জুলাই-আগস্টে আন্দোলনে যে গণহত্যা চলেছে, তার দায়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার পক্ষে নন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের।
শেখ হাসিনার কর্মকাণ্ডের দায় দলের অন্যরা কেন নেবে—এ প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের কোনও নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনও অভিযোগ থাকলে তার বিচার করা যায়।
সোমবার ঢাকার বনানীতে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন জি এম কাদের।
তিনি বলেন, “যখন আওয়ামী লীগ সরকারের সময় জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার কথা উঠেছিল, আমি বলেছিলাম রাজনৈতিক কোনও দলকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে নই। এটা বহুদলীয় গণতন্ত্র। সুনির্দিষ্ট কোনও অভিযোগ থাকলে, সেই দল যদি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকে, রাষ্ট্রবিরোধী দল হলে সেগুলো নিষিদ্ধ করতে পারেন।
“এ ধরনের কোনও কর্মকাণ্ড না করে থাকলে সেই দল নিষিদ্ধের দায়ভার নিজের কাঁধে না নিয়ে এর দায়ভার জনগণের ওপর দেওয়া ভালো। এটা বলেছিলাম জামায়াতের সময়—জনগণ যদি ওদেরকে প্রত্যাখ্যান করে প্রত্যাখ্যান করুক। কিন্তু এদেরকে যদি আপনি রাজনীতি করতে না দেন, যাদের কিছু না কিছু সমর্থন আছে, সংগঠন আছে, তারা আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকুক। এবং দেশে একটি স্থিতিশীল রাজনীতি থাকুক। সবাই মিলে আমরা দেশ চলব।”
জাপা চেয়ারম্যান বলেন, “কাজেই আমি কোনও দলকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে নই। এটাও সত্য যে, শেখ হাসিনা যেটা করেছে তার দায়ভার আওয়ামী লীগের সব নেতা-কর্মীর ঘাঁড়ে পড়ে না। আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেক আওয়ামী লীগের নেতার সঙ্গে কথা বলেছি, (ছাত্র আন্দোলনের সময়) তখনও বলেছিলাম। তারা এর বিরুদ্ধে ছিল। শেখ হাসিনার কার্যকলাপ তারা সহ্য করতে পারছিল না।
“আন্দোলনের সময় আমি খেয়াল করেছি, অনেকে (আওয়ামী লীগের) যেকোনোভাবেই হোক, প্রচ্ছন্নভাবে হোক, এই আন্দোলনের সফলতা কামনা করেছে। তাদের অবদানকে আমরা যেন ভুলে না যাই।”
“আগেরবার বিএনপি-জামায়াতকে বাদ দেওয়ার যে রাজনীতি করলাম, এখন আবার সেই একই ধরনের রাজনীতি হলে এটার তো কোনও সমাধান হলো না।”
আওয়ামী লীগের মতো বিচারের মাধ্যমে অবিচার যেন না হয়, সেই আহ্বান জানিয়েছেন জি এম কাদের।
তিনি বলেন, “চলুন আমরা এক হই। ঐক্যবদ্ধ হই। একটি ঐক্যবদ্ধ শক্তি হিসেবে দেশ গঠনে কাজ করি। যদি কারও অপরাধ থাকে, তার বিচার করেন। বিচারের মাধ্যমে অবিচার করবেন না।
“আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বিচারব্যবস্থাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার একটি দুর্নাম ছিল। এখনও বিচারব্যবস্থাকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহারের কিছু কিছু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। যেটার জন্য আমরা সরকারকে দোষারপ করছি না। বিভিন্ন ধরনের মানুষকে হয়রানি করার জন্য বিচারব্যবস্থাকে ব্যবহার করা হচ্ছে।”
৭ মার্চ দিবস বাদ দেওয়ার বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন—সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে জি এম কাদের বলেন, “ইতিহাসকে ইতিহাসের জায়গায় রাখা উচিৎ। গত সরকারের আমলেও ইতিহাস বিকৃত করার একটি মনোভাব আমরা দেখেছি। এটার আমি প্রতিবাদ করেছিলাম। ইতিহাসকে শুধু বিকৃত করেছিল তা নয়, আইন করে ইতিহাস সঠিক করার কাজটিও বাঁধা দেওয়া হয়েছে।
“আমি মনে করি, ৭ মার্চ আমি ওই মিটিংয়ে ছিলাম; বাঙালি জাতির বড় ধরনের একটি আবেগের স্থান। এটা আমি খারাপ কিছু মনে করি না। ওটা একটি ঐতিহাসিক দিবস। ওটাকে ওভাবেই রাখা উচিৎ।”
আওয়ামী লীগ সরকারকে তিনি প্রথম স্বৈরাচার ও কর্তৃত্ববাদী সরকার হিসেবে সমালোচনা করেছেন বলে দাবি করেন জি এম কাদের।
সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের শাসনামলে দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে বলে অভিযোগ করেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান।
তিনি বলেন, জাতীয় পার্টি একটি দিনের জন্যও ছাত্রদের আন্দোলনে বিপক্ষে ছিল না। এসময় তিনি জুলাইয়ের প্রতিটি দিনের ঘটনা প্রবাহ নিয়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশনের খবরে প্রকাশিত রেফারেন্স তুলে ধরেন।
জি এম কাদের বলেন, “আমাদেরকে বলা হচ্ছে আমরা দোসর। আমরা ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগের পরপর তিনটি নির্বাচনে অংশ নিয়ে ওই নির্বাচনে বৈধতা দিয়েছি। এ কথাগুলো সত্য নয়। আমরা নির্বাচনে গিয়েছি, এটা সত্য।
“আমার কোনও কোনও নির্বাচনে আমাদের সকল প্রার্থী যায়নি, নির্বাচনে অংশ নেয়নি—সেটাও সত্য। আমাদেরকে যেভাবে নির্বাচনে যেতে বাধ্য করা হয়েছে, সেটাও দেখতে হবে।”
“সামরিক হাসপাতালে তখনকার চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদকে এক রকম আটকে রেখে নির্বাচনে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। যেকোনো সময় জীবন চলে যেতে পারে, এরকম একটি পরিস্থিতিতে তিনি (এরশাদ) আমাকে বলেছিলেন, আমি চাই নির্বাচন বর্জন করতে।”
“আমরা যে পরিস্থিতিতে নির্বাচনে গিয়েছি সেই ধরনের পরিস্থিতিতে অনেকে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে কি না—তা নিয়ে আমাদের সন্দেহ আছে” বলেন জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান।
তিনি বলেন, “আমরা কখনই আওয়ামী লীগের দোসর ছিলাম না। আমি নিজে সংসদে দাঁড়িয়ে সরকারের কাজের অনেক সমালোচনা করেছি। আমরা চেয়েছি রাজনীতির মাধ্যমে জনগণকে সেবা দিতে। আমরা তখন নির্বাচনে না গেলে আমাদের দল থাকতো না। দল না থাকলে আমাদের রাজনীতি থাকতো না। এ কারণে আমরা জনগণের সেবা করার জন্য, দলকে টিকিয়ে রাখতে তখন তাদের সঙ্গে নির্বাচনে যাই। তবে আমরা কোনোভাবেই টিক মার্কের নির্বাচনের পক্ষে ছিলাম না।”
অন্তবর্তী সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপে জাতীয় পার্টিকে ডাকা হয়নি; তাতে কোনও অভিযোগ নেই বলে মন্তব্য করেন জি এম কাদের।
তিনি বলেন, “তবে আমাদের শাস্তিমূলকভাবে এই সংলাপ থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে, এ ধরনের কথা বলবেন না। আমরা চাই এই সরকার তার তাদের উদ্দেশ্যগুলো পূরণে সফল হোক।”