প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই কেবল মনে হয়, নাহ ঘুমটা বোধয় হলো না। অথচ ৬-৭ ঘন্টা ধরে টানা ঘুমিয়েছেন। আসলে ঘুমের দেশে ডুব দিতে যে কসরতটা নিত্য আপনাকে করতে হয়, তাতে করে নিশ্ছিদ্র ঘুম হওয়া একটু কঠিনই বটে।
ঘুমোতে গিয়ে যদি এপাশ-ওপাশ করে, আর একটু পর পর ঘড়ি দেখেই ঘন্টাখানেক পার করে দিতে হয়, তবে কার না ঘুম ভালো হয়? আবার ঘুম থেকে উঠে নিজেকে কী বোধ দিচ্ছেন তার ওপরও নির্ভর করে ঘুম কতটা হলো। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠেই যদি মনে হয় আরেকটু ঘুমালে ভালো হতো, তবে কিন্তু এক অতৃপ্তি নিয়েই সারাদিন পার করে দিতে হবে। এর প্রভাব পড়বে শরীরেও।
এ বিষয়ে ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্লিপ অ্যান্ড পেইন ডিপার্টমেন্টের ডিরেক্টর নিকোল ট্যাং বলেন, “ভালো ঘুম কী তা আমরা সবাই জানি। বেশিরভাগ মানুষ ধরে নেয় ভালো ঘুম হওয়াটা কেবল রাতের ঘুমের ওপরই নির্ভরশীল। কিন্তু ঘুমের আগে এবং পরে যা যা ঘটছে, তাও ঘুমের ওপর প্রভাব ফেলে।”
সকালের ঝরঝরে অনুভূতি কেবল মাত্র রাতের ভালো ঘুমের ওপরই নির্ভর করেনা। ঘুম নিয়ে নিকোল ট্যাং এর গবেষণায় তেমন ইঙ্গিতই পাওয়া গেছে। ঘুম, ক্লান্তি ইত্যাদি নিয়ে নিজস্ব বাছবিচার পদ্ধতি এবং ওইসময় গুলোতে আমরা কী করছি তা ঘুম পরবর্তী শরীরের ওপর প্রভাব ফেলে। ঘুম নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি যে ঘুমের ওপর প্রভাব ফেলে এই ধারণা একেবারে নতুন নয়।
ঘুমের একটি সমস্যার নাম “প্যারাডক্সিকাল ইনসমনিয়া”। এই প্যারাডক্সিকাল ইনসমনিয়া বিজ্ঞানীদের বেশ কয়েক দশক ধরেই বিভ্রান্তির মধ্যে রেখেছে। কারণ এই সমস্যায় যারা ভুগে থাকেন, তারা বিশ্বাস করেন যে তাদের ঘুম কম হচ্ছে। ফলে দিনের বেলা তারা ক্লান্ত বোধ করেন। কিন্তু যখন তাদের ঘুম নিরপেক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়, তখন দেখা যায় তাদের ঘুম স্বাভাবিকই ছিল।
বেশ কিছু গবেষণা দাবী করছে, বেশিরভাগ অনিদ্রা রোগে ভোগা ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেই নাকি এই বিষয়টি খাটে। একটা পর্যালোচনায় দেখা গেছে অনিদ্রায় ভোগা ৮ থেকে ৬৬ শতাংশ ব্যক্তির মধ্যেই এই লক্ষণগুলো আছে। গবেষণাটি অবশ্য অনিদ্রা রোগের ঝুঁকি অস্বীকার করছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘুমের সময়কালের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যের সম্পর্কটি এখনও অস্পষ্ট। গবেষণাগুলো সাধারণত স্বাস্থ্যের সঙ্গে ঘুমের সম্পর্ক নিরূপনের চেষ্টা করে। তবে হ্যাঁ, শরীরে বাসা বাঁধা কিছু রোগ কম ঘুমের কারণ হতে পারে। যেমন কেউ যদি শ্বাসকষ্টে ভুগে থাকেন, তবে মাঝে মাঝেই তাদের ঘুমাতে সমস্যা হবে।
টরন্টো ইউনিভার্সিটির ইভোলিউশন ল্যাবের পরিচালক এবং নৃ-বিজ্ঞানী ডেভিড স্যামসন বলেন, “আমাদের ঘুমকে আমরাই সমস্যায় ফেলে দিয়েছি”। তিনি এবং তার সহকর্মীরা গবেষণা করে দেখেছেন যে শিকারী সমাজের মানুষ সাধারণত রাতে ৫.৭ থেকে ৭.১ ঘন্টা ঘুমায়। অন্যদিকে শিল্পায়ন ঘটেছে এমন সমাজের মানুষের ঘুম নিরবিচ্ছিন্ন নয়।
দুটি গ্রুপের ওপর স্যামসন গবেষণা চালিয়েছিলেন। একটি নামিবিয়ায় অন্যটি বলিভিয়ায়। খাদ্য সংগ্রহ করে জীবন ধারণ করে এমন একটি গ্রুপের ওপর গবেষণা চালিয়ে দেখা গেল, ৩ শতাংশের কম ব্যক্তি তাদের ঘুম নিয়ে কোন অভিযোগ দিচ্ছেন। অন্যদিকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল সমাজে তা ৩০ শতাংশ। তবে কোন গ্রুপই “ইনসমনিয়া” শব্দটি ব্যবহার করেননি।
স্যামসনের মতে, খাদ্য সংগ্রহকারী সমাজের মানুষ উন্নত সমাজের মানুষের চাইতে অনেক কম ঘুমায়। যদিও ঘুম নিয়ে তাদের অভিযোগ প্রায় নেই বললেই চলে।
স্যামসন বলেন, “পশ্চিমে এমন কথা চালু আছে যে, মানুষ প্রাচীনকালে কখনোই বর্তমান সময়ের মতো ঘুম বঞ্চিত ছিল না। এটা একেবারেই বাজে কথা।”
গবেষকরা বলছেন, ঘুমের কোন আদর্শ ধারণায় বিশ্বাস করলে তাতে বরং হিতে বিপরীত হতে পারে। যাদের ইনসমনিয়া (অনিদ্রাজনিত সমস্যা) আছে, তারা সাধারণত মনে করে “আমার ৭ ঘন্টা ঘুম হতেই হবে, বা হলে দিনটা খুব খারাপ যাবে”। এমন ধারণা আসলে তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে ঘুমোতে গেলেই তৈরি হয় উদ্বেগ আর বার বার ঘড়ি দেখা। যা কিনা ঘুম আরও কঠিন করে তোলে।
এ ব্যাপারে নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘুম গবেষক জেসন ওং বলেন, “ইনসমনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ‘আমার ৮ ঘন্টা ঘুম দরকার নয়তো আগামীকাল আমি কাজ করতে পারব না’ বিশ্বাসটি শুধু সমস্যাজনকই নয়, মূলত এটাই তাদের ঘুমাতে দেয়না।”
ঘুম নিয়ে অনেক বেশি ব্যতিব্যস্ত হলে ঘুম তো কঠিন হয়ে যাবেই উলটো পরদিন ঘুম থেকে উঠে শরীরে ভর করতে পারে ক্লান্তি।
জেসন ওং-কে তার এক রোগী জানায়, একবার তিনি তার স্লিপ ডায়রিতে (স্লিপ ট্র্যাকিং ডিভাইস) তার ঘুমের সময় লিখেছিলেন ৬ ঘন্টা। পরে জিম থেকে বের হবার সময় তার মনে পড়লো তিনি আসলে ঘুমিয়েছেন ৫ ঘন্টা। আর এ কথা মনে হতেই তাকে ক্লান্তি এসে ভর করে।
এই কথা জানার পর জেসন তাকে বলেন, “আপনি এক ঘন্টা কম ঘুমিয়েছেন শুধুমাত্র এটা মনে পড়তেই আপনি ক্লান্ত বোধ করছেন। কতক্ষন ঘুমিয়েছেন এটা গুরুত্বপূর্ণ? নাকি আপনি কতক্ষণ ঘুমিয়েছেন বলে মনে করছেন সেটা গুরুত্বপূর্ণ?”
এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, বাজারে স্লিপ ট্র্যাক করার নানা ধরণের ডিভাইসের আমদানী পরিস্থিতি আরও কঠিন করে তুলেছে।
গবেষকরা বলছেন, ঘুম থেকে উঠে আমাদের হয়তো কোন সমস্যাই বোধ হয়না। কিন্তু তখনই স্মার্ট ওয়াচ আমাদের জানায়, ঘুমটা ভালো হয়নি। আর সঙ্গে সঙ্গে ক্লান্তি আমাদের গ্রাস করে ফেলে।
তবে উপায়?
উপায় আছে। সেই চিরাচরিত সব নিয়ম কানুন। ঘুমানোর আদর্শ নিয়মগুলো মেনে চলা, যার মধ্যে একটি হল- অ্যালকোহল এবং ক্যাফেইন এড়িয়ে চলা।
এসব পদ্ধতির বাইরেও, ভিন্ন কিছু পদ্ধতি প্রয়োগ করা যায়। যেমন- ঘুম ভালো না হলেও নিজেকে বলা যে দিনটা ভালো ছিল। রাতে পর্যাপ্ত ঘুম না হলে, পরদিন একটি খারাপ দিনই আসবে। কিন্তু এটাকেই বরং সহজভাবে নেওয়া গেলে শারীরিক কষ্ট কমে আসবে। তাই গবেষকরা বলছেন, ঘুম হয়নি বলে সব পরিকল্পনা বাতিল করে দিয়ে দিনটাকেই মাটি করে দেবেন না।
তথ্যসূত্র: বিবিসি