Beta
রবিবার, ৭ জুলাই, ২০২৪
Beta
রবিবার, ৭ জুলাই, ২০২৪

রিভিউ: পরিণত পলিটিকাল থ্রিলার ‘গোলাম মামুন’

golammamubn-hoichoi-230624-02
Picture of আইরিন সুলতানা

আইরিন সুলতানা

ছোট পর্দার রোমান্টিক নায়ক জিয়াউল ফারুক অপূর্ব ওয়েব সিরিজের জগতে আসেন ২০২৩ সালে। ওই বছর তানিম রহমান অংশু পরিচালিত ‘বুকের মধ্যে আগুন’ সিরিজটি মুক্তি পায় হইচই-তে। সিরিজে মৃত্যু রহস্য ভেদ করার দায়িত্ব চাপে এএসপি গোলাম মামুনের উপর। ‘বুকের মধ্যে আগুন’ এর সেই গোলাম মামুন চরিত্রটিকে তুলে এনেছেন পরিচালক শিহাব শাহীন। মিডিয়া পাড়ায় এমন কাজের কারিগরি পরিভাষা হলো ‘স্পিন-অফ’।

সেই গোলাম মামুনের নতুন গল্প নিয়ে আট পর্বের পলিটিকাল থ্রিলার হইচই-এ দেখা যাচ্ছে ১৩ জুন থেকে।

দেশে পলিটিকাল অ্যাকশন সিনেমা নতুন কিছু নয়। পলিটিকাল অ্যাকশনে ভরপুর কাজী হায়াৎ-মান্না জুটির একাধিক ব্যবসা সফল বড় পর্দার সিনেমা রয়েছে। সেসব সিনেমায় নির্বাচন নিয়ে রাজনীতিকদের কূটচাল, সন্ত্রাস, ক্ষমতার অপব্যবহার উঠে এসেছে। যদিও সেই সময় মূল ধারার সিনেমায় ছিল কারিগরি সীমাবদ্ধতা আর অ্যাকশনে গতানুগতিক মান।

আজকের দিনে প্রযোজক ও নির্মাতার কারিশমায় সিনেমায় কারিগরি উন্নতি এসেছে অনেকখানি।  শিল্পীদের লুক, অভিনয়, অ্যাকশন, কালার গ্রেডিং মিলিয়ে সিনেমা পরিবেশনার খোলনলচে পাল্টেছে। অভিনয় শিল্পীরাও নিজেদের ইমেজ ভাঙ্গার সুযোগ পাচ্ছেন ওয়েব সিরিজে। এই যেমন, অপূর্ব তার ‘লাভার বয়’ ইমেজ থেকে বেরিয়ে ভরাট কণ্ঠের ওজনদার অ্যাকশন হিরো হয়েছেন ‘গোলাম মামুন’ ওয়েব সিরিজে।  

সিনেমার শুরু দিকে এক বাড়িতে গিয়ে অচেনা শক্রুপক্ষের আক্রমণের মুখে পড়েন গোলাম মামুন। এই মারপিটে অপূর্বকে খুব শক্তিশালী ও পাকা মনে হয়েছে। ভরাট মুখে দাঁড়ি ও ঘন চুলে তাকে ভারতের দক্ষিণী সিনেমার নায়কের মতোও লেগেছে। পরের দিকে চুল হালকা ছেঁটে নিলে অপূর্বর ‘মাচো ম্যান’ আবেদন আরও বেড়ে যায়। তবে একটি ধাওয়া দৃশ্যে স্লো মোশনে দৌড়াতে থাকা অপূর্বকে সামনে থেকে ভারী শরীরের মনে হয়েছে। বাকি সময় অপূর্বকে পুলিশ চরিত্রে আনফিট মনে না হলেও একজন সহকারী পুলিশ সুপার মানে এএসপি পদের একজনের শারীরিক ভারিক্কি আরেকটু কমিয়ে রাখলে ভালো লাগবে।  

হালকা ওজন, পাতলা মুখ এবং জিরো-মেকআপ লুকে সাবিলা নূরকে জুনিয়র পুলিশ কর্মকর্তার চরিত্রে চমৎকার লেগেছে। টিভিমুখ সাবিলা নূরও তার প্রেমিকা সুলভ চরিত্র থেকে বেরিয়ে অফিসার রাহী হয়ে উঠেছেন। যে কোনো উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে জিহ্বার ডগা দিয়ে ভেতর থেকে গাল উঁচু করে রাখে রাহী। একটি চরিত্রের আচরণ নির্মাণে এই সংযোজন খুব সূক্ষ্ণ। নির্মাতা শিহাব শাহীন না কি সাবিলা নূর নিজেই রাহী চরিত্রের এমন মুদ্রাদোষ নিয়ে ভেবেছেন?

গোলাম মামুন ও রাহী চরিত্রের একটি হাতাহাতি দৃশ্য রয়েছে। অপূর্বের সঙ্গে সাবিলা নূরের এই মারপিট হলিউড সিনেমায় অ্যাকশন দেখে অভ্যস্ত দর্শককের থেকেও প্রশংসা কুড়াবে। এবারের সিরিজের শেষ দৃশ্য বলছে রাহী চরিত্রটি পরের সিজনে বড় টক্কর হয়ে আসবে।         

চাইলে ‘গোলাম মামুন’ কাহিনীতে অনেক ভুল ধরা যাবে। ফেরারি গোলাম মামুনকে আটকাতেই পুলিশ বিভাগের পুরো মনোযোগ দেখা গেছে। খুনের ঘটনার সুরাহায় হাতে থাকা প্রমাণ দিয়ে বড় কোনো চমক না আনতে পারা পুলিশ বিভাগের ব্যর্থতা। আবার এর অর্থ এমনও করা যায়, উপর মহলের চাপ সামলাতে গোলাম মামুনকে আটকে রাখা ছাড়া অসহায় প্রশাসনের এই বিভাগ; তাতে প্রকৃত তদন্ত থেকে মনোযোগ সরে গেলে যাক।

রাহী সারাক্ষণ গোলাম মামুনকে সঙ্গ দিচ্ছে অথচ পুলিশের দপ্তর থেকে রাহীকে খোঁজা হচ্ছে না; কাজের জবাবদিহি চাওয়া হচ্ছে না। পুলিশের আরেক কর্মকর্তা রবিন ফোনে আড়ি পেতে গোলাম মামুন ও তার আপার কথা শোনে বারবার। এই কথোপকথন শুনে খুনের ঘটনার তদন্তে পুলিশের আরও ছোঁক ছোঁক করার কথা; কিন্তু পুলিশ বিভাগ এখানে শ্লথ ছিল। এসব নিয়ে সমঝদার দর্শকের উসখুস লাগলেও, কাহিনী এভাবেই আগায়। যদিও হলিউড-বলিউডের বহু হিট সিনেমায় এমন হাজারো ভুল ধরা যাবে; খুব সম্ভবত পরিচালক-কাহিনীকার মিলে সিনেমায় নতুন মোড় ও মোচড় আনার সুযোগ নিতেই এসব ফাঁকফোকর রাখেন।

খুনের পর বাড়ির আশেপাশের সবার ভাষ্য নিতে গিয়ে একজনের ভুল ইংরেজিতে ‘স্টপ ইয়োর আউথ’ বলে ওঠা খুব ভালো সেন্স অব হিউমারের পরিচয় রাখে। ট্যুরিস্ট পুলিশ মিলন চরিত্রে হাস্যরস ও বিশ্বস্ততা মিলিয়ে চেহারায় সরল ও চোখে উপস্থিত বুদ্ধির ছাপ ভালো ফুটিয়েছেন নাজমুস সাকিব। পুলিশ কর্মকর্তা রবিন চরিত্রে  ইমতিয়াজ বর্ষণ অনেকখানি স্ক্রিন টাইম পেয়েছেন। তার কণ্ঠ ও অভিনয় ভালো ছিল। তবে এই চরিত্র আরও জোরালো করা গেলে বিপরীতে গোলাম মামুন চরিত্রটি আরও দুর্বার হয়ে উঠতো।   

পলিটিকাল অ্যাকশন থ্রিলার হিসাবে ‘গোলাম মামুন’ গল্পের পটভূমি বেশ সাহসী। মনে রাখার মতো ছোট ছোট অনেক ঘটনা, সংলাপ আর দৃশ্য রয়েছে। সাংবাদিক তানিয়ার রক্তাক্ত দেহের কাছে তার অবুঝ সন্তানের খেলনা নিয়ে বসে থাকা, প্রতিবেশিদের কারও কারও তানিয়াকে ভ্রষ্টা নারী বলার চেষ্টা, খুনের পেছনে পরকীয়ার মোটিভ দাঁড় করানো এবং প্রশাসন-সংবাদমাধ্যমের কাছে এমন অপরাধের পরের ৪৮ ঘণ্টা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার জায়গাগুলো অনেক বাস্তব ঘটনার কথা মনে করিয়ে দেবে।

জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়, দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়া, ক্ষমতায় থাকার পরও মন্ত্রীর অসহায়ত্ব, এখানে-সেখানে আগুন লাগা, হুট করে ইন্টারনেট আটকে যাওয়ার মতো ছোট ছোট ঘটনাগুলোর পেছনে বড় বড় হাত থাকার কথা বলতে পারায় দর্শক সমসাময়িক অবস্থার প্রেক্ষাপটে ’গোলাম মামুন’ সিরিজকে শক্তিশালী বলে মেনে নেবে। একেবারে শেষে টকশোতে বিশেষজ্ঞ মত দিতে আসা আলোচকদের বুদ্ধির দৌড় দর্শকের কাছে হাসির খোরাক হবে।

ছোটখাটো পেশাদার খুনি থেকে সরকার-প্রশাসন সব মিলিয়ে গড়ে ওঠা অধরা ও নিষ্ঠুর ‘হুকুমত’ নামের কনসেপ্ট ‘গোলাম মামুন’ সিরিজের দুর্ধর্ষ দিক। এই ‘হুকুমত’ কনসেপ্ট পরের সিজনে আরও জটিল ও জোরালো না করলে দর্শকের আকর্ষণ কমে যাবে ‘গোলাম মামুন’ থেকে।

গোলাম মামুন সিরিজে বন্দুক, গোলাগুলি, মৃত্যু রয়েছে প্রচুর। এরপরও রক্তপাতের দৃশ্য অস্বস্তিকর ভাবে দর্শকের সামনে আনেননি পরিচালক। রক্তপাতের দৃশ্য হরেদরে ক্যামেরায় না তুলেও স্ক্রিনে অ্যাকশন-ভায়োলেন্সের ছাপ রাখা যায় – শিহাব শাহীনের এই দক্ষতা থেকে সমসাময়িক আরও অনেক পরিচালকের শেখার আছে।

পিছু নেওয়া হুকুমতের লোকদের আগে মটর বাইকে করে ছুটছে গোলাম মামুন – এই চোর-পুলিশ খেলায় ‘রেস’ সিনেমার মতো মজা আছে; তাই বলে নকল মনে হবে না।

ইংরেজি ‘এফ’ বর্ণ দিয়ে শুরু গালিটি হলিউডের সিনেমায় বহু যুগ ধরে দেখে অভ্যস্ত আমরা। বলিউডেও চলে এসেছে এই ‘এফ’। আমাদের এখানে বড় পর্দায় এ নিয়ে রাখঢাকা আছে, তবে ওটিটিতে অনেকদিন ধরেই চরিত্রের মুখে ‘এফ’ বর্গের গালি শোনা যায়। ‘গোলাম মামুন’ সিরিজেও আছে। আমাদের দর্শকরা যেহেতু অভ্যস্ত হয়ে গেছে, তাই দৃশ্যের চাহিদা বুঝে এরকম গালির অনুমোদন বড় পর্দাতেও রাখা যায় টুকটাক মাত্রায়।

বেশির ভাগ ওয়েব সিরিজ দেখার পরে মনে হয় অন্তত একটা পর্ব কমিয়ে রাখলে কাহিনীতে থ্রিলার আরও ঠাসা হতো; গোলাম মামুন দেখার সময়ও তাই মনে হয়েছে।  

‘পৃথিবীতে কেউ রিয়েল না, সবার একটা মুখোশ থাকে’; যারা ‘গোলাম মামুন’ দেখেছেন তারা এই সংলাপের অর্থ জানেন। পরের সিজনে এই কথায় ভর করে  দর্শকের জন্য আরও জটিল চমক আনা যেতে পারে।

এর আগে  ‘সিন্ডিকেট’ ওয়েব সিরিজ থেকে অ্যালেন স্বপনকে তুলে নিয়ে ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’ বানিয়েছিলেন শিহাব শাহীন। ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’ ছিল বাংলাদেশে প্রথম স্পিন-অফ সিরিজ। এক বছর পর আরও একটি স্পিন-অফ নিয়ে এলেন শিহাব শাহীন। এই ধারাটি বড় পর্দায় আনা যায়। ওটিটিতে হাত মকশো হয়ে গেছে শিহাব শাহীনের। তার পরিণত নির্মাণে পলিটিকাল থ্রিলার ‘গোলাম মামুন’ বড় পর্দাতেও লুফে নেবে দর্শক।

আইএমডিবিতে ‘গোলাম মামুন’ রেটিং পেয়েছে ৭.৪/১০; যদিও এই ওয়েব সিরিজ আরেকটু বেশি রেটিং দাবি করে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত