থেকে ১৮৯০ সালের গড় তাপমাত্রার চেয়ে ২.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল। আর গত দুই হাজার বছরের শীতলতম বছর ৫৩৬ সালের তুলনায় ৪ ডিগ্রি বেশি ছিল।
এর আগে গত ফেব্রুয়ারিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) জলবায়ু পর্যবেক্ষক কোপার্নিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিস বা সি৩এস জানিয়েছিল, বিশ্বে প্রথমবারের মতো প্রাক-শিল্প যুগের তুলনায় ১২ মাসের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়েছে।
২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ১২মাসে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা শিল্পযুগের আগের সময়ের (১৮৫০-১৯০০ সাল) চেয়ে ১ দশমিক ৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল বলে জানায় সি৩এস।
ভবিষ্যতের বন কী দেখাবে
বর্তমান হারে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন অব্যাহত থাকলে পৃথিবীতে আরও ঘন ঘন চরম আবহাওয়ার ঘটনা ঘটবে। অতীতে কোনও বছরে সাধারণত এল নিনোর সক্রিয়তার সময় বেশি অস্বাভাবিক তাপমাত্রা দেখা যেত, ২০১৬ সালে যেমনটা দেখা গিয়েছিল।
কিন্তু গ্রিন হাউস গ্যাসের মাত্রা বেশি হওয়ায় এখন এল নিনোর বিপরীত সময়েও অস্বাভাবিক বেশি তাপমাত্রা দেখা যায়। যেমন, ২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো এল নিনোর বিপরীত লা নিনার সময়ও তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেশি ছিল। লা লিনা সাধারণত বৈশ্বিক তাপমাত্রার উপর শীতল প্রভাব ফেলে।
নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৩ সাল এমনকি ২০১৬ সালের রেকর্ডটিও ভেঙে দিয়েছে। ২০২৩ সালের তাপমাত্রা ২০১৬ সালের এল নিনোর ফলস্বরূপ অতি উত্তপ্ত গ্রীষ্মের চেয়েও ০.২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল। গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনের পরিমাণ এখন এত বেশি যে, এখন তাপমাত্রা এক লাফে অনেক বেশি বাড়ে।
উত্তর গোলার্ধের যে পাহাড়ি বনগুলো থেকে এই গবেষণার জন্য গাছের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে, সেগুলো ক্রমেই আরও কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা ভবিষ্যতে আবার বনগুলোতে গেলে দেখতে পাবেন যে অনেক জায়গায় তাপ ও খরার চাপে থাকা গাছগুলো মৃত্যুর পথে রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় ২০১২ ও ২০১৬ সালের মধ্যে এক খরাতেই ২০ কোটির বেশি গাছ মারা গিয়েছিল। ফ্রান্সে গত এক দশকে গাছের মৃত্যু ৮০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। অতি উষ্ণ খরার কারণে বিশ্বজুড়েই এই প্রবণতা দেখা গেছে।
স্থলভাগে বসবাসকারী জীববৈচিত্র্যের ৮০ শতাংশই ধারণ করে বন-জঙ্গল এবং প্রায় ১৬০ কোটি মানুষের জীবন-জীবিকাও বনের ওপর নির্ভরশীল। এছাড়া বনের গাছ-পালা বিশ্বব্যাপী জলবায়ুকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং বাতাস থেকে কার্বন শুষে নেয়। গাছগুলো ধীরে ধীরে তাদের ভেতরে বিপজ্জনক জলবায়ু পরিবর্তন থামাতে মানুষের ব্যর্থতার রেকর্ডও তৈরি করে।
২০২৩ সালের চরম উত্তাপ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় অবিলম্বে পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তাই তুলে ধরছে। যদি পৃথিবীকে দ্রুত কার্বনমুক্ত করা যায়, তাহলে ভবিষ্যতের বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর অবশিষ্ট বনের গাছগুলোর রিং রেকর্ডে জলবায়ু পুনরুদ্ধারের প্রমাণও দেখতে পাবেন।
তথ্যসূত্র : নিউ ইয়র্ক টাইমস, রয়টার্স, আর্থ ডটকম, দ্য কনভারসেশন